১৫ মে ২০১৭, সোমবার, ৩:৩৯

মহাসড়ক নয় যেন চাঁদাবাজির হাট

ঢাকা টু দর্শনা। রাজধানী থেকে চুয়াডাঙ্গা জেলার এ শহরের দূরত্ব ২৪০ কিলোমিটারের মতো। গাবতলী বাস টার্মিনাল থেকে এই গন্তব্যে সড়কপথে আসা-যাওয়ায় অন্তত ৫টি জেলা অতিক্রম করতে হয়। এই ৫ জেলায় চাঁদাবাজির পয়েন্ট রয়েছে দ্বিগুণ। যাত্রীবাহী একটি পরিবহনকে কমপক্ষে ১০টি পয়েন্টে চাঁদা দিতে হচ্ছে এই রুটে। দেখা গেছে, গাবতলী থেকে দর্শনার উদ্দেশে ছেড়ে গিয়ে আবার ফিরে আসতে বিভিন্ন কোম্পানির ৫০টি চেয়ারকোচ থেকেই তোলা হচ্ছে প্রায় ৩৫ হাজার টাকা। তবে কোনো কোনো রুটে চাঁদার পরিমাণ কয়েকগুণ। বিশেষ করে উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলোতে এই চাঁদার পরিমাণ দিন দিন পরিবহন সংশ্লিষ্টদের জন্য অসহনীয় হয়ে ওঠছে। তাদের ভাষ্য, শুধু বগুড়া জেলাতেই চাঁদাবাজি হয় মাসে কোটি টাকা। প্রাপ্ত তথ্যমতে, উত্তর ও দক্ষিণবঙ্গের প্রবেশদ্বার গাবতলী বাস টার্মিনাল থেকে দেশের এ দুই অঞ্চলে প্রতিদিন অন্তত ২ হাজার যাত্রীবাসী বাস ছেড়ে যাচ্ছে। ছেড়ে যাচ্ছে ৩৮ জেলায়। গন্তব্যে পৌঁছে দিয়ে নির্দিষ্ট সময় পর ফিরে আসছে টার্মিনালে। রাত-দিন ছুটে চলছে দূরপাল্লার এ বাসগুলো। কিন্তু এ ছুটে চলা মোটেই নির্বিঘ্ন নয়। পয়েন্টে পয়েন্টে গুনতে হচ্ছে অবৈধ চাঁদা। চাঁদাবাজদের দৌরাত্ম্যে অতিষ্ঠ পরিবহন মালিকরা। কিন্তু কিছুই করার নেই তাদের। ক্ষুব্ধ হলেও অসহায়। সড়কে গাড়ি চললে চাঁদা দিতে হবে- এটাই যেনো নিয়ম। মহাসড়ক যেন চাঁদাবাজির হাট। চাঁদার পরিমাণ নির্ধারিত। সুযোগ নেই দেন-দরবারের। দীর্ঘ অনুসন্ধানে দেখা গেছে, যাত্রীবাহী বাসগুলো থেকে প্রতিদিন অন্তত দেড় থেকে দুই কোটি টাকার অবৈধ চাঁদা তুলছে চাঁদাবাজরা। ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় নেতাকর্মী, শ্রমিক ইউনিয়নের নামে তোলা হচ্ছে এই টাকা। পরিবহন সংশ্লিষ্টরা বলছেন, তৃণমূল থেকে শুরু করে শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের পকেট ভরছে এই টাকায়। এছাড়া বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন বাহিনীও চাঁদা আদায় করে থাকে। দূরপাল্লার বাসের চালক-সুপারভাইজার-হেলপার এবং পরিবহন সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ব্যক্তিবর্গ এসব তথ্য দিয়েছেন।
