৩ মার্চ ২০২৪, রবিবার, ৩:৩৮

ধানমণ্ডির ৫ ভবনে ৯২ রেস্তরাঁ

ধানমণ্ডি ১৫ নম্বর থেকে শংকর বাসস্ট্যান্ড। রাস্তার দু’পাশে সুউচ্চ ভবনের সারি। আলোর ঝলকানি। সুবিশাল বিলবোর্ড। হরেক রকম নামফলক। খাবারের চটকদার বিজ্ঞাপন। ভোজন রসিকদের আকৃষ্টের চেষ্টার কোনো কমতি নেই। পাশাপাশি পাঁচটি ভবন ঘিরে নানা বয়সী মানুষের উপচেপড়া ভিড়। গাউছিয়া টুইন পিক, ইম্পেরিয়াল আমিন আহমেদ সেন্টার, কেবি স্কয়ার, রূপায়ণ জেডআর প্লাজা, ইউনিমার্ট ভবনের লিফটে উঠতে লাইন ধরতে হয়। কী আছে সেখানে।

কেন এতো মানুষের আনাগোনা। এই ৫ ভবনে আছে ৯২টি ক্যাফে, লাউঞ্জ, রেস্টুরেন্ট। সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত মানুষের ভিড় লেগে থাকে।

সালেহা আমির নামে একজন ক্রেতা মানবজমিনকে বলেন, এক বিল্ডিংয়ে ১৫ থেকে ২০টি রেস্টুরেন্ট। বেশি এদিক-সেদিক যেতে হয় না। প্রায়ই খেতে আসি। খেয়ে চলে যাই। কখনো ঝুঁকি অথবা নিরাপত্তা নিয়ে ভাবা হয়নি। ভবনে কী আছে, কী নেই। মনে কখনো সেই প্রশ্নও জাগেনি। তবে বেইলি রোড ট্রাজেডি অনেক প্রশ্ন রেখে গেল। এই অব্যস্থাপনার অবসান হওয়া উচিত। এক ভবনে ২৫ রেস্তরাঁ এখন মৃত্যুকূপ ভাবতে হবে।

সরজমিন দেখা গেছে, ধানমণ্ডি ১৫ নম্বর বাসস্ট্যান্ডের আশপাশে প্রতিটি ভবনেই ক্যাফে, লাউঞ্জ ও রেস্টুরেন্ট আছে। কোনো কোনো ভবনে ২০ থেকে ২৫ টির অধিক রেস্টুরেন্ট আছে। কিছু কিছু ভবনে রেস্টুরেন্ট ছাড়া অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানই নেই। তবে ভবনে বাণিজ্যিক লেখা থাকলেও কোনো প্রকার বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানই তা ভাড়া পায়নি। ভাড়া দেয়া হয়েছে রেস্টুরেন্ট ব্যবসায়ীদের। এদের কেউ কেউ ভবনের একাধিক ফ্লোর ভাড়া নিয়ে রেস্টুরেন্ট করেছেন। নিয়ম-নীতিরও তোয়াক্কা করেনি। অধিকাংশ ভবনেই ভেন্টিলেশন ব্যবস্থা নেই। অগ্নিনির্বাপক যন্ত্রও দেখা যায়নি। কয়েকটি রেস্টুরেন্ট ঘুরে দেখা গেছে, কাঁচের প্রাচীরে ঘেরা রেস্টুরেন্টের কোথাও কোনো জানালা নেই। কিচেনে একটি মাত্র এগজস্ট ফ্যান দেখা গেছে। রেস্টুরেন্টের বাইরে থেকে ভেতরে হাওয়া-বাতাস ঢোকারও কোনো ব্যবস্থা রাখা হয়নি। সবসময় এসি ব্যবহার করা হয়। প্রতিটি ভবনে ওঠানামার জন্য লিফটের উপর নির্ভর করতে হয়। সিঁড়ি থাকলেও তা ব্যবহারের উপযোগী নয়। সরু সিঁড়ি দিয়ে ২ জনের বেশি ওঠানামাও করা যায় না। ইউনিমার্ট ভবনে কোনো সিঁড়িই দেখা যায়নি। লিফ্‌ট এবং এসকেলেটর দিয়েই মানুষ ওঠানামা করেন। আবার কয়েকটি ভবনে বিভিন্ন তলায় অবস্থিত রেস্টুরেন্ট ও ক্যাফের কিচেনেই রাখা হয়েছে গ্যাস সিলিন্ডার। প্রতিদিন সকাল ১০ টা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত চুলা জ্বালানো থাকে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ভবনের একজন নিরাপত্তা কর্মী বলেন, ভবনের প্রতিটি রেস্টুরেন্টের কিচেনেই গ্যাস সিলিন্ডার আছে। বারবার উঠানো নামানোর ঝামেলা এড়াতে কেউ কেউ এক মাসের গ্যাস সিলিন্ডার একবারে এনে কিচেনেই মজুত রাখেন। এতে কোনো কোনো কিচেনে ১০ থেকে ১৫টি সিলিন্ডারও পাওয়া যাবে। রেস্টুরেন্ট মালিকদের গ্যাস সিলিন্ডার নিচে রাখার নির্দেশনা দেয়া আছে। কেউ তা মানেন না। নিচে সিলিন্ডার আছে। কিন্তু ব্যবহার হয় না। ওটা শুধুমাত্র সো করার জন্য রেখে দেয়া হয়েছে। প্রতি রেস্টুরেন্টে সপ্তাহে ২টি সিলিন্ডার ব্যবহার হয়। কিন্তু তাদের কখনো নিচের এই সিলিন্ডার পরিবর্তন করতে দেখি না। তাহলে চুলা জ্বলে কীভাবে। প্রশ্ন থেকেই যায়।
ইউনিমার্ট ভবনের আফগান গ্রিল রেস্টুরেন্টের ওয়েটার নাদিম আহমেদ বলেন, আমরা কখনো নিরাপত্তার কথা ভাবিনি। ভবনে গ্যাস সংযোগ নেই। সবাই সিলিন্ডার ব্যবহার করে। প্রতি ফ্লোরে প্রতি ক্যাফেতেই একাধিক সিলিন্ডার আছে। সারা দিনই চুলা জ্বালাতে হয়। বেইলি রোডের আগুন দেখে ভয় হচ্ছে। জীবন হাতে নিয়ে বসে আছি। এই চাকরি আর করা যাবে না।

