৩ মার্চ ২০২৪, রবিবার, ২:৫২

বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধিতে জনদুর্ভোগ বাড়বে

-মুঈদ রহমান

এ লেখা যে সময় প্রকাশিত হবে, সেই সময় দেশের মানুষ বিদ্যুতের বাড়তি দামের মানসিক চাপে থাকবেন। সরকার মার্চের প্রথম সপ্তাহেই বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত কার্যকর করলেও ফেব্রুয়ারি থেকেই বাড়তি বিল পরিশোধ করতে হবে গ্রাহকদের। এর সঙ্গে আরও যুক্ত করা হয়েছে, আগামী তিন বছরে তা বেড়ে বর্তমান দামের চেয়ে দ্বিগুণ দামে উন্নীত করা হবে। চাঁদের হিসাব অনুযায়ী, ১২ মার্চ থেকে পবিত্র রমজান শুরু হবে। এ মাসের পবিত্রতাকে পাশ কাটিয়ে নিত্যপণ্যের অব্যাহত মূল্যবৃদ্ধি বর্তমানে এক স্বাভাবিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। বস্তুত রমজানে সাধারণ মানুষের ভোগান্তি যেন এখন অনেকটাই নিয়মিত ব্যাপার। এ বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে অসাধু ব্যবসায়ীদের প্রতি কঠোর বার্তা দেওয়া হলেও শেষ পর্যন্ত কিছুই হয় না। হয় না, এর কারণ হলো শাসকদের শ্রেণিচরিত্র। আমাদের দেশের শাসনব্যবস্থা তুলনামূলকভাবে একটি ক্ষুদ্র শ্রেণির স্বার্থরক্ষা করতে আগ্রহী, বিরাট অঙ্কের সাধারণ মানুষের স্বার্থহানি তাদের বিচলিত করে না। তাই রমজানে নিত্যপণ্যের সম্ভাব্য মূল্য পরিস্থিতি নিয়ে দেশের প্রায় ৭৫ শতাংশ মানুষ উদ্বিগ্ন থাকলেও শাসকগোষ্ঠীর সেদিকে নজর কম। এবারে সরকার নিজেই দুর্ভোগদানকারীর ভূমিকায় নেমেছে-বাড়িয়েছে বিদ্যুতের দাম।

২০০৯ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বেড়েছে ১৪ বার এবং পাইকারি পর্যায়ে বেড়েছে ১২ বার। গত বছরই বিদ্যুতের দাম তিন পর্যায়ে বেড়েছে প্রায় ১৫ শতাংশ। শুরুতে খুচরা পর্যায়ে দাম বাড়বে ৮ দশমিক ৫ শতাংশ এবং পাইকারি পর্যায়ে বাড়বে ৫ দশমিক ০৭৪ শতাংশ। নিচের দিকে ইউনিটপ্রতি বিদ্যুতের দাম বাড়বে ৩৪ পয়সা, আর ওপরের দিকে বাড়বে ৭০ পয়সা। এ দামবৃদ্ধিকে যুক্তিসংগত হিসাবে প্রতিষ্ঠা করতে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে-বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকি সমন্বয় চলছে। কিন্তু যে কথা সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়নি তা হলো ‘গণশুনানি’। বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম সমন্বয়ের ক্ষেত্রে আগে গণশুনানির ব্যবস্থা ছিল। বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) দেশের বিশিষ্টজনদের সঙ্গে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর যৌক্তিকতা নিয়ে গণশুনানি করত। সেখানে আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে একটি দাম নির্ধারিত হতো। কিন্তু ২০২২ সালের ডিসেম্বরে আইন সংশোধন করা হয়। সেই থেকে এ গণশুনানিকে পাশ কাটিয়ে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয় নিজের মতো করেই দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। অজুহাত হিসাবে সরকারের পক্ষ থেকে ভর্তুকি কমানোর সেই পুরোনো কৌশলের কথাই বলা হচ্ছে। যদিও ভর্তুকির অর্থও জনগণের দেওয়া করের টাকাতেই পরিশোধ করা হয়। কিন্তু একটি প্রশ্নের উত্তর যথাযথভাবে পাওয়া যায় না, তা হলো, ভর্তুকির দায় কি শুধুই জনগণের? বিদ্যুৎ খাতে খরচ বৃদ্ধির অন্যতম কারণগুলোর মধ্যে কয়েকটি হলো, অপরিকল্পিত উৎপাদন প্রক্রিয়া, অপরিকল্পিত সক্ষমতা তৈরি, অবৈধ বিদ্যুৎ সংযোগ, বিদ্যুৎ চুরি, অনিয়ম, দুর্নীতি, অস্বাভাবিক সঞ্চালন ব্যয় ইত্যাদি। প্রথম কারণটির বিশ্লেষণে বলব-আমাদের দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনে জ্বালানি হিসাবে ব্যবহার করা হয় ফার্নেস অয়েল, গ্যাস ও কয়লা। যদি ফার্নেস অয়েল ব্যবহার করা হয় তাহলে ১ ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে খরচ পড়বে গড়ে ১৭ টাকা; আর যদি কয়লা ব্যবহার করা হয় তাহলে ইউনিটপ্রতি খরচ হবে প্রায় ৬ টাকা; গ্যাস ব্যবহারে খরচ হয় ৪ টাকা। অর্থাৎ অন্যান্য জ্বালানির তুলনায় ফার্নেস তেলভিত্তিক উৎপাদন খরচ প্রায় তিনগুণ। এত বড় আকারের ব্যয় সত্ত্বেও ২০২২-২৩ অর্থবছরে ফার্নেস অয়েল ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়েছে মোট উৎপাদনের প্রায় ২৩ শতাংশ। পাশাপাশি গ্যাস ও কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো কেন বসিয়ে রাখা হয়েছে এর কোনো সদুত্তর সরকারের কাছ থেকে পাওয়া যাবে না। অথচ বিদ্যুৎ খাত সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তেলভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন মাত্র ১০ শতাংশ কমাতে পারলে সাশ্রয় হবে বছরে কমপক্ষে ৯ হাজার কোটি টাকা।

