১৭ মে ২০১৭, বুধবার, ১০:০৯

বিশেষ সুবিধা নিয়ে আর্থিক অবস্থা ভালো দেখিয়েছে ৭ ব্যাংক

খেলাপি ঋণ বাড়ায় বেসরকারি খাতের ন্যাশনাল ব্যাংককে ২০১৬ সালের আর্থিক হিসাবে ৮৬৪ কোটি টাকা সঞ্চিতি সংরক্ষণের প্রয়োজন হয়। এ পরিমাণ সঞ্চিতি রাখতে হলে ব্যাংকটি লোকসানে চলে যেত। এ কারণে ২০১৬ সালের সঞ্চিতি সংরক্ষণে ২০১৯ সাল পর্যন্ত সময় চায়। বাংলাদেশ ব্যাংকও ১৫ শতাংশ সঞ্চিতি রেখে পরবর্তী তিন বছরে ২৫, ৩০ ও ৩০ শতাংশ করে দীর্ঘ মেয়াদে সঞ্চিতি সংরক্ষণের বিশেষ সুযোগ দেয়। ফলে ব্যাংকটি ৫৬০ কোটি নিট মুনাফা করার সুযোগ পায়। সঞ্চিতি রাখতে হয় মুনাফা থেকে। মুনাফা থেকে নিয়মিত সঞ্চিতি সংরক্ষণে ব্যর্থ হওয়ায় ব্যাংক কোম্পানি আইন অনুযায়ী শেয়ারধারীদের নগদ লভ্যাংশ দিতে পারেনি ব্যাংকটি।

