১৬ মে ২০১৭, মঙ্গলবার, ১২:০১

আ’লীগ পক্ষে বিএনপি বিপক্ষে স্বচ্ছ ব্যালট বাক্সের পর এবার ইভিএম

বিগত ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নিরঙ্কুশ বিজয় নিয়ে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসে। তখন স্টিলের তৈরি ব্যালট বাক্সের পরিবর্তে প্লাস্টিকের স্বচ্ছ ব্যালট বাক্সের প্রবর্তন করা হয়। এবার আগামী একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ইলেক্ট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) ব্যবহার করতে চায় বর্তমান কে এম নূরুল হুদার নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন। আর এতে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে পূর্ণ সম্মতি দেয়া হয়েছে। আর বিএনপির পক্ষ থেকে বিরোধিতা করা হচ্ছে। নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও বিএনপি স্বচ্ছ ব্যালট বাক্সের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছিল কিন্তু আওয়ামী লীগ পক্ষে অবস্থান নেয়ায় স্বচ্ছ ব্যালট বাক্স চালু করা হয়।
সূত্রমতে, ইভিএম পদ্ধতি নিয়ে বেশ জটিলতা রয়েছে। এ পদ্ধতিতে নির্বাচনে কারচুপির সুযোগ রয়েছে। এর আগের কমিশন ইভিএম পদ্ধতিতে ভোট গ্রহণের চেষ্টা চালিয়েছিল। কিন্তু টেকনিক্যাল নানা সমস্যার কারণে নির্বাচন কমিশন এ পদ্ধতি আর প্রবর্তন করেনি। বর্তমান নির্বাচন কমিশন আবার সেই ইভিএম পদ্ধতি চালু করতে চায়। ইতোমধ্যে নির্বাচন কমিশন ইভিএম এর টেকনিক্যাল বিষয়গুলো যাচাই করছে। গত বৃহস্পতিবার ইভিএম ব্যবহারে কারিগরি দিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞদের সাথে বৈঠক করেছে নির্বাচন কশিমন।
এ বিষয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কেএম নুরুল হুদা বলেন, রাজনৈতিক দল ও সরকার চাইলে একাদশ সংসদ নির্বাচনেও ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) ব্যবহার করা সম্ভব। প্রযুক্তিটি সবার কাছে আগে গ্রহণযোগ্য হতে হবে। এখনও প্রাথমিক পর্যায়ে ইভিএম নিয়ে ভাবনা চলছে। পরীক্ষামূলকভাবে ব্যবহারের পর রাজনৈতিক দলসহ সবার কাছে বিশ্বাসযোগ্যতা পেলেই ইভিএম ব্যবহার করা যাবে বলে তিনি উল্লেখ করেন।
তিনি বলেন, স্বল্প সময়ের মধ্যে ইভিএম ব্যবহার করার সুযোগ নেই। ছোট ছোট নির্বাচনে পরীক্ষা করতে হবে ব্যবহার করা যাবে কিনা। তার আগে রাজনৈতিক দলগুলো এটা চায় কিনা জানতে হবে। আমরা কারও ওপর এটা চাপিয়ে দিতে চাই না। প্রযুক্তিটির বিষয়ে বিশ্বাসযোগ্যতা আনতে সবার সঙ্গে আলোচনার প্রয়োজন রয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলোর সম্মতি পেলে এবং সরকার চাইলে আগামী সংসদেও ইভিএম ব্যবহার সম্ভব। এ জন্য বড় ধরনের প্রস্তুতি নিতে হবে।
এদিকে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে চলছে নীরব ও সরব প্রস্তুতি। এর পাশাপাশি নির্বাচন পরিচালনা ও ভোট গ্রহণ পদ্ধতি নিয়েও চলছে পক্ষে-বিপক্ষে নানা বিতর্ক।
এরই মধ্যে আওয়ামী লীগ মত দিয়েছে, নির্বাচন সংবিধান অনুযায়ী বর্তমান সরকারের অধীনেই হবে। নির্বাচনকালীন সরকারের প্রধান হবেন শেখ হাসিনা। আর ভোট গ্রহণ পদ্ধতি হিসেবে ইলেকট্রনিকস ভোটিং মেশিংয়ের (ইভিএম) পক্ষে আওয়ামী লীগ।
