২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, মঙ্গলবার, ৭:১১

বিদেশী কোম্পানির গ্যাসনির্ভরতা বাড়ছে

আইওসির দখলে ৬৩ ভাগ : ৩ গুণ দামে কেনায় চাপ বাড়ছে অর্থনীতিতে

দেশে ক্রমবর্ধমান চাহিদার বিপরীতে গ্যাস উৎপাদনে ক্রমান্বয়ে পিছিয়ে পড়ছে দেশীয় কোম্পানিগুলো। গত আড়াই দশকে বিদ্যমান গ্যাস উৎপাদনের ৬৩ ভাগ চলে গেছে বিদেশী কোম্পানিগুলোর দখলে। আর দেশীয় কোম্পানিগুলো উৎপাদন করছে ৩৭ শতাংশ। অথচ ১৯৯৮ সালের আগ পর্যন্ত শতভাগ উৎপাদন করত দেশীয় কোম্পানি। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, চাহিদার সাথে তাল মিলিয়ে দেশীয় কোম্পানিগুলোর গ্যাস উৎপাদনসক্ষমতা বাড়ছে না বরং দিন দিন কমে যাচ্ছে। যে হারে নতুন গ্যাস উৎপাদনে কূপ খনন করার কথা ছিল ওই হারে হচ্ছে না। ফলে বর্ধিত চাহিদা মেটাতে গ্যাস উৎপাদনে বিদেশী কোম্পানিগুলোর ওপর নির্ভরশীলতা বাড়ার পাশাপাশি বাড়ছে উচ্চমূল্যের তরলিকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানি। বিদেশী কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে প্রায় তিন গুণ বেশি দামে গ্যাস কিনতে হচ্ছে। এতে বাড়তি ব্যয় সামলাতে চাপ বাড়ছে জাতীয় অর্থনীতিতে।

জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ড. বদরুল ইমাম গতকাল নয়া দিগন্তকে জানিয়েছেন, দেশীয় কোম্পানিগুলোর নিজস্ব সক্ষমতা বাড়াতে যে পরিমাণ নজর দেয়া প্রয়োজন ছিল তা দেয়া হয়নি। বরং রহস্যজনক কারণে যে গ্যাস উন্নয়ন তহবিল করা হয়েছিল তা দেশীয় কোম্পানিগুলোর সক্ষমতা বাড়াতে বরাদ্দ দেয়া হচ্ছে না। এ অর্থ দিয়ে এখন এলএনজি আমদানি করা হচ্ছে। তিনি বলেন, দেশীয় কোম্পানিগুলোর বর্তমান এ অবস্থা একদিনে হয়নি। বিগত দিনে এ খাতে যে পরিমাণ নজর দেয়া প্রয়োজন ছিল তা দেয়া হয়নি। আমাদের প্রতিবেশী দেশে তাদের রাষ্ট্রীয় কোম্পানিগুলোর জনবলকে আলাদা বেতন স্কেলে বেতন দেয়া হয়। কিন্তু আমাদের রাষ্ট্রীয় কোম্পানিগুলোর ভূতত্ত্ব ইঞ্জিনিয়ারদের বেতনভাতা দেয়া হয় জাতীয় স্কেলে। রাষ্ট্রীয় কোম্পানিগুলোর লোকবল থেকে শুরু করে সবক্ষেত্রেই কেন যেন এক প্রকার অবহেলা করা হয়েছে। আর এ কারণে গ্যাস উৎপাদনে বিদেশী কোম্পানিগুলোর ওপর নির্ভরতা বেড়ে গেছে। তার মতে, দেশীয় কোম্পানিগুলোর সক্ষমতা বাড়াতে প্রায়োজনীয় উদ্যোগ নিতে হবে। গ্যাস উন্নয়ন তহবিল থেকে বরাদ্দ দিতে হবে। এতেই দেশীয় কোম্পানিগুলোর সক্ষমতা বাড়বে। অন্যথায় বিদেশী কোম্পানিগুলোর ওপর যে হারে নির্ভরশীলতা বাড়ছে তাতে জ্বালানি নিরাপত্তাই হুমকির মুখে পড়বে বলে তিনি মনে করেন।

