৩ মার্চ ২০২৪, রবিবার, ৩:৪০

রেস্টুরেন্টের অনুমতি ছিল না ভবনটির

বেইলি রোডে গ্রিন কোজি কোটেজ নামে ভবনটির সব ফ্লোর ব্যবহার হচ্ছিল বাণিজ্যিকভাবে। তবে রেস্টুরেন্টের জন্য ব্যবহারের কোনো অনুমতি ছিল না এ ভবনের। অনুমতি ছিল শুধু অফিসকক্ষ হিসেবে ব্যবহারের জন্য।

ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ৬ জনের মৃত্যুর পর ভবনটি এখন পরিণত হয়েছে ধ্বংসস্তূপে। সামনে পড়ে আছে ভাঙা কাচ, আগুনে পোড়া কয়লা। ভবনটি ঘিরে এখন শুধু হাহাকার আর নীরবতা। আগুনের ঘটনায় ইতিমধ্যে মামলা হয়েছে। গত শুক্রবার রাতে পুলিশ বাদী হয়ে এ মামলা করে। মামলায় আসামিদের বিরুদ্ধে অবহেলাজনিত মৃত্যুর অভিযোগ আনা হয়েছে। এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত ছয় জনকে আটক করা হয়েছে। অগ্নিকাণ্ডে নিহত ৪৬ জনের মধ্যে থেকে এ পর্যন্ত ৪৪ জনের লাশ তাদের স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। গতকাল শনিবার ঢাকার অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট একেএম হেদায়েতুল ইসলাম জানান, বাকি দুটি লাশের মধ্যে একটি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে এবং অপরটি শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে রয়েছে।

গতকাল সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত ওই ভবনের সামনে অবস্থান করে দেখা গেছে, নিরাপত্তার স্বার্থে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ভবনটি ঘিরে রেখেছে। ভবনের সামনে এখনও রয়েছে উৎসুক জনতার ভিড়। ভবন পরিদর্শন করেছেন বিভিন্ন সংস্থার লোকজন। এছাড়া মারা যাওয়া ব্যক্তিদের স্বজন, বন্ধুরা তাদের শেষ স্মৃতি নিয়ে কথা বলছেন ভবনের সামনে এসে। খোলা হয়েছে ভবনটির আশপাশের ব্যবসা-প্রতিষ্ঠানও। ঘটনার পর এলাকার লোকজনের মাঝে ভয়ভীতিও তৈরি হয়েছে বলে জানান অনেকে।

ফয়সাল রেজা রাতুল বলেন, আমরা একসঙ্গে পড়তাম। গত বৃহস্পতিবার রাতে ভবনটির দ্বিতীয় তলায় একটি রেস্টুরেন্টে আমার বন্ধু বিয়ানকা রয় মাকে নিয়ে খেতে গিয়েছিলে। আগুন লাগলে তারা নিচ পর্যন্ত আসতে পারেনি। সিঁড়িতে আটকা পড়ে মারা যায়। তাদের লাশ সিলেটের হবিগঞ্জে গ্রামের বাড়িতে পাঠানো হয়েছে। ভবনটির সামনে রয়েছে ‘মি. বেকার’ নামে একটি দোকান। এক পাশের শার্টার খুলে দোকানটিতে বেচাকেনা করা হচ্ছে। দোকানের পরিচালক কাজী নাবিল বলেন, ঘটনা ঘটার পর আমরা সচেতন হই, এর আগে না। আমাদের সামনের ভবনে এমন একটি ঘটনা ঘটলো। এসব দেখে নিজের মধ্যে ভয় কাজ করে।

এমপি অতিরিক্ত কমিশনার খ. মহিদ উদ্দিন বলেন, ভবনের নিচতলার খাবার দোকান থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়। আগুনের ঘটনায় অবহেলাজনিত কারণে মৃত্যু অভিযোগে একটি মামলা করেছে পুলিশ। ভুক্তভোগী পরিবারের কেউ মামলা করতে চাইলেও করতে পারবে। ভবনের মালিক থেকে শুরু করে যার দায় পাওয়া যাবে, তার বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ভবনের প্রথম তলায় ‘চায়ে চুমুক’ নামে একটি রেস্টুরেন্ট ছিল। এছাড়া ছিল ‘গ্যাজেট অ্যান্ড গিয়ার’, ‘স্যামসাং’, ‘শেখ হোলিক ও ওয়াফে বে’ নামে চারটি শোরুম। দ্বিতীয় তলার পুরোটাজুড়ে ছিল ‘কাচ্চি ভাই’ রেস্টুরেন্ট। তৃতীয় তলায় ‘ইলিয়ন’ নামের একটি শোরুম। চতুর্থ তলায় ‘খানা’স’ নামে একটি রেস্টুরেন্ট, পঞ্চম তলায় ‘পিৎজা হাট’, ষষ্ঠ তলায় ‘স্টিট ওভেন’ ও ‘জেস্টি’ নামে দুটি রেস্টুরেন্ট এবং সপ্তম তলায় ‘ফোকুস’ ও ‘হাক্কা ডাকা’ নামে দুটি রেস্টুরেন্ট ছিল। এছাড়া ভবনটির ছাদেও ‘অ্যাম্বোশিয়া’ নামে একটি রেস্টুরেন্ট ছিল।

