১৫ মে ২০১৭, সোমবার, ৩:৪১

নতুন বাজেটেই ভরসা

বিপর্যস্ত শেয়ারবাজার ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি

পুঁজি হারিয়ে কয়েক লাখ বিনিয়োগকারী আটকে আছে বিভিন্ন মার্চেন্ট ব্যাংক ও ব্রোকারেজ হাউসে

বিপর্যস্ত শেয়ারবাজার ৬ বছরেও ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। পুঁজি হারিয়ে কয়েক লাখ বিনিয়োগকারী আটকে আছে বিভিন্ন মার্চেন্ট ব্যাংক ও ব্রোকারেজ হাউসে। তবে প্রতিবছর বাজেট এলেই আশায় বুক বাঁধেন স্টক এক্সচেঞ্জের নেতারা। চলতি অর্থবছরের বাজেট ঘোষণার আগেও বিভিন্ন খাতে কর কমানোসহ সুনির্দিষ্ট কিছু প্রস্তাব দিয়েছিলেন শেয়ারবাজারের তিন প্রতিষ্ঠান- ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই), চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ (সিএসই) এবং বাংলাদেশ মার্চেন্ট ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমবিএ) নেতারা। কিন্তু কোনো প্রস্তাবই আমলে নেয়নি সরকার। উল্টো বাজেট বক্তৃতায় শেয়ারবাজারকে ফটকাবাজার বলে শাসিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। এবারও তিন সংগঠন মিলে সুনির্দিষ্ট কিছু প্রস্তাব দিয়েছে। স্টক এক্সচেঞ্জের নেতারা মনে করেন, এসব প্রস্তাব বাস্তবায়ন হলে শেয়ারবাজারে সুদিন ফিরবে।


জানতে চাইলে ডিএসইর পরিচালক রকিবুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, শিল্পায়নে পুঁজি জোগানোর অন্যতম উৎস শেয়ারবাজার। মোট দেশজ উৎপাদনেও (জিডিপি) এ খাতের উল্লেখযোগ্য অবদান রয়েছে। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে এ খাতটি ঝিমিয়ে পড়েছে। তিনি বলেন, শেয়ারবাজারের প্রাণচাঞ্চল্য ফিরে পেতে হলে সরকারকে উদ্যোগ নিতে হবে। বাজেটে বিভিন্ন প্রণোদনা দিয়ে বুঝাতে হবে, সরকার এ খাতকে গুরুত্ব দিচ্ছে। এতে বিনিয়োগকারীরা আস্থা ফিরে পাবে। তিনি আরও বলেন, আগামী বাজেটে স্টক এক্সচেঞ্জের পক্ষ থেকে বেশ কয়েকটি প্রস্তাব জাতীয় রাজস্ব বোর্ড এবং অর্থমন্ত্রীকে দেয়া হয়েছে। এসব প্রস্তাব বাস্তবায়ন হলে বাজারে গতি আসবে।

স্টক এক্সচেঞ্জ থেকে জানা গেছে, আগামী ২০১৭-১৮ অর্থবছরের বাজেটে নানান সুবিধা দাবি করেছেন শেয়ারবাজার সংক্রান্ত তিন প্রতিষ্ঠানের নেতারা। এসব দাবির অন্যতম হল- তালিকাভুক্ত কোম্পানির কর্পোরেট কর কমানো। বর্তমানে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত কয়েকটি কোম্পানির কর্পোরেট কর ২৫ শতাংশ। আগামী অর্থবছরে তা কমিয়ে ১৫ শতাংশ নির্ধারণের সুপারিশ করা হয়েছে। এছাড়া বর্তমানে বিনিয়োগকারীরা কোনো কোম্পানি থেকে ২৫ হাজার টাকা পর্যন্ত লভ্যাংশ পেলে তা আয়কর মুক্ত। আগামী বাজেটে এ সীমা বাড়িয়ে ১ লাখ টাকা করার প্রস্তাব করেছে ডিএসই। অন্যদিকে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগকারীর অংশগ্রহণ বাড়াতে লেনদেনের ওপর বিদ্যমান কর দশমিক শূন্য ৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে দশমিক শূন্য ১৫ শতাংশ করার প্রস্তাব করেছে ডিএসই। অর্থাৎ বর্তমানে কোনো বিনিয়োগকারী ১ লাখ টাকা লেনদেন করলে তাকে ৫০ টাকা সরকারকে কর দিতে হয়। স্টক এক্সচেঞ্জের প্রস্তাবে তা কমিয়ে ১৫ টাকা করতে বলা হয়েছে। ব্যক্তি শ্রেণীর করদাতাদের ন্যূনতম কর সীমা ২ লাখ ৫০ হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে ৩ লাখ ৫০ হাজার টাকা করতে বলা হয়েছে। অর্থাৎ কোনো ব্যক্তি ৩ লাখ ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত আয় করলে তাকে কোনো কর দিতে হবে না। শেয়ারবাজার সংশ্লিষ্ট যুক্তি হল- করমুক্ত আয়সীমা বাড়লে বিনিয়োগকারীদের কিছু টাকা সঞ্চয় হবে। এতে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ বাড়বে।