ধানমণ্ডির গাউছিয়া ডেভেলপার লিমিটেডের বাণিজ্যিক ভবন গাউছিয়া টুইন পিক। বিল্ডিংয়ের ১ থেকে ১৪তলা পর্যন্ত অন্তত ২৩টি রেস্টুরেন্ট ও কফি হাউজ আছে। নিচতলায় লাজ ফার্মা। ৩য়তলার একপাশে ব্র্যাক ব্যাংকের একটি শাখা রয়েছে। প্রথমতলা থেকে পর্যায়ক্রমে রয়েছে গালিটস ফ্লেম গ্রিল চিকেন, সোলাস্তা ডাইন, ক্যাফে ডলস, আদি কড়াই গোস্ত, ক্যাফে সাও পাওলো, উম চা ডিস্ট্রিক্ট, দ্য লবি বাফেট, দ্য লবি লাউজ, এরিস্টোক্রেট লাউঞ্জ, হোয়াইট হল, ম্যারিটেজ ঢাকা, দ্য প্যান প্যাসিফিক লাউঞ্জ, স্পাইস অ্যান্ড হারব, কালচার অ্যান্ড কুসাইন, চাপ ঘর, কাভান সিগনেচার, কে ড্রব, লুমিনেডজ, ক্যাফে রিও, রেট্রো লাইভ কিচেন, তলা স্পাইস অ্যান্ড হাবস, বাফেট রেস্টুরেন্ট। ডান ও বাম দুই পাশেই এসব রেস্টুরেন্ট অবস্থিত। ভবনে একটি সিঁড়ি থাকলেও নেই কোনো ইমার্জেন্সি সিঁড়ি।
ধানমণ্ডির কেবি স্কয়ার: ১৫ নম্বর ওভারব্রিজের পাশে ধানমণ্ডি কেবি স্কয়ার। ১৩তলা ভবনে ১৭টি রেস্টুরেন্ট আছে। প্রথম তলা থেকে পর্যায়ক্রমে রয়েছে ওজং রেস্টুরেন্ট, চিজ রেস্টুরেন্ট, টেক আউট স্ন্যাকস, ম্যাডসিফ, ওরাবি রেস্টুরেন্ট, দ্য ডার্ক টু রেস্টুরেন্ট, ডি স্মাক ক্যাফে, গুহা দ্য ক্যাভ কিচেন, টেস্টি ব্লাস্ট, নিউ ট্রিট ক্যাফে অ্যান্ড রেস্টুরেন্ট, আর্ট অব ফুড ম্যাক্সিক্যান রেস্টুরেন্ট, গ্রিন্ড হাউজ রেস্টুরেন্ট, জেরস, জিনিয়াল বাফেট, ব্ল্যাক পেপার, মানসেরি, টার্কিস সল্ট।

