২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, মঙ্গলবার, ৭:২৫

আমদানি নিম্নমুখী রমজানকেন্দ্রিক পণ্য সরবরাহ নিয়ে শঙ্কা

ডলার সংকট মোকাবিলা ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সাশ্রয় করতে আমদানিতে কঠোরভাবে লাগাম টানা হয়েছে। এতে রমজানকেন্দ্রিক পণ্যসহ সব ধরনের পণ্য আমদানির এলসি খোলা কমে গেছে। রমজান উপলক্ষে ব্যবসায়ীরা পণ্য আমদানির পর্যাপ্ত ঋণপত্র খুলতে পারছে না। এ অবস্থায় চলতি অর্থবছরের প্রথম ৭ মাসে আমদানিতে ঋণপত্র বা এলসি খোলা কমছে। এ সময় ভোগ্যপণ্যের এলসি খোলা কমেছে ১৬.৯২ শতাংশ। ফলে রমজানকেন্দ্রিক ৮ পণ্য ভোজ্য তেল, ছোলা, ডাল, মটর, পিয়াজ, মসলা, চিনি ও খেজুরের পর্যাপ্ত সরবরাহ নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়েছে।

বাজারে পণ্যের দাম সহনীয় ও সরবরাহ নিশ্চিত করতে গত ১১ই জানুয়ারি রমজান মাসের জন্য ৮ পণ্য বাকিতে আমদানির সুযোগ দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। পরে রমজানে মূল্য নিয়ন্ত্রণে চাল, চিনি, তেল ও খেজুরের শুল্ক-কর কমিয়ে দেয় সরকার। গত ৮ই ফেব্রুয়ারি জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) এসব পণ্যের শুল্ক-কর কমানোর ঘোষণা দিলেও এখনো বাজারে কোনো পণ্যের দাম কমার লক্ষণ দেখা যায়নি।
খেজুর এখন বিলাসী পণ্যের দরে বিক্রি হচ্ছে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, রোজায় চিনি ও খেজুরসহ অন্য পণ্য সরবরাহে বিঘ্ন ঘটতে পারে। এতে বাজারে অস্থিরতা সৃষ্টির আশঙ্কা রয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম ৭ মাসে (জুলাই-জানুয়ারি) ভোগ্যপণ্যের এলসি খোলা হয়েছে ৩৯৭ কোটি ৯৮ লাখ ডলারের।

যা এর আগের অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ৮১ কোটি ডলার কম। গত অর্থবছরের একই সময়ে ভোগ্যপণ্যের এলসি খোলা হয়েছিল ৪৭৯ কোটি ডলারের। ডিসেম্বরে নতুন এলসি খোলা কমে ৫০০ কোটি ডলারের নিচে (অর্থাৎ ৪৯২ কোটি ডলার) নেমেছে, যা গত ৬ মাসের মধ্যে সর্বনিম্নে। ২০২২ সালের মার্চে সর্বোচ্চ ৯৫১ কোটি ডলারের পণ্য আমদানির এলসি খোলা হয়েছিল। এরপর থেকে এলসি খোলা কমেছে। তবে এবার নিয়ে ৩ মাসে ৫০০ কোটি ডলারের নিচে এলসি হয়েছিল।

গত বছরের শুরুতে ডলারের সংস্থান ছাড়া এলসি খোলা বন্ধ করে দেয়া হয়, যা এখনো অব্যাহত রয়েছে। এলসি কমায় আমদানিও কম হচ্ছে। আর আমদানি কমায় পণ্য সরবরাহে সংকট দেখা দিয়েছে। তবে আমদানি নিয়ন্ত্রণ করে রিজার্ভ সাশ্রয় করা সম্ভব হয়েছে। কিন্তু তারপরও রিজার্ভ কমছে। ২০২১ সালের আগস্টে গ্রস রিজার্ভ সর্বোচ্চ ৪ হাজার ৮০৬ কোটি ডলারে ওঠেছিল। এখন তা কমে ২ হাজার ৫৩৩ কোটি ডলারে নেমেছে। তবে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) বিপিএম-৬ ম্যানুয়াল অনুযায়ী, দেশে রিজার্ভ এখন ২ হাজার ১৯ কোটি ডলার।