অন্যদিকে, বিএনপি ইভিএম পদ্ধতি নিয়ে আনুষ্ঠানিক কোনো প্রস্তাব না দিলেও আওয়ামী লীগের প্রস্তাবকে এরই মধ্যে প্রত্যাখ্যান করেছে। তবে দলটির নেতারা জানিয়েছেন, তাঁরা এ ব্যাপারে শিগগির প্রস্তাব দেবেন।
এ ব্যাপারে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘আমরা নির্বাচনকালীন সরকার ও ইভিএম নিয়ে আপত্তি জানিয়েছি, এ কথা সত্যি। তবে আমরা এখনো কোনো প্রস্তাব দিইনি। শিগগির এ-সংক্রান্ত একটি প্রস্তাব দেবো; যেমনভাবে ঘোষণা করে করেছি ভিশন-২০৩০।’
কবে নাগাদ সে প্রস্তাব আসতে পারে এবং সে প্রস্তাবে কী থাকতে পারে এমন প্রশ্নের জবাবে সাবেক এ মন্ত্রী বলেন, ‘আগে প্রস্তাব দিই, প্রস্তাব দিলেই জানতে পারবেন। আমরা আনুষ্ঠানিকভাবে এ প্রস্তাব দেবো।’
আর বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রহুল কবির রিজভী ইভিএমে ‘আওয়ামী লীগের ইচ্ছার প্রতিফলন’ দেখছেন। তিনি বলেন, ‘ভোট কারসাজি করতেই আওয়ামী লীগ ইভিএম পদ্ধতি চায়। নির্বাচন কমিশন যদি তাই করে, তবে এটা হবে আওয়ামী লীগের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটানো।’
তবে আওয়ামী লীগ এতে ‘নিজেদের ইচ্ছার প্রতিফলন নয়, বরং ভোটে প্রযুক্তির ব্যবহার ও বিকাশের ব্যবস্থা’ হিসেবে দেখতে চায়। দলটির সাংগঠনিক সম্পাদক খালিদ মাহমুদ চৌধুরী এ ব্যাপারে বলেন, ‘বিএনপি নব্বইয়ের পরে ফ্রি সাবমেরিন কেবল নিতে চায়নি। পরে এর অনিবার্যতা বুঝে কিনে নিতে হয়েছিল। আসলে বিএনপি নেতারা প্রযুক্তি বিকাশের সঙ্গে চলতে পারেন না, পিছিয়ে থাকতে ভালোবাসেন। ইভিএমের প্রতি অনীহা আবারও তাই প্রমাণ করল।’
আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল-আলম হানিফ বলেন, ‘আমরা সংবিধানে বিশ্বাস করি। সংবিধান অনুযায়ী বর্তমান সরকারের অধীনেই নির্বাচন হবে। আর বর্তমান বিশ্বের সঙ্গে মিলিয়ে আমাদের সরকার এগিয়ে চলছে। ভোট পদ্ধতিও আমরা অন্যান্য দেশের মতো করার জন্য মত দিয়েছি। সে জন্যই আমরা মনে করেছি, এ মুহূর্তে ইভিএমের বিকল্প নেই। এ মাধ্যমেই দ্রুত সময়ে স্বচ্ছ নির্বাচন সম্ভব। এটা অস্বীকার মানে প্রযুক্তিকে স্বাগত না জানানো।’
ইভিএম নিয়ে বিএনপি ও আওয়ামী লীগের এই পরস্পরবিরোধী অবস্থান দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে আরো জটিল করে তুলবে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। তাঁরা মনে করেন, প্রযুক্তির সঙ্গে থেকেই সবার মতামতের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে সমাধানের পথ বের করতে হবে।
সুশাসনের জন্য নাগরিক সুজনের সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘ইভিএম পদ্ধতি নিয়ে বিতর্ক না করে উভয়ের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে সমাধানের পথ অনুসন্ধান করাই মঙ্গলজনক হবে। বিএনপি প্রস্তাব দেবে, সেটা তো ভালো কথা। তবে তা অবশ্যই যেন সমাধানের পথ দেখায়।’
উভয়ে যদি ঐকমত্যে না আসে, তাহলে এর সমাধান হবে না বলে মন্তব্য করেছেন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক ড. ইফতেখারুজ্জামান। তিনি বলেন, ‘নির্বাচন পরিচালনার বিষয়ে দেওয়া দলীয় প্রস্তাব এবং সে অনুযায়ী নির্বাচন কমিশনের সিদ্ধান্ত যেন কোনো দলের দলীয় চিন্তাকে বাদ দিয়ে না হয়। সবার সঙ্গে আলোচনা করে নির্বাচনের একটি সুন্দর, সুষ্ঠু, অবাধ পরিবেশ তৈরি হবে, এমনটাই আমরা প্রত্যাশা করি।’

http://www.dailysangram.com/post/283889-