২০ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, মঙ্গলবার, ১১:০২

লিবিয়া গিয়ে বিপাকে ১৪২ বাংলাদেশী ডাক্তার-নার্স

দূতাবাস বলছে শিগগির সমস্যার সমাধান হবে

যুদ্ধবিধ্বস্ত লিবিয়ায় গিয়ে চরম দুর্ভোগে পড়েছেন প্রায় দেড়’শ বাংলাদেশী চিকিৎসক ও নার্স। লিবিয়ার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে চাকরি নিয়ে যাওয়ার পর থেকে তারা অদ্যাবধি কেউ বেতন পাননি বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। শুধু তাই নয়, তাদের অনেকের আবাসন সঙ্কটও প্রকট।

গত সপ্তাহে ঢাকা থেকে পরিচালিত একটি অনলাইন নিউজ পোর্টালে এ সংক্রান্ত বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। যদিও লিবিয়ার বাংলাদেশ দূতাবাসের কর্মকর্তারা এ প্রসঙ্গে বলেছেন, বিষয়টি নিয়ে তারা ‘কাজ করছেন’। শিগগিরই সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে বলে তারা আশা করছেন।

ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, লিবিয়া থেকে এক ভুক্তভোগী ই-মেইল বার্তায় অভিযোগ করেন। এরপর আরো কয়েকজনের সাথে যোগাযোগ করে অভিযোগের সত্যতা মেলে। তবে নিরাপত্তাজনিত কারণে প্রতিবেদনে ডাক্তার বা নার্সদের অনুরোধে কারো নাম প্রতিবেদনে প্রকাশ করা হয়নি।

যুদ্ধ ও পরবর্তী রাজনৈতিক অস্থিরতায় কয়েক বছর বন্ধ থাকার পর ২০২২ সালে লিবিয়ার শ্রমবাজার আবারো খুলে দেয়া হয়। অবকাঠামোসহ অন্যান্য খাত পুনর্গঠনে বিভিন্ন দেশ থেকে কর্মী নিচ্ছে দেশটি। বাংলাদেশী কর্মীদের চাহিদা রয়েছে সেখানে। লিবিয়ার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের জন্য কর্মী নিতে ২০২৩ সালের জানুয়ারি মাসে একটি প্রতিনিধি দল বাংলাদেশে আসে। চাকরিপ্রার্থীদের সাক্ষাৎকার শেষে ১৫৭ কর্মীকে বাছাই করে লিবিয়ার আলামাল আলিবিয়া কোম্পানি ফর মেডিক্যাল সার্ভিসেস। বাংলাদেশ সরকার থেকে অনুমোদন নিয়ে ঢাকার ইজ্জি সার্ভিসেস অ্যান্ড রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট লিমিটেড (ইএসআরএম) এবং মেসার্স আজুর বেঙ্গল লিমিটেড নামে দুটি কোম্পানির মাধ্যমে কর্মী নিয়োগ দেয় তারা। প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় ২০২৩ সালের ২০ জুন একটি চিঠিতে ৮৮ জনকে এবং ২২ জুন আরেকটি চিঠির মাধ্যমে ৬৯ জনের নিয়োগের অনুমতি দেয়। ১৫৭ জন চিকিৎসক, নার্স, ফিজিওথেরাপিষ্ট এবং মেডিক্যাল টেকনোলজিস্টের মধ্যে কয়েকটি গ্রুপে ১৪২ জন লিবিয়া যান। তাদের লিবিয়ায় বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালে নিয়োগ দেয়া হয়।

মন্ত্রণালয়ের নথি থেকে সংগ্রহ করা তথ্যর উদ্ধৃতি দিয়ে ওই প্রতিবেদনে জানানো হয়, লিবিয়ার এই চাকরিতে চিকিৎসকদের প্রতি মাসে সর্বোচ্চ ২২ শ ডলার এবং নার্সদের ৬৫০ থেকে ৯০০ ডলার বেতন দেয়ার কথা। একজন চিকিৎসক জানিয়েছেন, লিবিয়ায় আসার পর সাত মাস পার হলেও চুক্তি অনুযায়ী বেতন বা অন্যান্য সুযোগ সুবিধা তারা পাচ্ছেন না। হাসপাতাল থেকে খাবারের খরচের জন্য সামান্য কিছু টাকা দেয়া হয়। ‘হাসপাতাল যে টাকা দেয় তাতে এখানে দৈনন্দিন খরচ চালাতেও হিমশিম খেতে হয়। টানা ৭ মাস বেতন না পেয়ে লিবিয়ায় আমরা এবং বাংলাদেশে আমাদের সবার পরিবার অর্থনৈতিক কষ্টে ভুগছে। আমরা সব স্বাস্থ্যকর্মী লিবিয়ায় অর্থনৈতিক এবং মানসিকভাবে বিপর্যস্ত অবস্থায় দিন পার করছি।’ আরেকজন চিকিৎসক অভিযোগ করেন ওই অনলাইন নিউজ পোর্টালের প্রতিবেদককে বলেন, লিবিয়ায় তাদের রিক্র্যুটিং এজেন্সিকে বিষয়টি জানালেও তারা এড়িয়ে যাচ্ছেন। লিবিয়ায় বাংলাদেশ দূতাবাসেও তারা কয়েকবার যোগাযোগ করেছেন।

