গঙ্গা-পদ্মার বুকে সেই অভিশপ্ত ফারাক্কা বাঁধ। ডানে : রাজশাহীর মাদরাসা ময়দানের বিশাল গণসমাবেশে ভাষণ দিচ্ছেন মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী -ফাইল ফটো
১৬ মে ২০১৭, মঙ্গলবার, ১২:০৬

চার দশকে পদ্মার পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ প্রকৃতি থেকে হারিয়ে গেছে অসংখ্য নদী

আজ ১৬ মে ঐতিহাসিক ‘ফারাক্কা লং মার্চ’ দিবস। মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বে ১৯৭৬ সালের এই দিনে গঙ্গার উপর নির্মিত ভারতীয় বহুমুখি বাঁধ ফারাক্কার অভিমুখে এই লং মার্চ অনুষ্ঠিত হয়।
ঐদিন সারা দেশ থেকে রাজশাহীতে জমায়েত হওয়া লাখ লাখ মানুষকে নিয়ে স্মরণকালের বৃহত্তম মিছিলে নেতৃত্ব দিয়ে মাওলানা ভাসানী চাঁপাই নবাবগঞ্জের কানসাট গমন করেন এবং সেখানে সমাবেশের মধ্যদিয়ে কর্মসূচি সমাপ্ত হয়। দেশের অভ্যন্তরে এই কর্মসূচি পালিত হলেও এর রেশ উপমহাদেশ ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও পৌঁছে যায়। আজো এই দিনটি ভারতীয় আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে দাবি আদায়ের পক্ষে প্রেরণার উৎস হয়ে আছে। ফারাক্কা লং মার্চের ৪১তম বার্ষিকী উপলক্ষে আজ রাজশাহীর পদ্মাপাড়ে এক গণজমায়েতের আয়োজন করা হয়েছে।
এদিকে গত চার দশকে পদ্মার পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। ফারাক্কার প্রভাবে প্রকৃতি থেকে হারিয়ে গেছে অসংখ্য নদী। ফারাক্কা চুক্তির নামে ভারতের পানি-প্রতারণাও অব্যাহত রয়েছে। ১৯৯৬ সালে ৩০ বছর মেয়াদি গঙ্গা চুক্তি স্বাক্ষরের পরও বাংলাদেশের পানি প্রাপ্তির সর্বনিম্ন হার অব্যাহত রয়েছে। শুষ্ক মওসুমে ফারাক্কা বাঁধ পেরিয়ে এতো কম পানি আর কখনই বাংলাদেশের ভাগ্যে জোটেনি। এমনকি গঙ্গা চুক্তি যখন ছিল না সেই সময়টাতে পানি নিয়ে এমন দুর্ভোগের মুখে পড়তে হয়নি বাংলাদেশকে। পানি না পাবার প্রধান কারণ, উৎস থেকে শুরু করে গঙ্গার মাঝপথেই পানির সিংহভাগ প্রবাহ সরিয়ে নিচ্ছে ভারত। ফলে পর্যাপ্ত পানি ফারাক্কা পর্যন্ত পৌঁছাতে পারছে না। সে কারণে ফারাক্কা পয়েন্টে বাংলাদেশকে দেবার মতো যথেষ্ট পানি থাকে না। মধ্যখানে বাংলাদেশের মানুষ চুক্তির নামে প্রতারণার শিকার হচ্ছে বলে পর্যবেক্ষকদের অভিমত।
উল্লেখ্য, মওলানা ভাসানীর সেদিনের লং মার্চ ছিল বাংলাদেশে ভারতের পানি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে লাখো জনতার এক বজ্রনির্ঘোষ প্রতিবাদ যা দিল্লীর মসনদেও কাঁপন ধরিয়ে দেয়। ওই দিন রাজশাহীর মাদরাসা ময়দান থেকে লং মার্চ শুরু হয়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জের কানসাটে গিয়ে শেষ হয়। দিনটি ছিল রোববার। সকাল ১০টায় রাজশাহী থেকে শুরু হয় জনতার পদযাত্রা। হাতে ব্যানার আর ফেস্টুন নিয়ে অসংখ্য প্রতিবাদী মানুষের ঢল নামে রাজশাহীর রাজপথে। ভারতবিরোধী নানা শ্লোগানে মুখরিত হয়ে উঠে পুরো জনপদ। বেলা ২টায় লাখো মানুষের গোদাগাড়ীর প্রেমতলী গ্রামে গিয়ে পৌঁছায়। সেখানে মধ্যাহ্ন বিরতির পর আবার যাত্রা শুরু হয়। সন্ধ্যা ৬টায় লং মার্চ চাঁপাইনবাবগঞ্জ কলেজ মাঠে পৌঁছায়। কলেজ মাঠেই রাত যাপনের পর সোমবার সকাল ৮টায় আবার যাত্রা শুরু হয় শিবগঞ্জের কানসাট অভিমুখে। ভারতীয় সীমান্তের অদূরে কানসাটে পৌঁছানোর আগে মহানন্দা নদী পার হতে হয়। লাখ লাখ মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে যোগ দেন এই লং মার্চে। তারা নিজেরাই নৌকা দিয়ে কৃত্রিম সেতু তৈরি করে মহানন্দা নদী পার হন। কানসাট হাইস্কুল মাঠে পৌঁছানোর পর সমবেত জনতার উদ্দেশে মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী তার জ্বালাময়ী ভাষণ দেন। মওলানা ভাসানী ভারতের উদ্দেশে বলেন, ‘তাদের জানা উচিত বাংলার মানুষ এক আল্লাহকে ছাড়া আর কাউকে ভয় পায় না। কারো হুমকিকে পরোয়া করে না।’ তিনি বলেন, ‘আজ রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও কানসাটে যে ইতিহাস শুরু হয়েছে তা অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর নতুন অধ্যায়ের সৃষ্টি করবে।’ মওলানা ভাসানী এখানেই লংমার্চের সমাপ্তি ঘোষণা করেন। বাংলাদেশ সীমানার মধ্যে লং মার্চ সমাপ্ত হলেও সেদিন জনতার ভয়ে ভীত ভারতীয়রা সীমান্তে প্রচুর সৈন্য মোতায়েন ও নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদার করে। ১৯৭৬ সালে মওলানা ভাসানীর ঐতিহাসিক প্রতিবাদ পদযাত্রা গোটা জাতির চেতনাকে শাণিত করে। একদিকে জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে সরকার যখন ভারতের সঙ্গে ফারাক্কা সমস্যা নিয়ে দর কষাকষি করছিল, তখন মওলানা ভাসানীর এই পদযাত্রা সরকারের দর কষাকষিতে প্রবল শক্তি সঞ্চয় করে। সরকার সাহসী হয় ফারাক্কা সমস্যা জোটনিরপেক্ষ সম্মেলন ও জাতিসংঘে উত্থাপন করতে।
এদিকে গত চার দশক আগে বাংলাদেশের নদীসমূহের যে পরিস্থিতি ছিল আজ তাতে যোগ হয়েছে আরো ভয়াবহ অবস্থা। ফারাক্কার প্রতিক্রিয়া ও প্রভাবে বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের গঙ্গা-পদ্মা ছাড়াও অন্যান্য ছোট ও মাঝারি ধরনের নদ-নদী শুকিয়ে গেছে। নদীর তীরবর্তী বিস্তীর্ণ এলাকা এখন অনেকটাই মরুভূমিতে পরিণত হয়েছে। এর ফলে এক ভয়াবহ পরিবেশ বিপর্যয় অতি আসন্ন। শুধু গঙ্গা নয়- তিস্তা, মহানন্দা, বারাক নদীতে বাঁধ এবং আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্পের মাধ্যমে একতরফা পানি প্রত্যাহার করা হচ্ছে। ভারত বলে আসছে যে, বাংলাদেশের ক্ষতি হয়- নদীকেন্দ্রিক এমন কোন প্রকল্প তারা বাস্তবায়ন করবে না। কিন্তু পরিস্থিতি সম্পূর্ণ বিপরীত। ফারাক্কাজনিত কারণে বাংলাদেশে পানির অভাবে যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া ও ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, উত্তরাঞ্চল ও দক্ষিণাঞ্চলের প্রায় ৮ কোটি মানুষ এবং এক-তৃতীয়াংশ এলাকা সেচের পানির অভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, গঙ্গা-কপোতাক্ষ প্রকল্পের ৬৫ শতাংশ এলাকায় সেচ কার্যক্রম চালানো সম্ভব হচ্ছে না, অতিরিক্ত লবণাক্ততার জন্য জমির উর্বরা শক্তি কমে গিয়ে পৃথিবীর বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ সুন্দরবনের প্রায় ১৭ ভাগ নষ্ট হয়ে গেছে, ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নীচে নেমে যাওয়ায় হাজার হাজার হস্তচালিত পাম্প অকেজো হয়ে গেছে। দেশের প্রায় ২১ শতাংশ অগভীর নলকূপ ও ৪২ শতাংশ গভীর নলকূপ ব্যবহার করা সম্ভব হচ্ছে না, ভূগর্ভস্থ পানিতে আর্সেনিকের বিষাক্ত প্রভাবে পশ্চিমাঞ্চলের অনেক জেলায় টিউবওয়েলের পানি খাবার অযোগ্য হয়ে পড়েছে, নদী শুকিয়ে যাওয়ায় ভূগর্ভস্থ যে পানি উত্তোলন করা হয় সেটা পূরণ (রিচার্জ) হচ্ছে না, ফারাক্কার কারণে যশোর-খুলনা অঞ্চলে মিঠাপানির প্রবাহ কমে গেছে, বৃহত্তর খুলনা অঞ্চলে লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়ায় প্রচলিত ধান উৎপাদন হ্রাস পেয়েছে। মিঠাপানির অভাবে কৃষি ও অন্যান্য শিল্প-কারখানা অচল হয়ে পড়ছে, ফারাক্কার প্রভাবে নদীর জীবনচক্র ধ্বংস হয়ে গেছে, জলজপ্রাণীকুল ধ্বংস হওয়ার পথে, ইলিশের বিচরণক্ষেত্র পদ্মায় আর ইলিশ আসে না। দুই শতাধিক প্রজাতির মিঠাপানির মাছ ও ১৮ প্রজাতির চিংড়ি ছিল সেগুলোর অধিকাংশই ধ্বংস হয়ে গেছে, নদীর বুকে জেগে উঠেছে বিশাল ধু ধু বালু চর, নদীর মূলধারা বিভক্ত হয়ে পড়েছে অসংখ্য সরু ও ক্ষীণ ¯্রােতধারায়। প্রায় ১৫০০ কি.মি. নৌ পথ বন্ধ হয়ে গেছে, বাংলাদেশের প্রায় ৯৩ হাজার ৩০০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। প্রতিবছর ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৫০০ কোটি টাকা।

http://www.dailysangram.com/post/283883-