সংশ্লিষ্টরা জানান, দেশের ক্রমবর্ধমান চাহিদা পূরণে দেশীয় কোম্পানিগুলোর যে হারে সক্ষমতা বাড়ানোর কথা ছিল তা করা হচ্ছে না। নতুন নতুন কূপ খননে পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ করা হচ্ছে না। বলা যায়, অর্থসঙ্কটে দেশীয় কোম্পানিগুলো তাদের গ্যাস উৎপাদনে সক্ষমতা বাড়াতে পারছে না। অথচ দেশীয় কোম্পানিগুলোর সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য গ্যাস উন্নয়ন তহবিলের নামে একটি তহবিল গঠন করা হয়েছিল। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, গ্যাস খাতের মহাপরিকল্পনা অনুযায়ী, প্রতি বছরই এলএনজির আমদানি বাড়ানোর লক্ষ্য রয়েছে। অন্য দিকে বিশ্ববাজারে আমদানিনির্ভর এ পণ্যটির দাম ঊর্ধ্বমুখী। এতে এলএনজি আমদানিতে ব্যয়ও বাড়ছে। পাশাপাশি বাড়ছে ভর্তুকির পরিমাণ।

এ দিকে গ্যাস উৎপাদনে পেট্রোবাংলার এক পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ১৯৯৮ সালের আগ পর্যন্ত চাহিদার পুরো গ্যাস উৎপাদন করত জাতীয় তিন কোম্পানি। কিন্তু ১৯৯৮ সালে যুক্তরাজ্যভিত্তিক কোম্পানি কেয়ার্ন এনার্জির মাধ্যমে গ্যাস সরবরাহে বিদেশী কোম্পানির কার্যক্রম শুরু হয়। ওই বছর সমুদ্র্রবক্ষে আবিষ্কৃত সাঙ্গু গ্যাসক্ষেত্র থেকে উৎপাদন শুরু করে কোম্পানিটি। ২০০৪ সালে গ্যাস উৎপাদনে ৭৬ শতাংশ অবদান ছিল দেশীয় কোম্পানিগুলোর। তখন ২৪ শতাংশ গ্যাস উৎপাদন করত বিদেশী কোম্পানি। আড়াই দশকের ব্যবধানে গ্যাস উৎপাদনে দেশীয় কোম্পানিগুলোর অবদান ৩৭ শতাংশে নেমে এসেছে।

পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করলে আরো দেখা যায়, ২০১১-১২ অর্থবছরে দেশে তিনটি বিদেশী কোম্পানি গ্যাস উত্তোলন করত। এর মধ্যে যুক্তরাজ্যভিত্তিক কোম্পানি কেয়ার্ন সাঙ্গু গ্যাসক্ষেত্র থেকে, যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক কোম্পানি শেভরন জালালাবাদ, মৌলভীবাজার ও বিবিয়ানা গ্যাসক্ষেত্র থেকে এবং যুক্তরাজ্যভিত্তিক কোম্পানি তাল্লো বাংগোরা থেকে গ্যাস উত্তোলন করত। ওই অর্থবছরে উৎপাদিত গ্যাসের ৫২ শতাংশ উৎপাদন করে এ তিনটি বিদেশী কোম্পানি। কিন্তু অতিরিক্ত গ্যাস উত্তোলন করায় ২০১৪-১৫ অর্থবছর থেকে সাঙ্গু গ্যাসক্ষেত্রে গ্যাস উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়। ওই বছর থেকে দু’টি বিদেশী কোম্পানি গ্যাস উত্তোলন করছে। এর মধ্যে বেশির ভাগ করছে শেভরন।
এ বিষয়ে পেট্রোবাংলার একটি দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে, দেশীয় কোম্পানিগুলোর উৎপাদন কমে যাওয়ায় বাড়তি চাহিদা মেটাতে বিদেশী কোম্পানিগুলোকে অতিরিক্ত গ্যাস উৎপাদন করতে বলা হচ্ছে। যেখানে উৎপাদনক্ষমতার ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ উৎপাদন করার কথা, সেখানে কোনো কোনো গ্যাসক্ষেত্র থেকে উৎপাদন করা হচ্ছে প্রায় শতভাগ। এর ফলে এক দিকে বিদেশী কোম্পানিগুলো স্বল্পসময়ে বাড়তি উৎপাদন করে অতিরিক্ত অর্থ তুলে নিচ্ছে, অন্য দিকে গ্যাসের মজুদও দ্রুত ফুরিয়ে আসছে, যা আমাদের জন্য হুমকি।
পেট্রোবাংলার সর্বশেষ পরিসংখ্যান মতে, চলতি অর্থবছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৫৪৯ কোটি ৩৩ লাখ ৫৯ হাজার ঘনফুট গ্যাস উৎপাদন হয়। এর মধ্যে দেশীয় কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে কেনা হয় ২১০ কোটি ৩৫ লাখ ঘনফুট। আর বিদেশী কোম্পানিগুলো গ্যাস উৎপাদন করে প্রায় ৩৩৯ কোটি ঘনফুট। এতে দেখা যায় বিদেশী কোম্পানিগুলোর গ্যাস উৎপাদন করে ৬২ শতাংশ। তেমিনভাবে ২০২২-২৩ অর্থবছরে বেদেশী কোম্পানিগুলো গ্যাস উৎপাদন করে ৬৩ শতাংশ।