সূত্রমতে, ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণ করলে বিশ্বব্যাপী প্রায় সব ধরনের পণ্যের দাম বেড়ে যায়। এতে দেশের আমদানি ব্যয়ও বৃদ্ধি পায়। আমদানি মাত্রাতিরিক্ত বাড়ায়ও রপ্তানি আয় এবং রেমিট্যান্স কমায় ডলারের প্রবাহ কমে যায়। এতে রিজার্ভ কমতে থাকে। আর রিজার্ভের ওপর চাপ কমাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক আমদানিতে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে। প্রথমে অত্যাবশ্যকীয় পণ্য ছাড়া বাকি সব পণ্য আমদানিতে ২৫ শতাংশ মার্জিন আরোপ করে। এতেও আমদানি নিয়ন্ত্রণে না এলে তা বাড়িয়ে শতভাগ মার্জিন আরোপ করা হয়। এতে আমদানির এলসি কমলেও ডলার সংকটের কারণে ব্যাংকগুলো অত্যাবশ্যকীয় পণ্য আমদানির এলসি খোলা বন্ধ করে দেয়।

দেশে উৎপাদিত লাল চিনির কেজিতে খুচরা পর্যায়ে দাম সর্বোচ্চ ২৫ টাকা বাড়ানোর ঘোষণা দিয়েছিল বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশন। তবে এ ঘোষণার প্রায় ৬ ঘণ্টা পর শিল্প মন্ত্রণালয়ের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বর্ধিত এ দাম প্রত্যাহার করা হয়। ফলে আগের মতোই দেশি খোলা চিনির কেজি ১৩২ এবং প্যাকেটজাত চিনির কেজি ১৪০ টাকায় মিলবে।

রাজধানীর কয়েকটি খুচরা বাজারে গিয়ে দেখা গেছে, খুচরায় আমদানি করা খোলা চিনির কেজি ১৪০ থেকে ১৪৫ এবং প্যাকেট চিনির কেজি ১৪৮ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। দুই-তিন মাস ধরে এ দরেই বিক্রি হচ্ছে চিনি।

মৌলভীবাজার ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক গোলাম মাওলা বলেন, ভারতে ৪০ টাকায় চিনির কেজি বিক্রি হয়। অথচ বাংলাদেশে কেজিতে ৪৩ টাকা শুল্ক দিতে হয়। শুল্ক কমানোর পর মাত্র ৫০ পয়সা কমেছে।

এদিকে গত বৃহস্পতিবার রাজধানীর এক অনুষ্ঠানে ব্যবসায়ীরা আসন্ন রমজানে চিনি ও খেজুরের স্বাভাবিক সরবরাহ পাওয়া নিয়ে আশঙ্কার কথা জানিয়েছেন।

জবাবে বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম টিটু বলেছেন, রোজার সময় কিছু পণ্যের চাহিদা বেড়ে যায়। তখন অনেকেই সরবরাহ কমিয়ে দাম বাড়ানোর সুযোগ নেন। প্রতিমন্ত্রী অন্তত রমজানে সব পণ্যের যৌক্তিক দাম রাখার আহ্বান জানান।

ফল আমদানিকারক সমিতির সভাপতি সিরাজুল ইসলাম বলেন, খেজুরে কখনোই এত বেশি শুল্ক ছিল না। গত অর্থবছর থেকে খেজুরকে বিলাসী পণ্য হিসেবে মূল্যায়ন করা হচ্ছে। বর্তমানে ১২০ টাকার খেজুরে শুল্ক দিতে হচ্ছে ২০৮ টাকা। তাছাড়া গত বছর ডলারের রেট ছিল ১০০ টাকার কিছু বেশি। এখন ডলারের দর ১২০ টাকার বেশি।

বর্তমানে বিশ্ববাজারেও ভোজ্য তেলের দর কমেছে। সরকারও শুল্ক হার কমিয়েছে। ফলে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ভোজ্য তেলের দাম লিটারে ১০ টাকা কমিয়েছে। নতুন দর ১লা মার্চ থেকে কার্যকর হবে বলে ঘোষণা দেয়া হয়। তবে বাজারে এর কোনো প্রভাব নেই। অথচ দাম বাড়ানোর ঘোষণা দেয়ার আগে আমদানিকারক ও বাজারজাতকারীরা কৌশলে বাজারে তেলের সরবরাহ কমিয়ে দেন। তাতে সরবরাহ কমে যায়। ফলে আমদানিকারকরা দাম বাড়ানোর ঘোষণা দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে খুচরা বাজারে ভোজ্য তেলের দর বেড়ে যায়। বাজারে আগের মতোই প্রতি লিটার বোতলজাত সয়াবিন তেল ১৭৩ ও খোলা সয়াবিন ১৫৯ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।