খেলাপি ঋণের মান অনুযায়ী সঞ্চিতি সংরক্ষণে ব্যর্থ হয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছ থেকে দীর্ঘ মেয়াদে সঞ্চিতি সংরক্ষণের বিশেষ সুবিধা চেয়েছিল ১০ টর বেশি ব্যাংক। তার মধ্য থেকে বাংলাদেশ ব্যাংক ৭ ব্যাংককে বিশেষ এ সুবিধা দিয়েছে। ন্যাশনাল ব্যাংকের পাশাপাশি সুবিধা পাওয়া অন্য ছয়টি ব্যাংক হলো বেসরকারি খাতের এবি, প্রিমিয়ার, ব্যাংক এশিয়া, বাংলাদেশ কমার্স এবং রাষ্ট্রমালিকানাধীন সোনালী ও রূপালী ব্যাংক। এর মধ্যে সোনালী ও কমার্স ব্যাংক ছাড়া বাকি পাঁচটি শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত।
বেসরকারি খাতের ঢাকা ও পূবালী ব্যাংক এ সুবিধা নিলেও তা কার্যকর করেনি বলে ব্যাংক দুটির শীর্ষ নির্বাহীরা জানান। এ ছাড়া আদালতে রিট থাকায় ঋণের বিপরীতে সঞ্চিতি সংরক্ষণেও কয়েকটি ব্যাংককে বাড়তি সময় দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর মাধ্যমে ব্যাংকগুলো ২০১৬ সালের আর্থিক প্রতিবেদন ভালো দেখানোর সুযোগ পেয়েছে। যদিও বেশির ভাগ ব্যাংকই তাদের আর্থিক প্রতিবেদনে বিশেষ এ সুবিধা পাওয়ার বিষয়টি সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করেনি।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিশেষ এ সুবিধা নিয়ে ব্যাংকগুলোর কোনোটি মুনাফা বাড়িয়ে দেখিয়েছে, আবার কেউ লোকসান কমিয়ে দেখিয়েছে। ফলে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত ব্যাংকগুলোর প্রকৃত মুনাফা সম্পর্কে অনেকটাই বিভ্রান্তিকর তথ্য পেয়েছে শেয়ারধারীরা। তবে চলতি বছরে খেলাপি ঋণ নিয়মিত হয়ে গেলে ব্যাংকগুলোর সঞ্চিতি সংরক্ষণের প্রয়োজন পড়বে না।
জানতে চাইলে ন্যাশনাল ব্যাংকের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক এ এস এম বুলবুল প্রথম আলোকে বলেন, বিশেষ এ সুবিধার ফলে আর্থিক প্রতিবেদন ভালো করা গেছে। খেলাপি ঋণগুলো আদায়ের চেষ্টা চলছে।
সংশ্লিষ্ট ব্যাংক সূত্র জানায়, সিটিসেল, রাইজিং গ্রুপ ও অফশোর ব্যাংকিংয়ের ঋণ খেলাপি হওয়ায় ২০১৬ সালের আর্থিক হিসাবে এবি ব্যাংকের ১ হাজার ৩৪০ কোটি টাকার সঞ্চিতি সংরক্ষণের প্রয়োজন পড়ে। ২০১৬ সালে ১০ শতাংশ সঞ্চিতি রেখে পরবর্তী তিন বছরে ৩০ শতাংশ করে সঞ্চিতি সংরক্ষণের সুযোগ পায় ব্যাংকটি। ফলে গত বছরে ব্যাংকটি ১৫০ কোটি নিট মুনাফা দেখাতে পেরেছে।
একইভাবে গত বছর প্রিমিয়ার ব্যাংকের ৭০৫ কোটি টাকা সঞ্চিতি সংরক্ষণের প্রয়োজন হয়। তার মধ্যে ব্যাংকটিকে গত বছরের হিসাবে ৩০ কোটি টাকা সঞ্চিতি রাখার সুযোগ দেওয়া হয়। বাকি ৬৭৫ কোটি টাকা পরবর্তী তিন বছরে মুনাফা থেকে রাখার সুযোগ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ফলে বছর শেষে ব্যাংকটি ১৬০ কোটি টাকা নিট মুনাফা করতে পেরেছে।
বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের ২৯৭ কোটি টাকা সঞ্চিতি সংরক্ষণের প্রয়োজন হলেও ব্যাংকটি তা করতে ব্যর্থ হয়। পরে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিশেষ সুবিধা নিয়ে ব্যাংকটি ২ কোটি টাকা মুনাফা দেখানোর সুযোগ পায়। যদিও ব্যাংকটির ৩৮ শতাংশ বা ৬২৫ কোটি টাকা ঋণই খেলাপি। মূলধন ঘাটতি রয়েছে ৩৫৪ কোটি টাকা। এ নিয়ে ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক আর কিউ এম ফোরকানের সঙ্গে তিন দিন ধরে যোগাযোগ করেও মন্তব্য পাওয়া যায়নি।
এদিকে ব্যাংক এশিয়াও একই সুযোগ পেয়ে মুনাফা বাড়িয়ে দেখানোর সুযোগ নিয়েছে। জানা গেছে, আদালতে রিট থাকা ঋণের বিপরীতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঞ্চিতি রাখার নির্দেশনার পর ব্যাংকটি বিপাকে পড়ে। পরে বিশেষ সুবিধা নিয়ে ১৫৪ কোটি টাকা নিট মুনাফা দেখানোর সুযোগ পেয়েছে।
রাষ্ট্রমালিকানাধীন সোনালী ব্যাংকের গত বছর ২ হাজার ৩০০ কোটি টাকা সঞ্চিতি সংরক্ষণের প্রয়োজন হয়। তবে ব্যাংকটিকে বিশেষ সুবিধার আওতায় ২০১৯ সাল পর্যন্ত ধাপে ধাপে সঞ্চিতি সংরক্ষণের সুযোগ দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। ফলে ২০১৬ সালে ১৫০ কোটি টাকা মুনাফা দেখানোর সুযোগ পায় রাষ্ট্রমালিকানাধীন এ ব্যাংক।
সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ওবায়েদ উল্লাহ আল মাসুদ বলেন, ‘ব্যাংকটি যখন কোম্পানি হলো, তখন সাড়ে ৬ হাজার কোটি টাকা লোকসান ছিল। সরকার কিন্তু আমাদের ওই টাকা দেয়নি, ফলে প্রতিবছর কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে বিশেষ সুবিধা নিয়ে আর্থিক প্রতিবেদন তৈরি করতে হচ্ছে। ব্যাংকটির উন্নয়নে কাজ করছি আমরা।’
গত বছর রূপালী ব্যাংকের ২ হাজার ৫০০ কোটি টাকার সঞ্চিতি সংরক্ষণের প্রয়োজন দেখা দেয়। বিশেষ সুবিধা দিয়ে ব্যাংকটিকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত সঞ্চিতি সংরক্ষণের সুযোগ করে দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ফলে ২০১৬ সালে ব্যাংকটির লোকসান কমে হয় ১২১ কোটি টাকা।
জানতে চাইলে রূপালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আতাউর রহমান প্রধান বলেন, ‘বিশেষ সুবিধার ফলে আমাদের লোকসান কমেছে। ভবিষ্যতে যেন এমন সুযোগ নিতে না হয়, এ জন্য আমরা গ্রাহকদের সঙ্গে নিবিড়ভাবে কাজ করছি।’

http://www.prothom-alo.com/economy/article/1182531/