২০ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, মঙ্গলবার, ৯:৪০

ভাষা আন্দোলন ও আমার ভাবনা

-ড. মো. নূরুল আমিন

আমার সম্মানিত পাঠক-পাঠিকাদের অনেকেই মেইল, মেসেঞ্জার ও টেলিফোনে আক্ষেপ করে আমাকে জানিয়েছেন যে, বিভিন্ন বিষয়ে আমার লেখা প্রবন্ধ-নিবন্ধ পড়লেও তারা ভাষার উপর লেখা আমার প্রবন্ধ কখনো পড়েননি। এর উপর আমার নির্লিপ্ততার কারণ জানতে চাওয়ার পাশাপাশি তাদের কেউ কেউ ভাষার মাস ফেব্রুয়ারিতেই অন্তত একটা লেখা প্রকাশের অনুরোধ করেছেন। তাদের অভিযোগটি সত্য; উপেক্ষা করার মতো নয়। তবে ভাষা আন্দোলনের উপর কোনো কিছু না লিখলেও আমি এই আন্দোলনে যারা প্রাণ দিয়েছেন তাদের রুহের মাগফিরাত কামনা করি।

তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন যখন তুঙ্গে তখন আমি আমার গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রথম শ্রেণির ছাত্র। রাষ্ট্রভাষা বাংলা করার দাবিতে সারা প্রদেশ তখন আন্দোলনে মুখর। এই আন্দোলনেরই এক পর্যায়ে ঢাকার মিছিলে পুলিশের গুলিতে সালাম, বরকত, রফিকসহ কয়েকজন অংশগ্রহণকারী নিহত হন। মিছিলে অংশগ্রহণকারী সকলে ছাত্র ছিলেন না। ছাত্রবহির্ভূত সাধারণ নাগরিকও ছিলেন। পুলিশের গুলিতে নিহত একজনের বাড়ি আমাদের পাশের গ্রামে ছিল। খবরটি ছড়িয়ে পড়ার সাথে সাথে সারা পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ বিক্ষোভে ফেটে পড়েছিলেন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহের ছাত্রছাত্রীরা ফেস্টুন হাতে মিছিলে নেমে পড়ে। আমরাও নেমে পড়ি। আমাদের স্কুলের প্রবীন শিক্ষক চৌদ্দআনী মাস্টার নামে কথিত জনাব আবুল হাসেম এর নেতৃত্ব দেন। আমাদের পাশের গ্রাম সাপুয়াতে চৌদ্দআনী বাড়ি নামে একটি বাড়ি ছিল। তিনি ঐ বাড়িতে লজিং থাকতেন। তাই তার নাম হয়েছিল চৌদ্দআনী মাস্টার। তিনি দুই আনার ভাজা বুট কিনে আমাদের খাইয়েছিলেন।

যা বলছিলাম। আমরা মিছিলে গিয়ে রাস্তার প্রায় দু’মাইল প্রদক্ষিণ করে পুনরায় স্কুলে ফিরে এসেছিলাম। এই মিছিলে দুটি স্লোগানই ছিল মুখ্য, ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’, ‘নূরুল আমিনের গর্দান চাই’।

১৯৪৭ সালে পাকিস্তান ও ভারত স্বাধীন হবার পর উভয় দেশের রাষ্ট্রভাষা কী হবে এ নিয়ে বিতর্ক দেখা দেয়। ভারত বহু ভাষাভাষী একটি দেশ। সে দেশটিতে ভাষার সংখ্যা ছিল শতাধিক। তারা কোনো অঞ্চল বা রাজ্যের/প্রদেশের ভাষাকে প্রাধান্য না দিয়ে হিন্দিকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা প্রদান করেন এবং সকলেই তা গ্রহণ করেন। পাকিস্তানের ছিল পাঁচটি প্রদেশ, পূর্ব পাকিস্তান, সিন্ধু, বেলুচিস্তান, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদশে ও পাঞ্জাব। শেষোক্ত চারটি প্রদেশ নিয়ে গঠিত হয়েছিল পশ্চিম পাকিস্তান। পূর্ব পাকিস্তানীদের মাতৃভাষা ছিল বাংলা, যদিও কারুর কারুর মতে এই অঞ্চলের মানুষের কাছে বিভিন্ন জেলার নিজ নিজ আঞ্চলিক ভাষাগুলোই ছিল সংশ্লিষ্ট মানুষের মাতৃভাষা। যেমন, আমি বৃহত্তর নোয়াখালীর বাসিন্দা, নোয়াখাল্যা ভাষা আমার মাতৃভাষা। নোয়াখালীর মধ্যে আবার ফেনী ও লক্ষ্মীপুর অথবা হাতিয়া-রামগতির ভাষার মধ্যে শব্দগত ও ধ্বনিগত অনেক তফাৎ আছে। নোয়াখালীর মানুষের কাছে চট্টগ্রাম ও সিলেট অঞ্চলের ভাষা জটিল, বোধগম্য নয়। একইভাবে উত্তরবঙ্গ ও দক্ষিণবঙ্গের অবস্থাও তাই। ঢাকার ভাষা আবার মিশ্র। মূলত ঢাকার বেশিরভাগ লোক উড়িষ্যার কটক থেকে আমদানি করা, এরা প্রথমত, কটকি ও পরে অপভ্রংশ হয়ে কুট্টি নামে পরিচিত হয়েছে। এদের ভাষা বাংলা, উর্দু ও উড়িষ্যার মিশ্রণ।

পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর এই দেশের রাষ্ট্রভাষা তথা অফিস-আদালতের ভাষা কী হবে তা নিয়ে বিরোধ দেখা দেয়, প্রাদেশিক ভাষা হিসেবে বাংলাভাষার ব্যাপারে কোনো প্রশ্ন ওঠেনি। পশ্চিম পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের লোকেরা পাঞ্জাবী, সিন্ধুর সিন্ধি, বেলুচিস্তানের বেলুচি এবং সীমান্ত প্রদেশের মাতৃভাষা ছিল পুশতু। সেখানে কোনো প্রদেশের মাতৃভাষা উর্দু ছিল না। উপমহাদেশে উর্দু ভাষার জন্ম হয়েছিল মুসলমানদের কমন ভাষা হিসেবে, ফৌজি ভাষা হিসেবে আরবী, পারসী, প্রাকৃত প্রভৃতির সমন্বয়ে। এই ভাষাটি আমাদের মাদরাসা শিক্ষার মাধ্যম ছাড়াও ইসলামী জ্ঞান-বিজ্ঞানে সমৃদ্ধও ছিল। এই ভাষায় কুরআন, হাদিস, উসুল, ফিকাহর চর্চা ছিল ব্যাপক। এই অবস্থার প্রেক্ষাপটে তৎকালীন শাসকবর্গ, আলেম ও ওলামাদের এবং পুরানো ঢাকাবাসীদের একটা অংশের জোর দাবি ছিল উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার। কিন্তু বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর দাবি ও চাহিদার এটা ছিল পরিপন্থী। তাদের দাবি ছিল, পূর্ব পাকিস্তানীরা পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ এবং এই সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের ভাষাকেই রাষ্ট্রভাষার মর্যাদায় আসীন করতে হবে। এই দাবির রূপরেখা প্রণয়ন ও তার সমর্থনে জনগণকে সংগঠিত করার কাজে যারা এগিয়ে আসেন তাদের মধ্যে সংগঠন হিসেবে মুখ্য ভূমিকা পালন করে তমদ্দুন মজলিস। ব্যক্তি হিসেবে যারা ছাত্র সমাজকে জোরালো নেতৃত্ব দিয়েছেন তাদের মধ্যে প্রধানতম ব্যক্তি ছিলেন অধ্যাপক গোলাম আযম, বিচারপতি আবদুর রহমান, মাওলানা আকরম খাঁ, আবুল কাশেম, নূরুল হক ভূইঞা, আবদুল মতিনসহ আরো বরেণ্য ব্যক্তিবর্গ। পাকিস্তানের তৎকালীন নেতৃবৃন্দ রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের যৌক্তিক দাবির জবাব যুক্তি দিয়ে না দিয়ে বুলেট দিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছেন। এদের মধ্যে সবাই পশ্চিম পাকিস্তানী ছিলেন না। পূর্ব পাকিস্তানেরও অনেক নেতা ছিলেন। ‘নূরুল আমিনের গর্দান চাই’ স্লোগানটি এ সত্য থেকেই প্রসূত। তৎকালীন পাকিস্তানের শিক্ষামন্ত্রী ছিলেন এই অঞ্চলেরই বাসিন্দা জনাব ফজলুর রহমান। তিনি আরবী হরফে বাংলা লেখার অদ্ভূত প্রস্তাবও দিয়েছিলেন। তারই পুত্র এখন বাংলাদেশের একজন শিল্পপতি। ভাষা আন্দোলনের এটাও একটি ইস্যু ছিল। এই আন্দোলনের ফলাফল সম্পর্কে অনেকেই জানেন। উর্দুর পাশাপাশি বাংলা রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা পেয়েছিল। কিন্তু অফিস-আদালতের ভাষা হিসেবে বাংলা কি প্রতিস্থাপিত হয়েছিল? ইংরেজরা অফিস-আদালতের ভাষা হিসেবে ইংরেজি চালু করে গিয়েছিলেন। রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলা ও উর্দুকে অভিষিক্ত করা হলেও অফিসের ভাষা পুরো পাকিস্তান আমল এবং বাংলাদেশ আমলের ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত ইংরেজি রয়ে যায়। ১৯৮৫ সালে জেনারেল এরশাদের আমলে সার্কুলার জারি করে সর্বস্তরে বাংলার প্রচলন করা হয়। কলেজ-বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষার মাধ্যমও ইংরেজির পাশাপাশি বাংলা স্থান পায়।