বিদ্যুৎ খাতে খরচ বৃদ্ধির দ্বিতীয় কারণ হলো, অপরিকল্পিত সক্ষমতা তৈরি। ২০২২-২৩ অর্থবছরে দৈনিক গড়ে দেশে ঘণ্টায় প্রায় ১০ হাজার ৩০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়েছে। সেই হিসাবে সারা বছরে উৎপাদন করা হয়েছে প্রায় ৯ কোটি মেগাওয়াট। এ পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়েছে সরকারি, বেসরকারি, ভাড়া বিদ্যুৎকেন্দ্র-সব মিলে। এ বিদ্যুৎ কিনতে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) খরচ করেছে ৯৫ হাজার ৩২ কোটি টাকা। এ পরিমাণ টাকা ব্যয় হয়েছে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ বিদ্যুৎ ক্রয় বাবদ। এর পাশাপাশি কোনোরকমের বিদ্যুৎ ছাড়াই কেবল ক্যাপাসিটি চার্জ হিসাবে পরিশোধ করা হয়েছে ২৬ হাজার কোটি টাকা। এর আগের বছরের তুলনায় এ চার্জ ৫৬ শতাংশ বেশি। ভাবা যায়! একরত্তি বিদ্যুৎ উৎপাদন ছাড়াই হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে ২৬ হাজার কোটি টাকা। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, আমাদের সক্ষমতা বাড়াতেই এমনটি করতে হচ্ছে। এটি কোনো সন্তোষজনক জবাব হলো না। বলা হচ্ছে, বর্তমান সময়ে আমাদের বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা প্রায় ২৫ হাজার মেগাওয়াট। এর বিপরীতে আমাদের চাহিদা ১৫ হাজার মেগাওয়াট এবং গড়ে উৎপাদন করা হয় ১০ হাজার ৩০০ মেগাওয়াট। তার মানে হলো, আমাদের মোট সক্ষমতার মাত্র ৪২ শতাংশ ব্যবহার করতে পারছি, আর বাকি ৫৮ শতাংশ অলস থেকে যাচ্ছে! অতিরিক্ত সক্ষমতা থাকা দোষের কিছু নয়, কিন্তু এর জন্য হাজার হাজার কোটি টাকা বিনা কারণেই ব্যয় হয়ে যাচ্ছে, আর এসব ব্যয়ভার বহন করতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে। অথচ ক্যাপাসিটি চার্জের টাকা ভোগ করছে গুটিকয় মানুষ। এর কোনোটির সঙ্গেই সাধারণ মানুষের সংশ্লিষ্টতা নেই। অথচ এর চড়া মূল্য শেষ পর্যন্ত জনগণকেই দিতে হয়। এমনিতেই মূল্যস্ফীতির কারণে সাধারণ মানুষের জীবন অতিষ্ঠ, তার সঙ্গে নতুন করে বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি মানুষের জীবনকে করে তুলবে অসহনীয়। এতকাল মানুষ ব্যবসায়িক ও আমদানিকারকদের কাছে জিম্মি ছিল, এখন তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সরকার। দিশেহারা মানুষের জন্য সুড়ঙ্গের শেষটায় আলো কোথায়?

