২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, শনিবার, ১১:৫২

কিশোরগ্যাং ও ‘বড় ভাইদের’ ধরতে সাঁড়াশি অভিযানে র‌্যাব-পুলিশ

ভয়ঙ্কর অপরাধে জড়িয়ে পড়া কিশোর গ্যাং ধরতে এবার সাঁড়াসি অভিযানে নেমেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। বিশেষ করে র‌্যাপিড আ্যাকশন ব্যাটালিয়ান (র‌্যাব) রাজধানীসহ সারাদেশে কিশোর গ্যাংয়ের বিরুদ্ধে আ্যাকশন শুরু করেছে। পাশাপাশি সাদা পেশাকে ডিবি ও পুলিশ পৃথকভাবে অভিযান চালাচ্ছে। এক সপ্তাহে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে দুই শতাধিক কিশোর গ্যাং সদস্য গ্রেফতার হয়েছে। র‌্যাব ও ডিবি জানিয়েছে তাদের এ অভিযান চলবে। খোঁজা হচ্ছে এদের মদতদাতা ‘বড় ভাইদের’ও।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সূত্রে জানা গেছে, কেউ গাড়ির হেলপার-ড্রাইভার, কেউ দোকানের কর্মচারী, নির্মাণ শ্রমিক, কেউবা পুরাতন মালামাল ক্রেতা কিংবা রাজমিস্ত্রী। আছে সবজি বিক্রেতাও। তবে ভিন্ন পেশা হলেও সন্ধ্যা নামতেই বদলে যায় তাদের পেশা-পরিচয়। বেরিয়ে আসে ভয়ঙ্কর রূপ। ভিন্ন ভিন্ন পেশার আড়ালে রাজধানী ও তার আশপাশের এলাকায় তারা ডাকাতি, ছিনতাই ও চাঁদাবাজিতে জড়িত। প্রত্যেকের নামে রয়েছে একাধিক মামলা। কেউ কেউ জেল খেটেছেন। বেরিয়ে আবারো জড়িয়েছেন গ্যাং কালচারে। টাকার বিনিময়ে মারামারি-দখলবাজি-ছিনতাই-ডাকাতি করে তারা।