ইম্পেরিয়াল আমিন আহমেদ সেন্টার: এই ভবনে প্রতিটি কিচেনেই বড় সাইজের একাধিক গ্যাস সিলিন্ডার দেখা গেছে। ১২ তলা ভবনের প্রতি ফ্লোরেই একাধিক রেস্টুরেন্ট রয়েছে। এই বিল্ডিংয়ে নামিদামি ১৯টি রেস্টুরেন্ট ও লাউঞ্জ রয়েছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে, ক্রিসেন্ট রেসিপি, স্নাপিট ক্যাফে, মি. বেকার, ডুরুম রেস্টুরেন্ট, কিউরিয়ান লাউঞ্জ, ঢাকা বুট বার্ন, ধাবা, কিউরিয়াস-২, গোল্ডেন লাইফ মিউজিক ক্যাফে, স্ন্যাক অ্যাটাক, স্পাইসি রমনা, বাফেট স্টোরিজ, গার্লিক এন জিঞ্জার, কাবাব ফ্যাক্টরি, ভাইবস্‌, কিমচি রেস্টুরেন্ট, এমব্রোসিয়া ইনফিনিটি লাউঞ্জ, দ্য ক্যাফে রিও, দ্য ফরেস্ট লাউঞ্জ।

রূপায়ণ জেড আর প্লাজা: ইম্পেরিয়াল আমিন আহমেদ সেন্টারের অপরপাশেই রূপায়ণ জেড আর প্লাজা। ১২তলা বিশিষ্ট এই ভবনে ১২টি রেস্টুরেন্ট আছে। এরমধ্যে রয়েছে, ধানমণ্ডি কাবাব অ্যান্ড রেস্টুরেন্ট, বাফেট লাউঞ্জ, অ্যালাউস, দ্য বাফেট এম্পায়ার, মুম্বাই এক্সপ্রেস, দায়মাসু রেস্টুরেন্ট, ফ্যাসিনো, হান্ডি, লাভা রেস্টুরেন্ট, দ্য ডার্ক ক্যাফে অ্যান্ড রেস্টুরেন্ট, বাফেট প্যারাডাইস, অ্যালাউস গোর্মেট।

ইউনিমার্ট ভবন: পুরাতন ইউআইইউ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভবন ইউনিমার্ট। এই ভবনে প্রবেশে ২ তলা পর্যন্ত সিঁড়ি আছে। ৬তলাবিশিষ্ট ইউনিমার্টের প্রথম ও দ্বিতীয় তলায় সুপার শপ। বাকি তিনতলায়ই রেস্টুরেন্টে ঠাসা। এই ভবনে ২১টি রেস্টুরেন্ট রয়েছে। ভবনের ৩য় তলায় রয়েছে ফ্লরেনটাইন, অ্যাবসুলেট থাই, ইনডুলজ ক্যাফে, আফগান গ্রিল, সিলান্ট্রো, ক্যাবাবস এন কুরিস, ইনডো চাইনিজ, সেভয় গ্যালারি, গ্রিন্স এন্ড সিডস, পিৎজা গায়, টোকিও কিচেন, ক্রিসপি, উৎসব ফুড নামের ডজন খানেক রেস্তরাঁ। ৪র্থতলায়, হাক্কা ঢাকা, পাঞ্জাব কিচেন, টুকটুক থাই, টার্কিস এক্সপ্রেস, অ্যাবসুলেট কোরিয়ান, চামিচি, টার্কিস আইস। ৫ তলায় থাই ইমিরাল্ড নামে একটি বিদেশি রেস্টুরেন্ট রয়েছে।

https://mzamin.com/news.php?news=100051