১৭ মে ২০১৭, বুধবার, ১০:১০

খেলাপি ঋণ লাগামহীন

খেলাপি ঋণের লাগাম কোনোভাবেই টানতে পারছে না বাংলাদেশ ব্যাংক। বিশেষ সুবিধা দিয়ে ১৬ হাজার কোটি টাকার ঋণ দীর্ঘ মেয়াদে পুনর্গঠন করেছে। পর্যাপ্ত অর্থ জমা ছাড়াই ঋণ পুনঃ তফসিল করে দিচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এরপরও গত মার্চ শেষে দেশের ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ বেড়ে হয়েছে ৭৩ হাজার ৪০৯ কোটি টাকা, যা ব্যাংকের মোট ঋণের ১০ দশমিক ৫৩ শতাংশ।

গত বছরের মার্চে খেলাপি ঋণ ছিল ৫৯ হাজার ৪১১ কোটি টাকা। অর্থাৎ, এক বছরে খেলাপি ঋণ বাড়ল ১৪ হাজার কোটি টাকা।
এর বাইরে আরও ৪৫ হাজার কোটি টাকার ঋণ অবলোপন করা হয়েছে। এ তথ্য খেলাপির হিসাবে নিলে দেশে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় ১ লাখ ১৮ হাজার কোটি টাকা। চিত্রটি রীতিমতো আঁতকে ওঠার মতোই বলে মনে করেন ব্যাংকার-অর্থনীতিবিদেরা।
ব্যাংক-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, সরকারি ব্যাংকগুলো থেকে রাজনৈতিক বিবেচনায় ঋণ দেওয়া হচ্ছে। অপর দিকে বেসরকারি ব্যাংকগুলোর পরিচালকেরা নিজেদের মধ্যে ঋণ আদান-প্রদান করছেন। যে উদ্দেশ্যে এসব ঋণ নেওয়া হচ্ছে, তার যথাযথ ব্যবহার হচ্ছে না। ঋণের অর্থ পাচারও হচ্ছে। এর সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকের কিছু ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাও। নিয়মিত ঋণ পরিশোধ না করা ব্যবসায়ীরাই ঠিক করছেন সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকের পাশাপাশি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন পদে কারা আসবেন। এ কারণে বাংলাদেশ ব্যাংক রয়েছে নীরব দর্শকের ভূমিকায়। ফলে ক্রমেই খেলাপি ঋণের ভয়াবহতা বেরিয়ে আসছে।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএম) সাবেক মহাপরিচালক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক মইনুল ইসলাম এ নিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, অর্থঋণ ও দেউলিয়া আদালতের মাধ্যমে ঋণখেলাপিদের কোনো বিচার হচ্ছে না। এ কারণে ঋণখেলাপিরা সাহস পেয়ে গেছেন। ঋণখেলাপিদের বিচারে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন এখন সময়ের দাবি। তাঁদের জেলে পাঠিয়ে সম্পত্তি জব্দ করলে খেলাপি ঋণ বাড়বে না।
মইনুল ইসলাম বলেন, অবলোপন করা ঋণের তথ্য গোপন করে গ্রাহকদের সঙ্গে প্রতারণা করা হচ্ছে। এই ঋণও খেলাপি এবং সুদ আরোপ হচ্ছে। ঋণখেলাপি রাঘববোয়ালদের শাস্তি হলেই খেলাপি ঋণ কমে আসবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, গত মার্চ শেষে ব্যাংক খাতের ঋণ বেড়ে হয়েছে ৬ লাখ ৯৭ হাজার ১ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি হয়েছে ৭৩ হাজার ৪০৯ কোটি টাকা। খেলাপি ঋণের ৩৫ হাজার ৭১৬ কোটি টাকা সোনালী, অগ্রণী, জনতা, রূপালী, বেসিক ও বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের।
এ ছাড়া ৪০টি বেসরকারি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ২৯ হাজার ৭২৭ কোটি টাকা। বিদেশি ৯ ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ২ হাজার ২৮২ কোটি টাকা এবং বিশেষায়িত ব্যাংকগুলোর ৫ হাজার ৬৮৪ কোটি টাকা।
বেসরকারি ব্যাংকের দুজন জ্যেষ্ঠ ব্যবস্থাপনা পরিচালক নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধনের উদ্যোগ ব্যাংক খাতকে আরও খারাপ করে তুলবে। কয়েকজন পরিচালক মিলে বেসরকারি ব্যাংকগুলোতে যে সিন্ডিকেট তৈরি করেছে, তা আরও জোরদার হবে। ঋণ কারা পাবেন, কারা এমডি হবেন—সবই ঠিক করছে এ সিন্ডিকেট। ফলে ব্যাংকগুলোতে এমডিরা কোনো ভূমিকা রাখতে পারছেন না। তাঁদের চাপে দেওয়া ঋণ খেলাপি হয়ে পড়ছে।
ব্যাংকগুলোর কর্মকর্তারা বলছেন, ডিসেম্বর মাসে আর্থিক প্রতিবেদন ভালো দেখাতে অনেক খারাপি ঋণও নিয়মিত দেখানো হয়েছে। এসব ঋণ মার্চে এসে আর কিস্তি শোধ করেনি। ফলে প্রকৃত চিত্র বেরিয়ে আসছে। যেসব ঋণ খেলাপি হয়ে পড়েছে, তার ১০ শতাংশও আদায় করা সম্ভব না।
যোগাযোগ করা হলে অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) সাবেক চেয়ারম্যান ও মেঘনা ব্যাংকের এমডি মোহাম্মদ নুরুল আমিন প্রথম আলোকে বলেন, খেলাপি ঋণ এত হয়ে যাওয়া নিঃসন্দেহে উদ্বেগজনক। তবে মার্চ মাসে খেলাপি ঋণ একটু বাড়েই। সবাইকে সাবধান হতে হবে। যেসব ঋণ খেলাপ হচ্ছে, তা আদায়ে সবাইকে তৎপর হতে হবে।

http://www.prothom-alo.com/economy/article/1182856/