১৫ মে ২০১৭, সোমবার, ৩:৪৩

প্রবৃদ্ধি নিয়ে বিতর্কে সরকার ও বিশ্বব্যাংক

সরকার বলছে ৭.২৪ %; বিশ্বব্যাংক বলছে ৬.৮ %

চলতি ২০১৬-১৭ অর্থবছর দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধির অর্জিত হার নিয়ে সরকার ও বিশ্বব্যাংকের মধ্যে নতুন করে বিতর্ক দেখা দিয়েছে। সরকার ঘোষণা দিয়েছে এবার তাদের অর্জন ৭ দশমিক ২৪ শতাংশ। আগামী অর্থবছর সরকার প্রাক্কলন করেছে ৭.৪ শতাংশ। আর বিশ্বব্যাংক বলছে, এ বছর ৬.৮ শতাংশ বৃদ্ধি হবে। কারণ রেমিট্যান্স প্রবাহে নি¤œমুখিতা, রফতানি প্রবৃদ্ধিতে ধীরগতি এবং আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা আশঙ্কা রয়েছে। বিশ্বব্যাংক তার প্রাক্কলনেই অটল রয়েছে। আগামী (২০১৭-১৮) অর্থবছরে এটি কমে দাঁড়াবে ৬.৪ শতাংশে। পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল সাংবাদিকদের বলেন, সরকারের এ প্রাক্কলনে কোনো ইঞ্জিনিয়ারিং করা হয়নি। ম্যাথোডলজি পরিবর্তন করা হয়নি। বিশ্বব্যাংক সারা পৃথিবীর প্রাক্কলন সব সময় কম করে থাকে। আমরা যখন অর্জন করি তখন তারা তা আবার মেনে নেয়।
আগারগাঁওয়ের বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসে বাংলাদেশের ডেভেলপমেন্ট আপডেট প্রকাশ করে গতকাল এ পূর্বাভাস ও চ্যালেঞ্জগুলো তুলে ধরে আন্তর্জাতিক এ দাতা সংস্থাটি। আপডেটটি তুলে ধরেন সংস্থার ঢাকার মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন। বক্তব্য রাখেন কান্ট্রি ডিরেক্টর চিমিয়াও ফান, সিনিয়র পরিচালক কার্লোস ফিলিপে হ্যারমিলো, প্র্যাকটিস ম্যানেজার ম্যানুয়েলা ও যোগাযোগ কর্মকর্তা মেহেরিন এ মাহবুব।
এ দিকে সকালে প্রধানমন্ত্রীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের (এনইসি) বৈঠকে পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল জানান, চলতি অর্থবছরের প্রথম দশ মাসের (জুলাই-এপ্রিল) তথ্য বিশ্লেষণ করে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো মাথাপিছু আয় ও প্রবৃদ্ধির এ হিসাব করেছে। বৈঠক শুরুর আগে এসব তথ্য তুলে ধরা হলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সাংবাদিকদের বলেন, এটা সম্মিলিত প্রচেষ্টার ফল। সরকারের ধারাবাহিকতার কারণে এ ফসল অর্জিত হয়েছে।
সরকার বলছে
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) চূড়ান্ত হিসাবে গত ২০১৫-১৬ অর্থবছর জিডিপি প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৭ দশমিক ১১ শতাংশ। আর বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু আয় ছিল ১ হাজার ৪৬৫ ডলার। প্রায় এক দশক ৬ শতাংশের বৃত্তে ‘আটকে’ থাকার পর ২০১৫-১৬ অর্থবছরে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ৭ শতাংশের ঘর অতিক্রম করে। এরপর গত জুনে ২০১৬-১৭ অর্থবছরের বাজেটে ৭ দশমিক ২ শতাংশ প্রবৃদ্ধির ল্যমাত্রা ঠিক করা হয়।
পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ এখনো তেমন একটা বাড়েনি। কারণ হলো আমরা এখনো অবকাঠামোগত ও বিদ্যুৎ সুবিধা বাড়াতে পারিনি। আশা করছি, আগামীতে তাদের সেসব সুবিধা আমরা পূরণ করতে পারব।
বিশ্বব্যাংকের প্রবৃদ্ধির হারের ব্যাপারে তিনি বলেন, বিশ্বব্যাংক আমাদের প্রতি এবার অনেক বিনয়ী। তারা কোনো সময়ই ৬.৬ শতাংশের বেশি বলেনি। এ প্রথমবার তারা বলেছে, প্রবৃদ্ধি হবে ৬.৮ শতাংশ। তারা বছরে চার বার এ প্রাক্কলন করে। যেখানে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) প্রাক্কলন ছিল ৬.৯ শতাংশ। তিনি বলেন, তারা কিছু তথ্য দেশ থেকে নেয়। আর কিছু তথ্য বাইরে থেকে আনে।
বিশ্বব্যাংকের প্রাক্কলন
বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন তুলে ধরে ড. জাহিদ বলেন, সার্বিকভাবে বাংলাদেশের অর্থনীতির পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করতে গিয়ে আমি বলতে চাই, অর্থনীতির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ তার ধারাবাহিকতা ধরে রেখেছে। তবে রফতানি আয় ও রেমিট্যান্সে প্রতিকূল হাওয়া বইছে। তিনি জানান, শুধু যদি আমরা পতন বা কমে যাওয়াটা যোগ করি তাহলে তার মধ্যে ৫৫ শতাংশ জিসিসি দেশগুলো থেকে আসা কমেছে। বাকিগুলো জিসিসিবহির্ভূত দেশগুলো থেকে। এ ছাড়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে যে পরিমাণ রেমিট্যান্স কমেছে, তা সৌদি আরব থেকে যে পরিমাণ কমেছে তার চেয়ে বেশি। কাজেই শুধু তেলের দাম কমানোর কারণেই যে রেমিট্যান্স প্রবাহ কমছে এ কথা এখন আর বলা যায় না। এর পেছনে আরো কারণ আছে। বিশ্বঅর্থনীতিতে অভিবাসন নিয়ে পশ্চিমা দেশগুলোর কী নীতি হবে তা নিয়ে যে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে তা রেমিট্যান্স পাঠানো নিরুৎসাহিত করেছে। প্রতিবেদেন বলা হয়েছে, গত বছর আড়াই শতাংশের মতো কমলেও, চলতি অর্থবছর সেটি কমেছে ১৬ শতাংশের মতো। তা ছাড়া গত বছর মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে রেমিট্যান্স কমলেও চলতি অর্থবছর আমেরিকাসহ বিশ্বের অন্যান্য দেশ থেকেও রেমিট্যান্স কমেছে।
ড. জাহিদ বলেন, বাংলাদেশের অর্থনীতি তিন ঝুঁকিতে বাস করছে। এগুলো হচ্ছেÑ আর্থিক খাতে সুশাসনের অভাব, রাজস্ব সংস্কারের উদ্যোগ বাস্তবায়নে কার্যকর উদ্যোগের অভাব, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার আশঙ্কা। এ ছাড়া বহির্বিশ্বের েেত্র ঝুঁকিগুলো হচ্ছেÑ বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর বাণিজ্যনীতি জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির আশঙ্কা এবং আর্থিক বাজারে নানা সমস্যা। এসব ঝুঁকি মাথায় রেখেই আর্থিক পরিকল্পনা করতে হবে। তিনি বলেন, রফতানি খাতে প্রবৃদ্ধি স্থবির রয়েছে। অতীতেও এ প্রবৃদ্ধিতে উঠানামা দেখেছি। অন্য দিকে খাদ্য খাতে মূল্যস্ফীতি বাড়ছে। আগামীতে এটা আরো বাড়তে পারে। রিজার্ভে স্বত্বির পরিবেশ থাকলেও তুষ্টির কোনো কারণ নেই। অন্য দিকে ল্যমাত্রার চেয়ে কম হয়েছে রাজস্ব আদায়। ব্যাংকবহির্ভূত খাত থেকে সরকারের ঋণ গ্রহণের প্রবণতা বেশি। এ ছাড়া গত অর্থবছরের প্রথম দশ মাসে (জুলাই-এপ্রিল) যেখানে বাংলাদেশ রফতানিতে ৯ শতাংশ প্রবৃদ্ধি পেয়েছিল, এবার একই সময়ে প্রবৃদ্ধি হয়েছে মাত্র ৪ শতাংশ।
সংস্থাটি বলছে, উৎপাদনশীলতা বাড়াতে হলে মানবসম্পদ উন্নয়ন ও প্রতিযোগিতার সমতা বাড়াতে হবে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বেসরকারি বিনিয়োগ ধারাবাহিকভাবে কমছে। মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি বাড়লেও সে ক্ষেত্রে ওভার ইনভয়েসিং হচ্ছে কিনা সেটি দেখার বিষয়। কেননা বিনিয়োগ কোথায় গেছে তা দেখা যাচ্ছে না। এ ছাড়া সার্বিকভাবে মূল্যস্ফীতি স্থিতিশীল ও স্বস্তিদায়ক হলেও চালের দাম বাড়ায় খাদ্যমূল্যস্ফীতি বেড়েছে, যা কিছুটা অস্বস্তির সৃষ্টি করেছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তিনটি বিষয় উদ্যোগ নিলেও আগামী ১৫ বছরে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি ৩ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পেতে পারে। এগুলো হলোÑ শ্রমবাজারে নারীর অংশগ্রহণ ৪৫ শতাংশে উন্নীত করা। এতে ১ শতাংশ প্রবৃদ্ধি বাড়বে। দ্বিতীয়ত হচ্ছে, সরকারি বিনিয়োগে দতা বাড়ানো এবং অপচয় রোধ করা। এতেও ১ শতাংশ প্রবৃদ্ধি বাড়বে। তৃতীয়ত বিদ্যমান সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করে অর্থনৈতিক উৎপাদনশীলতা বাড়ানো। এতেও ১ শতাংশ প্রবৃদ্ধি বাড়ার সম্ভাবনা তৈরি করবে। প্রতিবেদনে শ্রমখাতে নারীর অংশগ্রহণ বাড়ানোর প্রতিবন্ধকতা হিসেবে তিনটি কারণের কথা বলা হয়েছে। এগুলো হলোÑ পারিবারিক দায়িত্বের আধিক্য, মানবসম্পদের দতার ঘাটতি, বিভিন্ন পেশা েেত্র উন্মুুক্ত বৈষম্য।
অনুষ্ঠানে চিমিয়াও ফান বলেন, বিশ্বের অন্যান্য দেশের জিডিপির চেয়ে রাজস্ব আদায়ের হার বাংলাদেশে কম। তবে নতুন ভ্যাট আইন বাস্তবায়ন হলে রাজস্ব আয় বাড়বে এবং রাজস্ব প্রশাসনের দতা, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা বৃদ্ধি পাবে। বিনিয়োগের ক্ষেত্রে কাঠামোগত সমস্যা রয়েই গেছে। সরকারি বিনিয়োগে আরো দক্ষতা বাড়াতে হবে।

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/220043