কয়েক দফায় মূল্যবৃদ্ধির পরও এখনো বেড়েই চলছে পিয়াজের ঝাঁঝ। কোনো দেশ রপ্তানিতে শুল্ক আরোপ কিংবা রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা দিলে তৎক্ষণাত দেশের বাজারে দাম বাড়িয়ে দেন ব্যবসায়ীরা। পরে সেসব দেশ শুল্ক কমালে কিংবা রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করলেও বাজারে তার প্রভাব পড়তে দেখা যায় না। গত সোমবার বাংলাদেশসহ ৬টি দেশে ভারত জিটুজি পদ্ধতিতে পিয়াজ রপ্তানির অনুমতি দিলেও বাজারে এর কোনো প্রভাব পড়েনি। প্রতি কেজি দেশি পিয়াজ বিক্রি হচ্ছে ১১০ থেকে ১২০ টাকা দরে।

কাওরান বাজারের পিয়াজ ব্যবসায়ী আলতাফ বলেন, পাইকারিতে প্রতি কেজি পিয়াজ বিক্রি হচ্ছে ১১০-১১২ টাকায়। তবে খুচরা বাজার ঘুরে দেখা গেছে, গত সপ্তাহে পিয়াজ ১১০ টাকা কেজিতে বিক্রি হলেও এখন সেই পিয়াজ ১২০ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ জানিয়েছেন, ভারত থেকে ৫০ হাজার টন পিয়াজ দেশে আসছে। রোজার আগেই কিছু পিয়াজ বাজারে ঢুকবে।
বাজার ডালের দাম বেশ চড়া দেখা গেছে। প্রতিকেজি ছোলা ১১০ থেকে ১১৫, ছোলার ডাল ১১৫ থেকে ১২০, খেসারি ১২০ থেকে ১২৫, অ্যাংকর ৭৫ থেকে ৮০, আমদানি করা মসুর ডাল ১০৫ থেকে ১১০ এবং দেশি মসুর ডাল ১৩৫ থেকে ১৪০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্য বলছে, গত এক মাসের তুলনায় প্রায় ২০ ধরনের পণ্যের দাম বেড়ে গেছে। গত মাসে এই সময়ে বাজারে প্রতি কেজি ছোলার দাম ছিল ৯৫ থেকে ১১০ টাকা। সেই হিসাবে এক মাসে ছোলার দাম বেড়েছে ১৬ শতাংশ। চিনির দাম ১৪০-১৪৫ টাকা থেকে বেড়ে এখন ১৪৫-১৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। সাধারণ মানের খেজুর প্রতি কেজি ২৫০-৪৫০ টাকা থেকে বেড়ে এখন ২৫০ থেকে ৮৫০ টাকা বিক্রি হচ্ছে। পিয়াজ প্রতি কেজি ৭০-৯০ টাকা থেকে বেড়ে এখন ১১৫-১২৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

খোলা সাদা আটা ৪৫-৫০ টাকা থেকে বেড়ে ৫০-৫৫ টাকা কেজি বিক্রি হচ্ছে। এক সপ্তাহ আগে প্রতি কেজি ব্রয়লার মুরগির দাম ছিল ১৯০-২০০ টাকা। শুক্রবার রাজধানীর কাওরান বাজারে প্রতি কেজি ব্রয়লার বিক্রি করতে দেখা যায় ২০০ থেকে ২১০ টাকায়। মগবাজারে বিক্রি হচ্ছে ২২০ টাকা কেজিতে।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাবে রোজায় বাজার স্বাভাবিক রাখতে চলতি জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত ৭ লাখ টন ভোজ্য তেল, ৬ লাখ টন চিনি, ২ লাখ টন মসুর ডাল, ৬ লাখ টন পিয়াজ, ১ লাখ টন ছোলা ও ৭৫ হাজার টন খেজুর আমদানি করতে হবে। শুধু রোজার এক মাসের জন্য প্রয়োজন হয় ভোজ্য তেল ৩ লাখ, চিনি ৩ লাখ, পিয়াজ ৪ লাখ, মসুর ডাল ১ লাখ, ছোলা ১ লাখ এবং খেজুর ৫০ হাজার টন।

https://mzamin.com/news.php?news=99320