রাজউকের নগর পরিকল্পনাবিদ ও বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (ড্যাপ) প্রকল্পের পরিচালক আশরাফুল ইসলাম বলেন, ভবনটির এক থেকে সাততলা পর্যন্ত বাণিজ্যিক অনুমোদন নেয়া হয়েছে। তবে তা শুধু অফিসকক্ষ হিসেবে ব্যবহারের জন্য। রেস্টুরেন্ট, শো-রুম বা অন্য কিছু করার জন্য অনুমোদন নেয়া হয়নি। আগুনে দগ্ধ মেহেদী হাসানের চিকিৎসা চলছে বার্ন ইনস্টিটিউটে। তিনি বলেন, চীন থেকে তাদের এক বন্ধু এসেছেন। স্ত্রী উম্মে হাবিবাকে সঙ্গে নিয়ে ওই বন্ধুর সঙ্গে বেইলি রোডে খেতে গিয়েছিলেন তারা। খাবারের মেনু যখন হাতে নেন, ঠিক তখনই আগুন লেগে যায়। মেহেদী হাসান বলেন, ওই দিনের আগুনের বিমর্ষ ছবি আর মনে করতে চাই না।

চার বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে খেতে এসেছিলেন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী সাদ মাহমুদ। তিনি বলেন, কয়েকবার সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামার চেষ্টা করেছি। আগুন লাগার কিছুক্ষণের মধ্যে পুরো ভবন ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। পরে সিঁড়ি দিয়ে নামতে পারিনি। যখন পুরো ভবনে আগুন ছড়িয়ে পড়ে, তখন সবাই ছোটাছুটি করছিলেন। তখন বন্ধুদের হারিয়ে ফেলেন সাদ মাহমুদ। সাদ আরও বলেন, ভবনের ছয় তলার একটি খাবারের দোকানের রান্নাঘরে ৬০/৭০ জন গিয়ে আশ্রয় নেন। অনেকেই বের হয়ে গেলে শেষ পর্যন্ত ১০ থেকে ১৫ জন সেখানে ছিলেন। অনেকে ভয় পেয়ে ছয়তলার জানালা ভেঙে তার সামনেই লাফিয়ে নিচে পড়ছিলেন। আগুনে দুই বন্ধু মারা গেছেন বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি।

গতকাল শনিবার শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউটে দগ্ধ রোগীদের দেখতে আসেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী সামন্ত লাল সেন। এ সময় সাংবাদিকদের তিনি বলেন, এখানে ১১ জন ভর্তি হয়েছিলেন। তাদের মধ্যে ৬ জনকে চিকিৎসকেরা ছাড়পত্র দিয়েছেন। তাদের শারীরিক অবস্থা ভালো। বাকি পাঁচজনকে ভর্তি রাখা হয়েছে। তাদের অবস্থা এখনো আশঙ্কাজনক। চিকিৎসার জন্য একটি মেডিকেল বোর্ড গঠন করা হয়েছে। ১৭ সদস্যের এই মেডিকেল বোর্ডের প্রধান স্বাস্থ্যমন্ত্রী সামন্ত লাল সেন নিজেই।

কাচ্চি ভাইয়ের ম্যানেজার-চা চুমুকের মালিকসহ চারজন রিমান্ডে : বেইলি রোডের গ্রিন কোজি কটেজ নামের ভবনে আগুনে ৪৬ জনের মৃত্যুর ঘটনায় করা মামলায় কাচ্চি ভাইয়ের ম্যানেজার ও চা চুমুকের দুই মালিকসহ চারজনের প্রত্যেকের দুদিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। রিমান্ডকৃতরা হলেন- কাচ্চি ভাইয়ের ম্যানেজার জিসান, চা চুমুকের মালিক আনোয়ারুল হক ও শাকিল আহমেদ রিমন এবং গ্রিন কোজি কটেজ ভবনের ম্যানেজার হামিমুল হক বিপুল। শনিবার তাদের আদালতে হাজির করে পুলিশ। এরপর ঘটনার সুষ্ঠু তদন্তের জন্য মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা রমনা থানার পরিদর্শক (তদন্ত) আনছার মিলটন তাদের রিমান্ডের আবেদন করেন। শুনানি শেষে ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ নুরুল হুদা চৌধুরীর দুদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।

https://dailyinqilab.com/national/article/642512