মূল্যস্ফীতির মধ্যে বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি নিয়ে গত শুক্রবারের যুগান্তর বলছে-বাজার পরিস্থিতি এমনিতেই মানুষের নাগালের বাইরে। এরপর ডলার সংকটে প্রয়োজনীয় নিত্যপণ্য আমদানি করা যাচ্ছে না। এ অবস্থায় গ্যাস-বিদ্যুতের দাম আরও বাড়ানো হলে মূল্যস্ফীতি হবে ভয়াবহ। সব ধরনের পণ্যের উৎপাদন খরচ বাড়বে। কারণ, জ্বালানি এমন একটি খাত, যার মূল্যবৃদ্ধি সবকিছুর ওপর প্রভাব ফেলে। কারণ, উৎপাদনের সঙ্গে জ্বালানি জড়িত। বিদ্যুতের এ অনাকাঙ্ক্ষিত দাম বৃদ্ধির প্রতিক্রিয়ায় সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেছেন, ‘সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, জ্বালানিতে ভর্তুকি বেড়ে যাচ্ছে। এটি সমন্বয় দরকার। কিন্তু বিদ্যুতের বড় আকারে অবৈধ সংযোগ রয়েছে। এ সংযোগগুলো বন্ধ করা হচ্ছে না। কেন করা হচ্ছে না, এটি সরকার ভালো জানে। এছাড়াও এ খাতে দুর্নীতি রয়েছে। এখনো কুইক রেন্টালের কী প্রয়োজন আছে আমি জানি না। এটি নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে অনেক কথাবার্তা আছে। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, বিদ্যুতের উৎপাদন বেড়েছে। আমাদের বিপুল পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়। কিন্তু এরপর কুইক রেন্টাল বন্ধ করা হচ্ছে না। অযথাই এগুলো বসিয়ে ক্যাপাসিটি চার্জ দেওয়া হচ্ছে। কেন এটি করা হচ্ছে তা আমার বুঝে আসছে না।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ এ বিষয়ে অনেকটাই খোলামেলা প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘আমাদের গ্যাসের সন্ধান এবং ব্যবহার করতে পারলে দাম বাড়ানোর দরকার ছিল না। জনগণের কাছে সরকার কোনো জবাবদিহির প্রয়োজন বোধ করে না। এ সরকার দীর্ঘদিন ক্ষমতায়। তারা জ্বালানি নিয়ে সঠিক পলিসি গ্রহণ করতে পারত। তা না করে জনগণকে জিম্মি করে গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়াচ্ছে। সরকার যা ইচ্ছে তাই করছে। অব্যবস্থাপনার মধ্য দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হচ্ছে। এটি একদিন গলার কাঁটা হবে। তখন পুরোপুরি আমদানির দিকেই যেতে হবে। আবার যাদের কাছ থেকে আমদানি করা হবে, সেখানে রাজনীতি আছে। এ রাজনীতি তো বাংলাদেশের জন্য টেকসই নয়। অর্থনীতির ওপর রাজনীতি চেপে বসলে কোনোভাবেই সুফল বয়ে আনে না।’ আমরা বিদ্যুৎ উৎপাদনে কয়লা আমদানির যে নীতি অনুসরণ করছি, তাও অনেকখানি ক্ষতিকর বলে অনেকে মনে করেন।
গণশুনানিকে পাশ কাটিয়ে সরকারের একপেশে সিদ্ধান্ত গ্রহণ কোনোমতেই গ্রহণযোগ্য নয়। একথা ঠিক, আমাদের সমাজ আজ বিভাজিত। সাধারণ মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করার কোনো রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড দৃশ্যমান নয়। বস্তুত শাসকশ্রেণির স্বার্থরক্ষার কাজে নিয়োজিত রয়েছে সরকার। এটি কোনোমতেই প্রত্যাশিত নয়। আমরা সাধারণ মানুষের ভোগান্তির অবসান চাই। দেশের উৎপাদনব্যবস্থাকে সংহত করার স্বার্থে, সাধারণ মানুষকে জীবনযাপনে ন্যূনতম স্বস্তি দিতে, লুটেরা স্বার্থান্বেষী মহলের তৎপরতা প্রতিরোধ করতে সরকারের সিদ্ধান্তটি পুনর্বিবেচনার দাবি করছি।
মুঈদ রহমান : অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়

https://www.jugantor.com/todays-paper/window/780418