‘দূতাবাস এজেন্সিকে চাপ দিয়েছে, কিন্তু কোনো সুফল আসেনি। এতে দূতাবাসও এখন বিরক্তি প্রকাশ করছে। তাদের কাছ থেকে আমরা আশানুরূপ সাহায্য পাচ্ছি না।’

প্রতিবেদনে একজন স্বাস্থ্যকর্মী বলেন, স্বাস্থ্যকর্মীদের বেশির ভাগের এখনো বৈধ কাগজপত্র করা হয়নি। ফলে তারা অনেকটা অবৈধভাবে অবস্থান করছেন। যারা আছেন, তাদের সমস্যার মধ্যেই বাংলাদেশ থেকে আরো স্বাস্থ্যকর্মী নেয়া হচ্ছে।

‘বেতন কবে হবে সে বিষয়ে আমাদের হাসপাতাল, এখানকার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এবং বাংলাদেশ দূতাবাসও জানে না। প্রতি মাসেই আশ্বাস দিচ্ছে যে সমাধান হয়ে যাবে। কিন্তু হচ্ছে না। আমরা জিম্মিদশায় আছি। আমরা স্বাস্থ্যকর্মীরা কোথাও অভিযোগ করলে বা লেখালেখি করলে লিবিয়ান নিয়োগকারী এজেন্সিসহ আরো কিছু মাধ্যমে আমাদের হুমকি দেয়, যেন আমরা চুপ থাকি।’

এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে নিয়োগ প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশ অংশের দায়িত্বে থাকা ইজ্জি সার্ভিসেস অ্যান্ড রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আদনান অনলাইন নিউজ পোর্টালের প্রতিবেদকের কাছে দাবি করেন, লিবিয়ায় থাকা স্বাস্থ্যকর্মীরা সাত মাস ধরে বেতন পাচ্ছেন না এই তথ্যটি ‘আংশিক সত্য’। ‘তাদের সবার প্রবেশন পিরিয়ড চলছে। এই সময় শেষে তাদের রেসিডেন্স পারমিট, ব্যাংক কার্ড হওয়ার কথা। তারপর তাদের অ্যাকাউন্টে বেতন চলে যাবে। এখন তাদের চলার জন্য এক থেকে আড়াই হাজার দিনার পর্যন্ত দেয়া হচ্ছে পকেটমানি হিসেবে। বিষয়টা প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ সবাই জানে।’ আদনান বলেন, ‘পুরো বিষয়টি ডিল করছেন সেখানকার বাংলাদেশ দূতাবাস। তারা আমাদের যখন চাহিদাপত্র দিয়েছেন, আমরা ধরে নিয়েছি বিষয়টি সবাই অবগত। সেখানকার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের একটি টিম বাংলাদেশে এসে স্বাস্থ্যকর্মীদের বাছাই করেছেন। তারা লিবিয়া যাওয়ার পর আমরা জানতে পেরেছি প্রবেশন পিরিয়ডের বিষয়টি।

‘আমরা বাংলাদেশ দূতাবাস, সেখানকার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে বিষয়টি জানিয়েছি। তারা বলেছেন, প্রবেশন পিরিয়ড শেষে তাদের চাকরি স্থায়ী করা হয়েছে, রেসিডেন্স কার্ড পেয়েছেন অনেকে। আমার কাছে যে তথ্য আছে তাতে এই মাসে সবার অ্যাকাউন্টে টাকা ঢুকবে।’
তবে ভুক্তভোগীরা বলছেন, এ পর্যন্ত তারা দুই হাজার দিনার করে পেয়েছেন, যা বাংলাদেশী টাকায় ৩৮ হাজার টাকার মতো।
লিবিয়ায় কর্মী পাঠানোর অনুমোদন দেয়ার সময় প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় এসব শর্ত দিয়েছিল।

