২০ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, মঙ্গলবার, ১০:৫২

পাঠ্যপুস্তকে এত ভুলের ছড়াছড়ি কেন?

-একেএম শাহনাওয়াজ

গত কয়েক বছর ধরে জানুয়ারি মাসে শিশু শিক্ষার্থীদের হাতে বই তুলে দেওয়ার পরপরই অভিভাবক, শিক্ষার্থী ও শিক্ষকরা ক্ষোভ প্রকাশ করতে থাকেন। অভিযোগ থাকে ভাষা-বানানের ভুল, তথ্যগত ভুলও থাকছে বইগুলোতে। সেসঙ্গে যুক্ত হচ্ছে নিম্নমানের কাগজ ও ছাপার অভিযোগ। আমি ১৯৯৬ থেকে ২০১১-এর মধ্যে কয়েকবার এনসিটিবির মাধ্যমিক ও নিম্নমাধ্যমিক পর্যায়ে গ্রন্থ প্রণয়নের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। তখন এত ভুলভ্রান্তির কথা শোনা যেত না। প্রতিবাদের মুখে বই বাতিল করতে হয়নি বা সংশোধনী পাঠাতে হয়নি। শিক্ষা ও কারিকুলাম বিশেষজ্ঞরা আমাদের কিছুটা প্রশিক্ষণও দিয়েছিলেন। তাতে বুঝেছিলাম কারিকুলামভিত্তিক স্কুল শিক্ষার এসব বই লেখা ছেলেখেলা নয়। যথেষ্ট সতর্কতার সঙ্গে কারিকুলামের নির্দেশনা অনুযায়ী লিখতে হয়। ২০১১ সালে নতুন শিক্ষানীতির নির্দেশনায় বই লিখতে গিয়ে কিছুটা হতাশ হয়েছিলাম। শোনা গিয়েছিল দলীয় বিবেচনায় এবং সচিব মহোদয়দের সুপারিশে নতুন লেখকও যুক্ত করা হতো। যাদের বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের গবেষণা প্রবন্ধ লেখার সক্ষমতা থাকলেও স্কুল পর্যায়ের বয়সভিত্তিক বই লেখার কোনো অভিজ্ঞতা ছিল না, তাদের উপস্থাপিত মাধ্যমিক ও নিম্নমাধ্যমিক পর্যায়ের বইয়ের অধ্যায় দেখে দুশ্চিন্তায় পড়েছিলাম। অনেকটা গবেষণাপত্রের মতো। রাত জেগে অনেক শ্রমে উপযোগী করে তুলতে হতো আমাদের। আরও একটি বিপত্তি হয়েছিল একসময়। একটি লম্বা কমিটি থাকলেও প্রত্যক্ষভাবে আমরা পাঁচ লেখক বই লিখেছিলাম। বই ছাপার পর দেখা গেল কমিটির সবার নামই লেখক হিসাবে ছাপা হয়ে গিয়েছিল বইতে। এর চেয়ে বড় বিপত্তি বই ছাপার পূর্বক্ষণে একজন প্রভাবশালী অধ্যাপক নাকি তোলপাড় শুরু করেছিলেন; তাকে কেন এ কার্যক্রমে রাখা হয়নি। বইয়ের সম্পাদনা হয়ে যাওয়ার পরও তার প্রভাবের কাছে টিকতে না পেরে এনসিটিবি তাকে প্রধান করে নতুন সম্পাদক তালিকা তৈরি করে। লেখকদের না জানিয়ে কারিকুলামের বিধিবদ্ধ ধারা ভেঙে লেখকদের লেখার অনেক কিছু ফেলে দিয়ে তারা তাদের জ্ঞান মতো ভুল তথ্য যুক্ত করে বই প্রকাশ করলেন। এ ভুলের দায় নিতে পারব না বলে লিখিতভাবে এনসিটিবি থেকে অব্যাহতি নিয়ে আমরা বেরিয়ে এসেছিলাম। আর ও মুখো হইনি।