র‌্যাব জানিয়েছে, বর্তমান সময়ে কিশোর গ্যাং, গ্যাং কালচার, উঠতি বয়সী ছেলেদের মধ্যে ক্ষমতা বিস্তারকে কেন্দ্র করে এক গ্রুপের সঙ্গে অন্য গ্রুপের মারামারি করা বহুল আলোচিত ঘটনা। গ্যাং সদস্যরা এলাকায় নিজেদের অস্তিত্ব জানান দিতে উচ্চ শব্দে গান বাজিয়ে দল বেধে ঘুরে, বেপরোয়া গতিতে মোটরসাইকেল চালায়, পথচারীদের উত্ত্যক্ত করে এবং ছোটখাটো বিষয় নিয়ে সাধারণ মানুষের সঙ্গে মারামারি করে। এছাড়া তারা নিজেদের আধিপত্য বিস্তারে বিশৃঙ্খলায় কেউ প্রতিবাদ করলে খুন করতেও দ্বিধাবোধ করে না।
একটি গোয়েন্দা সংস্থার সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কিশোর গ্যাং সবচেয়ে বেশি সক্রিয় ঢাকায়। পুলিশ ও র‌্যাবের কর্মকর্তারা বলছেন, এসব অপরাধীচক্রের নেতা বা সদস্যদের বড় অংশ পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন। বেশির ভাগ থাকে বস্তি এলাকায়। তবে সঙ্গদোষে অনেক স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীও এসব চক্রে জড়িয়ে পড়ে। ডিএমপির আটটি অপরাধ বিভাগের মধ্যে সবচেয়ে বেশি কিশোর গ্যাং মিরপুর বিভাগে। এই বিভাগে ১৩টি কিশোর অপরাধীচক্রের ১৭২ জন সক্রিয় বলে পুলিশের তালিকায় উল্লেখ রয়েছে। রাজধানীর মোহাম্মদপুর, তেজগাঁও, উত্তরা, টঙ্গী, ও কেরানীগঞ্জে কিশোর গ্যাং তৎপর বেশি। র‌্যাবের পক্ষ থেকে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের গ্রেপ্তারের একটি তালিকা করা হয়েছে। ওই তালিকার তথ্য অনুযায়ী, গত বছরে র‌্যাবের অভিযানে ৩৪৯ জন কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব। র‌্যাব জানায়, ২০১৭ সাল থেকে গত বছর পর্যন্ত এক হাজার ১২৬ জন কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে র‌্যাব। এর ভেতর মোট ৪০ জনের মধ্যে ৩০ জনকে অর্থদ- ও ১০ জনকে মুচলেকা দিয়ে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়।
বৃহস্পতিবার রাতে রাজধানীর বনানী, মহাখালী, উত্তরা ও টঙ্গী এলাকায় অভিযান চালিয়ে জিরোজিরো গ্রুপ, বাবা গ্রুপ, জাউরা গ্রুপ, ডি কোম্পানি ও জাহাঙ্গীর গ্রুপসহ বিভিন্ন কিশোর গ্যাংয়ের ৩৮ জন সদস্যকে গ্রেফতার করে র র‌্যাব। র‌্যাব জানায়, টাকার বিনিময়ে মারামারি, দখলবাজি, ছিনতাই, ডাকাতিসহ বিভিন্ন অপরাধে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছে তারা। এ ব্যাপারে গতকাল শুকবার দুপুরে রাজধানীর উত্তরায় র‌্যাব-১ এর কার্যালয়ে সাংবাদিক সম্মেলন করে র‌্যাব-১ জানায়, রাজধানীর মহাখালী, বনানী, বিমানবন্দর, টঙ্গী ও গাজীপুর এলাকায় একাধিক অভিযানে কিশোর গ্যাং গ্রুপ ‘০০৭ গ্রুপের দলনেতা আল-আমিন, জাউরা গ্রুপের দলনেতা মাহাবুব, বাবা গ্রুপের দলনেতা সাদ, হাই ভোল্টেজ গ্রুপের মনা, ডি কোম্পানির দলনেতা পাপ্পু ওরফে লন্ডন পাপ্পু ও তার অন্যতম দুই সহযোগী আকাশ ও আমির হোসেন, জাহাঙ্গীর গ্রুপের দলনেতা বয়রা জাহাঙ্গীরসহ ৩৮ জন সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়। এ সময় তাদের কাছ থেকে ৫০০ গ্রাম গাঁজা, ২৪টি মোবাইল, একটি কুড়াল, একটি পাওয়ার ব্যাংক, পাঁচটি রড, ১৬টি চাকু, তিনটি লোহার চেইন, একটি হাতুড়ি, একটি উচ্চ শব্দ সৃষ্টি করা মোটরসাইকেল, একটি ব্লেড এবং নগদ ২৪ হাজার ২৫০ টাকা উদ্ধার করা হয়। র‌্যাব-১ অধিনায়ক মোস্তাক আহমেদ বলেন, প্রতিটি গ্রুপের আনুমানিক সদস্য ১০ থেকে ১৫ জন। তারা টাকার বিনিময়ে মারামারি, দখলবাজি, ছিনতাই, ডাকাতিসহ বিভিন্ন অপরাধে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছে।