মেসার্স আজুর বেঙ্গল লিমিটেডের বিপণন বিভাগের কর্মকর্তা শাহাদাত কবির বিডিনিউজ টোয়েন্টি ফোর.কম এর প্রতিবেদককে বলেন, বেতন নিয়ে সমস্যাটি তারা জানেন। সাধারণত লিবিয়া যাওয়ার পর তিন মাসের মধ্যে বেতন হয়ে যায়। কিন্তু এবার দেরি হচ্ছে। ‘এবার টাইমটা একটু বেশি লাগছে। আমরা তো জানতাম না। আমরা তো ভালোর জন্যই পাঠিয়েছি। আমরা যেটুকু জানি এই মাসের মধ্যেই বেতন হয়ে যাবে।’

লিবিয়ায় বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মেজর জেনারেল আবুল হাসনাত মুহাম্মদ খায়রুল বাশার বিডি নিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, বিষয়টি তিনি জানতে পারেন গত বছরের অক্টোবর মাসে। নভেম্বর মাসে লিবিয়ার স্বাস্থ্যমন্ত্রী ও উপ-প্রধানমন্ত্রীর সাথে দেখা করে স্বাস্থ্যকর্মীদের চার মাসের বকেয়া বেতন ও আবাসন সঙ্কটসহ বেশ কিছু সমস্যা নিয়ে আলোচনা করেছেন। ‘তিনি (স্বাস্থ্যমন্ত্রী) আমার সামনেই একজন কর্মকর্তাকে বিষয়টি সুরাহা করে দিতে বলেছেন। এক মাস পার হলেও কোনো সমাধান না হওয়ায় আমি হিউম্যান রিসোর্সের ডিজিকে ডেকে বিষয়টি জানাই। তিনি জানালেন, তাদের একটু সমস্যা আছে তবে ওই বছরের মধ্যে পাওনা শোধ করে দেবে। কিন্তু সমাধান হলো না।’ রাষ্ট্রদূত বলেন, পরে লিবিয়ার আরেকজন কর্মকর্তাকে দূতাবাসে ডেকে পাঠানো হয়েছিল। ওই কর্মকর্তা তাদের অর্থ মন্ত্রণালয়ের সাথে বিষয়টি নিয়ে যোগাযোগ করার কথা বলেছিলেন। ‘তিনি তখন জানান, বাংলাদেশের চিকিৎসক, নার্সরা চুক্তিতে সই করছেন না, ফলে প্রক্রিয়াটি এগিয়ে নিতে সমস্যা হচ্ছে। দূতাবাস পরে উদ্যোগ নিয়ে চুক্তির বিষয়টি নিষ্পত্তি করেছে। ‘এরপর আমি গেলাম তাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ডিজির (এশিয়া) কাছে। তিনি আমার সামনেই তাদের স্বাস্থ্য বিভাগে কথা বললেন। তারা জানালেন অর্থ মন্ত্রণালয় তাদের টাকা দেয় নাই, তাই কর্মীদের দিতে পারছেন না।” “তিনি (লিবিয়ার স্বাস্থ্যমন্ত্রী) গত ১২ ফেব্রুয়ারি ওই দেশের সব হাসপাতালে একটি চিঠি পাঠিয়েছেন। বাংলাদেশের চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মীদের বকেয়া বেতন, আবাসনসহ সমস্যাগুলো সমাধান করতে বলেছেন। আমরা সব কিছুর আপডেট আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, আমাদের মন্ত্রণালয় এবং এখানে কর্মরত কর্মীদের জানাচ্ছি। আশা করছি দ্রুতই সমাধান হবে।’

এই অবস্থায় বাংলাদেশ থেকে আরো কর্মী পাঠানো ঠিক হবে কিনা এমন প্রশ্নে আবুল হাসনাত মুহাম্মদ খায়রুল বাশার বলেন, ‘এখনো লিবিয়ায় সরকার স্থিতিশীল না, নিরাপত্তা ব্যবস্থাও প্রায়ই অস্থিতিশীল হচ্ছে। তবে বাংলাদেশী কর্মীরা নিষ্ঠার সাথে কাজ করে, তাই তাদের চাহিদা বাড়ছে। কিন্তু আমরা কর্মীদের সেখানে যেতে উৎসাহিত করছি না, আবার নিরুৎসাহিতও করছি না।

https://www.dailynayadiganta.com/first-page/815490