আমাদের অভিজ্ঞতা দিয়ে দেখেছি, যে পদ্ধতিতে কারিকুলামভিত্তিক বই চূড়ান্ত হয় তাতে ভুল থাকার খুব বেশি সুযোগ থাকে না। তা হলে কেন এত ভুলের মধ্যে পড়তে হচ্ছে? আমরা যখন কাজ করেছি, দেখেছি দায়িত্বে থাকা শিক্ষাবিশেষজ্ঞরা লেখকদের প্রাথমিক ওরিয়েন্টেশন দিতেন। পাঠ ভাগ করা হতো শিক্ষার্থীদের বয়স বিবেচনায়। কারিকুলামও তৈরি হতো সেভাবে। প্রতি অধ্যায় ও পাঠ তৈরির শুরুতে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সুনির্দিষ্ট থাকত। নির্দেশনা অনুযায়ী পাঠ তৈরি করতেন লেখকরা। সেখানে ভাষা, প্রমিত বানান ইত্যাদি সতর্কতার সঙ্গে বিন্যাস করা হতো। বয়স অনুযায়ী জ্ঞানচর্চার অবকাশ তৈরি হচ্ছে কিনা তা সতর্কতার সঙ্গে পর্যবেক্ষণ করা হতো। পাঠ অনুযায়ী কী ধরনের ছবি দেওয়া হবে তা লেখকরাই প্রাথমিকভাবে নির্ধারণ করতেন এবং তা শিল্পীদের বুঝিয়ে দেওয়া হতো। এনসিটিবিতে বড় সমস্যা ছিল (সম্ভবত এখনো আছে) এখানে কোনো নিজস্ব প্রুফ রিডার নেই। আউট সোর্সিংয়ের মাধ্যমে তা সম্পন্ন করা হতো। এরপর পাণ্ডুলিপি সতর্কতার সঙ্গে পাঠ করতেন এবং প্রুফ দেখতেন এনসিটিবির নিজস্ব বিশেষজ্ঞরা। কোনো অসঙ্গতি পেলে তা লেখকদের নজরে আনতেন। সব শেষে সম্পাদকদের টেবিলে যেত পাণ্ডুলিপি। এভাবে কার্যক্রমে যুক্ত লেখক থেকে সম্পাদক পর্যন্ত সবাই একটি বই সম্পাদনের জন্য দায়বদ্ধ থাকতেন। এ কারণে ভুল করার সুযোগ খুব কম ছিল।

এমন একটি বিধিবদ্ধ কার্যক্রমের মধ্যে ইদানীং এত ভুলের কথা আসছে কেন? অভিভাবক-শিক্ষার্থী-শিক্ষকরা প্রতিবাদ করছেন কেন? প্রকাশিত বই বাতিল করতে হচ্ছে কেন? সংশোধনী স্কুলে স্কুলে পাঠাতে হচ্ছে কেন?

গত সপ্তাহে একটি টিভি চ্যানেলে সম্ভবত এনসিটিবির একজন সদস্যের কাছে এমন একটি প্রশ্ন রাখা হয়েছিল। তিনি চেষ্টা করে সাফাই বক্তব্য দিলেন। নানা রকম খোঁড়া সমস্যার কথা বললেন। সজ্জন মানুষ বলে মাঝে মাঝে এনসিটিবির পক্ষ থেকে ক্ষমাও চাইলেন। তিনি এ ভুলের দায় ব্যাপক পরিবর্তিত কারিকুলামের ওপর চাপালেন। আমরাও মন্ত্রণালয়ের বক্তব্য শুনে আসছিলাম। পরীক্ষানির্ভর পাঠ থেকে বের করে বাস্তব জ্ঞাননির্ভর করতে চাইছেন নতুন প্রজন্মকে। এ আলোকেই পরিবর্তন আনা হয়েছে কারিকুলামে। উদ্দেশ্যটি মহৎ। এমনটি আমাদের চাওয়াও ছিল অনেক দিন ধরে। নতুন বিষয় হলেও বিষয়বস্তু নিয়ে কখনো প্রশ্ন উঠতে পারে, তবে ভাষা ও বানানগত ভুল এবং দেশীয় সংস্কৃতি ও মূল্যবোধের সংঘাত হবে কেন তা আমার বোধগম্য হলো না। ফিনল্যান্ড বা জাপান নয় নিজ দেশের সমাজ ও অর্থনৈতিক বাস্তবতাকে সামনে রেখে পাঠক্রমে পরিবর্তন আনা উচিত এ কথা নীতিনির্ধারকরা মনে করেন না কেন!