গ্রেফতারদের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে প্রাপ্ত তথ্যের বরাত দিয়ে তিনি বলেন, গ্রেফতারদের মধ্যে ১৭ জনের বিরুদ্ধে বিভিন্ন থানায় চুরি, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, মাদক, অস্ত্র, ধর্ষণ ও হত্যাচেষ্টাসহ একাধিক মামলা রয়েছে। কিশোর গ্যাংয়ের মদদদাতা কারা, তাদের আইনের আওতায় আনা হবে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, আপনারা জানেন কিশোর গ্যাংয়ের কয়েকটি গ্রুপের দলনেতা গ্রেফতার করা হয়েছে। এলাকায় আধিপত্য বিস্তারে কিছু ব্যক্তি এসব গ্রুপের সদস্যদের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে। তিনি আরও বলেন, কিশোর গ্যাং গ্রুপের সদস্যরা মদদদাতাদের হয়ে মারামারি করে। অনেকেই এ গ্রুপের সদস্যদের মূলত হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে এমন তথ্য আমরা পেয়েছি। তাদের হয়ে কাজ করার কারণে অপরাধ করে শেল্টার পায়। যারা তাদের নানাভাবে মদদদাতা হিসেবে কাজ করছে তাদেরও আইনের আওতায় আনা হবে। র‌্যাব-১ এর অধিনায়ক জানান, গণমাধ্যম ও র‌্যাব সদরদপ্তরের নির্দেশনা অনুযায়ী বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত নিয়ে কিশোর গ্যাং সম্পর্কে আমরা অনুসন্ধান করছি। আগেও এভাবে অনেককে গ্রেফতার করা হয়েছে। র‌্যাব-১ এর দায়িত্বপূর্ণ এলাকায় আগে অনেকের নাম পেয়েছি। তাদের আইনের আওতায় আনা হয়েছে। এখন কিশোর গ্যাং নিয়ে নির্দেশনা পাওয়ার পরে গত ১৫ থেকে ২০ দিন ধরে কাজ করেছি। এসময়ে নতুন গ্রুপগুলোকে দলনেতাসহ সদস্যদের গ্রেফতার করা হয়েছে। তাদের কার্যক্রম, মামলাসহ তাদের বিষয় অনুসন্ধান চলছে। আমাদের অভিযান থেমে নেই। নতুন করে কোনো গ্রুপের তথ্য পেলে গ্রেফতার করা হবে। কিশোর গ্যাং গ্রুপের সদস্যরা ওয়ার্ড ও থানা পর্যায়ের নেতাদের ছত্রছায়ায় বিভিন্ন সময় রাজনৈতিক মিছিল মিটিংয়ে দেখা যায়। এসব মদদদাতাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হবে কি না জানতে চাইলে লে. কর্নেল মোস্তাক বলেন, আমি সুস্পষ্টভাবে বলতে চাই অপরাধীদের কোনো দল বা ঠিকানা থাকতে পারে না। তাদের কোনো পরিচয় বিষয় না। তারা কার হয়ে কাজ করে সেটিও বিবেচ্য বিষয় নয়। অপরাধ করলে তাদের আইনের আওতায় আনা হবে।

এর আগে গত মঙ্গলবার র‌্যাবের মহাপরিচালক এম খুরশীদ হোসেন জানান, মাদক ও কিশোর গ্যাংয়ের বিরুদ্ধে ‘অলআউট অ্যাকশনে’ যাবে র‌্যাব। এদিন র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈনের লেখা ‘মাদকের সাতসতেরো: বাংলাদেশের বাস্তবতা ও সমাধানসূত্র’ এবং ‘কিশোর গ্যাং: কীভাবে এলো, কীভাবে রুখব’ শীর্ষক দুটি বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করেন র‌্যাব ডিজি। কিশোর গ্যাং ও মাদক প্রতিরোধের বিষয়ে লেখা দুটি নিয়ে তিনি বলেন, আমি মনে করি এ ধরনের বই কিশোরদের কাছে পৌঁছে দেওয়া যেতে পারে। পাঠ্যবইয়ে মাদকের কুফল, কিশোর গ্যাং-এর কুফলের বিষয়গুলো তুলে ধরা হলে অপরাধ কমে যাবে। তিনি বলেন, আমরা যদি জাপানের দিকে দেখি, সেখানে শিশুদের প্রথম দুই বছর কোনও পাঠ্য বইয়ের শিক্ষা পড়ানো হয় না। তাদেরকে সেখানে শিখানো হয় ম্যানার (আচার-আচরণ)। দুই বছর পর তাদের পাঠ্য বইয়ে পড়াগুলোকে শেখানো হয়। যদি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে গিয়ে মাদকের কুফল কিশোর গ্যাং-এর কুফল নিয়ে আলোচনা করা হয়, বা ক্লাস নেওয়া হয়, তাহলে যথেষ্ট সাড়া পাওয়া যাবে। অতীতেও আমি এ বিষয়গুলো দেখেছি। তাই সর্বোপরি সবাই সব জায়গা থেকে মাদক এবং কিশোর গ্যাং-এর বিরুদ্ধে জনসচেতনতা তৈরি করতে হবে।

https://www.dailysangram.info/post/549664