এ দিকে বিদেশী কোম্পানিগুলোর ওপর নির্ভরশীলতা বাড়ার পাশাপাশি ব্যয়ও বাড়ছে বেশি হারে। যেমন, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বিদেশী কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে ৫৬৯ কোটি ৭২ লাখ ঘনফুট গ্যাস কিনতে পেট্রোবাংলার ব্যয় হয় চার হাজার ৪৩৮ কোটি ২১ লাখ টাকা। এতে দেখা যায়, প্রতি কোটি ঘনফুটের জন্য ব্যয় হয়েছে সাত কোটি ৭৯ লাখ টাকা। যেখানে দেশীয় কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে ১১৮ কোটি ৯৫ লাখ ঘনফুট গ্যাস কিনতে ব্যয় হয়েছে ৪০ কোটি ২৯ লাখ টাকা। প্রতি কোটি ঘনফুটের জন্য ব্যয় হয়েছে প্রায় ৩৪ লাখ টাকা।
আবার ২০০২২-২৩ অর্থবছরের বিদেশী কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে ৫৭২ কোটি ৪৪ লাখ ঘনফুট গ্যাস কিনতে ব্যয় হয়েছে পাঁচ হাজার ৭৬৭ কোটি ৩২ লাখ টাকা। প্রতি কোটি ঘনফুট গ্যাস কিনতে ব্যয় হয়েছে ১০ কোটি সাত লাখ টাকা। অপর দিকে একই বছরে দেশীয় কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে ১৩২ কোটি ৩৭ লাখ ঘনফুট গ্যাস কিনতে ব্যয় হয়েছে ৫২০ কোটি ৭৬ লাখ টাকা। প্রতি কোটি ঘনফুট গ্যাস কিনতে ব্যয় হয় তিন কোটি ৯৬ লাখ টাকা।

এ দিকে বিদেশী কোম্পানিগুলোর নির্ভরশীলতা বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি উচ্চ দরে এলএনজি আমদানিতেও ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে। এক দিকে গ্যাসের মজুদ কমে আসায় আমদানিনির্ভরতা বাড়ছে। বর্তমানে এলএনজির বাজারে ঊর্ধ্বমুখিতা লাগামহীন হয়ে উঠছে। ফলে বাড়ছে ভর্তুকি।

প্রসঙ্গত, প্রাকৃতিক গ্যাসের সঙ্কট বিবেচনায় ২০১৮ সালের ২৫ এপ্রিল এলএনজি আমদানি শুরু করে সরকার। সামিট এলএনজি ও যুক্তরাষ্ট্রের এক্সেলারেট এনার্জির ভাসমান টার্মিনালের (এফএসআরইউ) মাধ্যমে আমদানিকৃত এলএনজি সরবরাহ করা হচ্ছে।

https://www.dailynayadiganta.com/first-page/817104