এনসিটিবির বিজ্ঞ সদস্য সাফাই বক্তব্যে বললেন, জানুয়ারি মাসে বই দিতে হবে বলে তাড়াহুড়ায় কিছু ভুল থেকে যায়। এ বক্তব্যটি আমার কাছে অনেকটা দুর্বোধ্য মনে হলো। জানাই তো আছে ১২ মাসে এক বছর। সেভাবেই কারিকুলাম তৈরি, বই লেখানো, সম্পাদনা ও ছাপার আয়োজন ভাগ করে নেওয়া যায় সহজেই। সময়মতো লেখকরা পাণ্ডুলিপি দিতে ব্যর্থ হলে তা জবাবদিহিতার আওতায় নিয়ে আসা যায়। সব রুটিনবদ্ধ থাকলে তাড়াহুড়ার প্রশ্ন আসবে কেন! আর প্রতি বছর একই কথা বলতে হবে কেন?

আমার বিবেচনায় এখন লেখক ও সম্পাদক প্যানেল নির্বাচন খুব সুষ্ঠুভাবে হচ্ছে না। পাকিস্তান আমল থেকে লক্ষ করলে দেখব দক্ষ-অভিজ্ঞ শিক্ষকরা শিশুশিক্ষার বই লেখা ও সম্পাদনার সঙ্গে যুক্ত থাকতেন। ১৯৯৬ সালে সম্ভবত ‘সেকেন্ডারি এডুকেশন ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট’ (এসইডিপি)-এর অর্থানুকূল্যে এনসিটিবি কারিকুলামে বড় রকম পরিবর্তন এনেছিল। এ পর্যায়ে নতুনভাবে বইপত্র লেখা হয়। লেখক নির্বাচন করা হয়েছিল পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে। অনেক বিষয়ে লেখকের দক্ষতা যাচাই করে নম্বরের ভিত্তিতে নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছিল। বড় একটি পরিবর্তন এসেছিল সেবার। বই নিয়ে তেমন বিতর্ক তৈরি হয়নি। বই প্রকাশের কিছু দিন পর রাজনৈতিক কারণে বিএনপি ও আওয়ামী লীগ উভয়ের সময়েই মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে কিছু পরিবর্তন আনা হয়। এটি ভিন্ন প্রসঙ্গ।

আমার ধারণা লেখক নির্বাচনে এখন আর তেমন সতর্কতা নেই। সব কিছুর মতো দল পরিচয় বা বন্ধু পরিচয় বড় হয় এখানেও। গত বছর সপ্তম শ্রেণির বই নিয়ে বড় বিতর্ক তৈরি হয়েছিল। পরে বাতিল করতে হয়েছিল বই। আরও কয়েকটি বই নিয়েও প্রশ্ন উঠেছিল। আমি অনুসন্ধান করে দেখেছিলাম লেখকদের বড় অংশ মেধাবী শিক্ষক হলেও পাঠ্যপুস্তকসহ ছোটদের জন্য কোনো ধরনের লেখার পূর্ব অভিজ্ঞতা ছিল না। দুই বছর আগে আমি একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের নাম স্কুলপাঠ্য বইয়ের লেখক হিসাবে দেখে অবাক হয়েছিলাম। এর কিছু দিন আগে আমার সামনেই কোনো এক প্রসঙ্গে তিনি বলেছিলেন, ‘আমি বাংলায় লিখতে পারি না। এখনো বাংলা ভাষা ও বানান রপ্ত করতে পারিনি।’ লেখক হিসাবেও তার তেমন পরিচিতি নেই। খ্যাতিমান শিশুসাহিত্যিক হলেই যে কারিকুলামভিত্তিক বই রচনা বা সম্পাদনায় সফল হবেন তেমন বিবেচনাও সঠিক বলে আমরা মনে করি না। বাস্তবে তাই হচ্ছে। আমার ধারণা এমন বাস্তবতায় সংকট সৃষ্টি হচ্ছে বারবার।

প্রতি বছরই নিম্নমানের কাগজ ও মানহীন ছাপা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। আমি বাজেটসহ ছাপার কার্যাদেশের ধারণা নিয়ে একজন বনেদি প্রকাশকের সঙ্গে কথা বলি। যার প্রেস, বাঁধাই সব বিভাগই রয়েছে। তিনি হিসাব-নিকাশ করে বললেন, বরাদ্দ বাজেটে অপেক্ষাকৃত উন্নতমানের কাগজে ঝকঝকে ছাপা বই প্রকাশ করা সম্ভব। তার পরও ফি বছর একই সংকট হচ্ছে কেন? শোনা যায় ক্ষমতাধররা ভাগবাটোয়ারা ঠিক করে নিজেদের পরিচিত ও পরিজনদের কার্যাদেশ দিতে পছন্দ করেন। ফলে নানা সিস্টেমে বাজেটের একটি অংশ কীট দংশিত হয়ে আঁস্তাকুড়ে চলে যায়। তাই এর চেয়ে মানসম্পন্ন বই প্রকাশ করা সম্ভব হয় না।