মুসলমানদের জন্য স্বতন্ত্র একটি বাসভূমি হিসেবে পাকিস্তান সৃষ্টি হয়েছিল যেমনটি হয়েছিল হিন্দুদের জন্য হিন্দুস্তান বা ভারত। বৃটিশ শাসনামলে বাংলা ভাষা বিশেষ করে মুসলিম প্রধান পূর্ববাংলার ভাষা ও সাহিত্য থেকে ইসলামী ভাবধারা নির্বাসনের জন্য ইংরেজদের সহযোগিতায় হিন্দুরা আপ্রাণ চেষ্টা চালায় এবং এই লক্ষ্যে পাদ্রী উইলিয়াম কেরীর নেতৃত্বে কোলকাতায় ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়। তাদেরই পরিকল্পনায় আমাদের ভাষা সংস্কৃতি ও তাহজিব তমদ্দুনের ব্যাপক পরিবর্তন আনার চেষ্টা করা হয়। এতে বাঙালি মুসলমানদের যে ক্ষতি হয়েছিল তমদ্দুন মজলিস সূচিত ভাষা আন্দোলনে তা পুষিয়ে নেয়ার উদ্যোগও ছিল। এ দেশের ইসলাম বিরোধী ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী নাস্তিক কমিউনিস্টরা ভাষা আন্দোলনের ধারেকাছেও ছিলেন না। আন্দোলন যখন সফল হলো তখন তারা দলে দলে এসে তার ক্রেডিট নিতে শুরু করলেন। শুধু তা নয়, তাদের অপচেষ্টা ও অপপ্রচারের মুখে তমদ্দুন মজলিসসহ ইসলামপন্থীদের সমস্ত কৃতিত্ব ধামাচাপা পড়ে গেল। অধ্যাপক গোলাম আযমকে ব্ল্যাকআউট করা হলো। ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ইতিহাস থেকে ডাকসুর দু’মেয়াদে তার নেতৃত্বের রেকর্ড সম্পূর্ণভাবে মুছে দেয়া হলো। তারা সাধারণ মানুষ ও কোমলমতি ছাত্রছাত্রীদের আবেগকে উসকিয়ে দিয়ে ফেব্রুয়ারি মাস আসলেই প্রায় প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শহীদ মিনার বানিয়ে পুষ্পার্ঘ প্রদান করতে শুরু করে। শহীদ ও মৃত ব্যক্তিদের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনের ইসলামী রীতি হচ্ছে তাদের জন্য দোয়া করা, তাদের রুহের মাগফিরাত কামনা করা। পূজাম-পে ফুল দেয়া হিন্দুরীতি বা হিন্দু কালচার। অনেকে যত্রতত্র শহীদ মিনার করে পুষ্পার্ঘ অর্পণ করাকে শিবলিঙ্গের পূজার সাথে তুলনা করেন। শতকরা ৯২ ভাগ মুসলমানের দেশে ইসলামী রীতির এই লংঘন অসহনীয় পর্যায়ে গিয়ে ঠেকেছে। এর বিরুদ্ধে কিছু বলতে গেলে রাজাকার-জঙ্গী খেতাব পেতে হয়। সংখ্যালঘুর হাতে সংখ্যাগুরুরা অপমানিত হয়। কেউ এর প্রতিবাদের সাহস পান না। নেপোলিয়ান বলেছিলেন, People Suffer not for the violence of the bad people but for the silence of the good people. খারাপ লোকদের উৎপাতে মানুষ দুর্ভোগ পোহায় না, দুর্ভোগ পোহায় ভালো লোকদের নীরবতা বা নির্লিপ্ততায়। কথাটি আমাদের সমাজে শতকরা ১০০ ভাগ সত্য। ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি সব কিছুই এখন তারা দখল করে নিয়েছে। অনেকের বিশ্বাস প্রতিবেশী দেশ থেকে এ ব্যাপারে তারা অর্থবিত্তসহ সবকিছু পান, সরকারি আয়োজনে বাংলা একাডেমির একুশে বইমেলার অনুষ্ঠান একটি বিরাট আয়োজন। এই বইমেলায় ইসলামপন্থী লেখক-লেখিকা এবং প্রকাশনা সংস্থাগুলো স্টল বরাদ্দ পায় না। বছরের পর বছর ধরে এর কোনো প্রতিকার নেই। বাংলা ভাষার উন্নয়ন ও প্রসারের জন্য বাংলা একাডেমি ও বাংলা উন্নয়ন বোর্ড প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। প্রতিষ্ঠান দুটির অস্তিত্ব ও অবস্থান আছে কিন্তু বিস্তৃতি নগণ্য। বাংলা উন্নয়ন বোর্ডের কাজকর্ম খুঁজে পাওয়া মুসকিল। বাংলা একাডেমি আমাদের বাংলাভাষী মুসলমানদের কৃষ্টি-কালচার তথা সংস্কৃতির বাহন হবার কথা ছিল। কিন্তু হতে পারেনি। ভাষাকে সংস্কৃতি থেকে আলাদা করা যায় না। ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে মাতৃভাষার গুরুত্ব এবং তাকে নিয়ে যে তমদ্দুন গড়ে ওঠার কথা বারান্তে সে সম্পর্কে আলোচনার প্রতিশ্রুতি দিয়ে আজ এখানেই শেষ করতে চাই।

https://www.dailysangram.info/post/549323