এছাড়াও স্টক এক্সচেঞ্জের মালিকানা থেকে ব্যবস্থাপনা (ডিমিউচুয়ালাইজেশন) আলাদা করার পর স্টক এক্সচেঞ্জকে দেয়া কর অবকাশ-সুবিধা ২০১৯ সাল পর্যন্ত অব্যাহত রাখার প্রস্তাব করেছে ডিএসই। ডিএসই নেতারা বলছেন, বর্তমানে ডিএসই পরিচালন ক্ষতির সম্মুখীন। এ অবস্থায় ডিএসইর আয়ের ওপর করারোপ করা হলে তাতে লেনদেনের মাশুল বাড়াতে হবে, যার দায় পড়বে সাধারণ বিনিয়োগকারীর ওপর। একই সুপারিশ করেছে সিএসইও। এছাড়া আরও যেসব প্রস্তাব করা হয়েছে সেগুলো হল- স্ট্রেকহোল্ডারদের (মেম্বার) উৎস কর হার কমানো, ডিমিউচুয়ালাইজেশন পরবর্তী স্টক এক্সচেঞ্জের শেয়ার হস্তান্তরে স্ট্যাম্প ডিউটি প্রত্যাহার এবং আয়বর্ষের সংজ্ঞা পরিবর্তন করা। ডিএসই ব্লক হিসেবে রাখা স্টক এক্সচেঞ্জের মালিকানার ৬০ শতাংশ স্বয়ংক্রিয় শেয়ারের ওপর থেকে স্ট্যাম্প ডিউটি প্রত্যাহার করে নেয়ারও সুপারিশ করা হয়েছে। গত বছরের শুরুতে শিল্পায়নে পুঁজির জোগান দেয়া এ খাতটি অনেকটা নামেই বেঁচে ছিল। বছরের বেশির ভাগ সময়ই নিস্তেজ ছিল শেয়ারবাজার। গণমাধ্যমেও এ খাতের সংবাদ গুরুত্ব হারিয়েছিল। তবে শেষ সময়ের উত্থান চোখে পড়ার মতো। ২০১৬ সালের শুরুতে ডিএসইর ব্রড সূচক ছিল ৪ হাজার ৬২৪ পয়েন্ট। আর বছর শেষে তা ৫ হাজার ৫শ’ পয়েন্টে উন্নীত হয়েছে। কিন্তু আলোচ্য সময়ে ১০টি নতুন কোম্পানি বাজারে যোগ হয়েছে। এ কোম্পানিগুলো বাদ দিলে সূচক ৪ হাজার ৮শ’ পয়েন্টে নামবে। অপরদিকে বছরের বেশিরভাগ সময়জুড়েই লেনদেন ৩০০ থেকে ৪০০ কোটি টাকার ঘরেই সীমাবদ্ধ ছিল। তবে শেষ তিন মাসে ৩ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায় লেনদেন। এছাড়াও আলোচ্য সময়ে ডিএসইর বাজার মূলধন ৩ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকায় উন্নীত হয়েছে। বছরব্যাপী শেয়ারবাজারের উত্থান-পতনে দুর্বল কোম্পানিই নেতৃত্ব দিয়েছে। অর্থাৎ এ কোম্পানির আড়ালে বাজার থেকে দুষ্টচক্রের পকেট ভারি হয়েছে। এসব কারণে ফিন্যান্সিয়াল রিপোর্টিং কাউন্সিল গঠনের বিষয়টি বারবার সামনে চলে আসছে। কিন্তু এ ব্যাপারে সরকারের পক্ষ থেকে উল্লেখযোগ্য কোনো অগ্রগতি নেই।

জানতে চাইলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, শেয়ারবাজারের সংকট পুরনো। এটি এ বাজারের প্রতি বিনিয়োগকারীদের আস্থার সংকট। এ সংকট কাটাতে সরকারকে ব্যবস্থা নিতে হবে। বিশেষ করে বিভিন্ন সংস্কারের মাধ্যমে এ খাতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। বিনিয়োগকারীদের মেসেজ দিতে হবে- কারসাজির মাধ্যমে কেউ তার টাকা হাতিয়ে নিলে তার বিচার হবে।

 

http://www.jugantor.com/last-page/2017/05/15/124596/