২০০৫-এ টের পেয়েছিলাম এনসিটিবির রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতির উইপোকা বাসা বেঁধেছে। অনেক দিন থেকেই নানা মহল থেকে দাবি ছিল এনসিটিবির বইয়ের মনোপলি ভেঙে প্রতিযোগিতামূলকভাবে বেসরকারি প্রকাশকদেরও বোর্ডের টেক্সট বই ছাপার অনুমতি দেওয়া হোক। শেষ পর্যন্ত ২০০৫ সালে কয়েকটি বইয়ে ছাড় দেওয়া হয়েছিল। এর মধ্যে নবম ও দশম শ্রেণির মানবিক শাখার ইতিহাস বইও ছিল। বড় বাজার বিবেচনায় প্রকাশকরা ছুটতে লাগলেন লেখকদের পেছনে। একটি স্বনামধন্য প্রকাশকের প্রস্তাবে আমি রাজি হই দুটি কারণে। প্রথমত আমার বরাবরই মনে হতো একাধিক লেখকের লেখায় একটি নির্দিষ্ট বই রচনার চেয়ে একজন দক্ষ লেখক গোটা বই লিখলে লেখার মানে ভারসাম্য থাকে। আমি এ বই রচনায় একা লেখার সুযোগ পাব। দ্বিতীয়ত ইতোমধ্যে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে নানা বিকৃতি এসেছে। আমি চেষ্টা করব ‘দলীয় সংস্কার কমিটি’র দৃষ্টি ফাঁকি দিয়ে ইতিহাসের সত্য রক্ষা করা যায় কিনা। এনসিটিবি নিয়ম বেঁধে দেয়, তাদের নির্ধারিত সিলেবাসে ও বিধিবদ্ধ পদ্ধতিতে বই লিখতে হবে। বই সম্পাদনার খরচ মেটাতে প্রকাশক পাণ্ডুলিপির সঙ্গে মোটা অঙ্কের টাকা জমা দেবেন। এনসিটিবির নির্ধারিত সম্পাদনা পরিষদ মানোত্তীর্ণ বিবেচনায় ছাড় দিলে তা ‘এনসিটিবি কর্তৃক অনুমোদিত’ লিখে ছাপা যাবে। তবে শর্ত থাকছে বই চূড়ান্ত করার পর মূল্য নির্ধারণের জন্য আবার এনসিটিবিতে জমা দিতে হবে। বোধহয় আসল রহস্যটি এখানেই ছিল।

আমার বই সব ঘাট পেরিয়ে অনুমোদন পেল। যথারীতি মূল্য নির্ধারণের জন্য পাঠানো হলো। এনসিটিবি কালক্ষেপণ না করে মূল্য নির্ধারণ করে দিলে বই ডিসেম্বরের মধ্যে বাজারে চলে আসত। খবর নিয়ে জানলাম এনসিটিবির বই ছাপা বাঁধাই শেষ হলে মাসতিনেক পর আমাদের বইয়ের মূল্য নির্ধারণ করা হলো। অতঃপর প্রকাশক ছাপা শুরু করতে পারলেন। ইতোমধ্যে এনসিটিবি তাদের প্রকাশিত বই বাজারে ছেড়ে দিল। সাধারণ মানুষ ও শিক্ষকরা জেনে অভ্যস্ত টেক্সট বই এনসিটিবিই ছাপে। ভিন্ন ব্যবস্থা সম্পর্কে অনেকেই অবহিত ছিলেন না। তাই যখন শিক্ষার্থীদের বই কেনা শেষ হয়ে গেল তখন আমাদের বই বাজারে এলো। শেষ পর্যন্ত উন্নতমানের কাগজ ও ঝকঝকে ছাপার পরও প্রকাশক ক্ষতিগ্রস্ত হলেন। এমন ব্যবস্থাপনার কারণে বেসরকারি প্রকাশকরা আর সম্ভবত আগ্রহ দেখাননি।
আমরা মনে করি, এ সেক্টরের সব আবর্জনা সরাতে না পারলে পাঠ্যপুস্তককে বিতর্কমুক্ত রেখে শিক্ষার ধারা এগিয়ে নেওয়া সম্ভব নয়।
ড. একেএম শাহনাওয়াজ : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
shahnawaz7b@gmail.com

https://www.jugantor.com/todays-paper/window/776328