জানা গেছে, উত্তরাঞ্চলের ১৬ জেলায় গাবতলী বাস টার্মিনাল থেকে দূরপাল্লার বাস ছেড়ে যায়। প্রত্যেক জেলায় প্রবেশ করলেই নির্ধারিত চাঁদা দিতে হয়। এসব জেলার বিভিন্ন পয়েন্ট থেকে এই চাঁদা তোলা হয়। কোনো জেলায় যেকোনো একটি পয়েন্টে ধরলেই চাঁদা দিতে বাধ্য থাকেন সংশ্লিষ্ট পরিবহন। সে হিসেবে বিভিন্ন গন্তব্যে পৌঁছতে চাঁদার পরিমাণ কম-বেশি হয়। অনুসন্ধানে জানা গেছে, ঢাকা থেকে দিনাজপুর রুটে প্রতি বাসে চাঁদার পরিমাণ দাঁড়ায় ৫৩০ টাকা। এর বাইরে দিনাজপুরের মোহনপুর টোলে লাগে ২০ টাকা এবং ফুলবাড়ী রেলগেটে লাগে আরো ২০ টাকা। ঠাকুরগাঁও যেতে চাঁদা দিতে হয় ১০২০ টাকা। বিভিন্নস্থানে নীলফামারীগামী বাসের চাঁদা ১০২০ টাকা। নীলফামারীর চিরিরবন্দরে গেলে চাঁদা দিতে হয় ৮৫০ টাকা। এভাবে রংপুরে ৪১০ টাকা, কুড়িগ্রামে ১২৩০ টাকা। এ রুটে লালমনিরহাটের মোস্তাফি নামক স্থানে দিতে হয় ৭০ টাকা, বড়বাড়ি ৫০ টাকা, ফকিরের তকেয়ায় ২০ টাকা, কুড়িগ্রামের কাঁঠালবাড়িতে আরো ৩০ টাকা দিতে হয়। পঞ্চগড়ে ১৪৪০ টাকা, দিনাজপুরের সেতাবগঞ্জে ৬১০ টাকা, লালমনিরহাটের বুড়িমারী পৌঁছতে চাঁদা লাগে ১৫০০ টাকা, নীলফামারীর ডিমলাগামী বাসে চাঁদা দিতে হয় ১১০০ টাকা, বগুড়ায় ২০০ টাকা, তার আগে বগুড়ার শেরপুরে দিতে হয় ৭০ টাকা। বিভিন্ন রুটে যাওয়ার সময় গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ পার হওয়ার সময় ৩০ টাকা দিনাজপুরের ফুলবাড়ী ৫০ টাকা, ঘোড়াঘাটে ২০ টাকা চাঁদা দিতে হয়।
গাবতলী থেকে খুলনাগামী পরিবহনকে খুব বেশি চাঁদা দিতে হয় না। এই রুটে খরচ বলতে গাবতলী থেকে ছেড়ে যাওয়ার সময় টার্মিনালে দিতে হয় ৮০ টাকা। যা সবগুলো বাসকেই দিতে হয়। এছাড়া কামারখালী টোলে দিতে হয় ৯০ টাকা। তবে খুলনা থেকে ঢাকায় ফিরতে অন্তত ১৫টি পয়েন্টে চাঁদার টাকা গুনতে হয় সংশ্লিষ্ট বাসের সুপারভাইজারকে। এসব পয়েন্টে সর্বনিম্ন ৫ টাকা থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ দেড়শ’ টাকা চাঁদা দিতে হয়। এই রুটে চলাচলকারী একটি দূরপাল্লার বাসের সুপারভাইজারের দেয়া তথ্যমতে, খুলনার নতুন রাস্তায় ৫ টাকা, দৌলতপুরে ৫ টাকা, ফুলবাড়ী ৫ টাকা, ফুলতলায় ৫ টাকা, যশোর নওয়াপাড়ায় ২০ টাকা, যশোর নিউমার্কেটে ২০ টাকা, ঝিনাইদহের কালীগঞ্জে ৬০ টাকা, কালীগঞ্জ-ঝিনাইদহের মধ্যবর্তী বিষয়খালীতে ১০ টাকা, ঝিনাইদহে ১২৫ টাকা, ঝিনাইদহের হাটগোপালপুরে ১০ টাকা। মাগুরা শহরের আধা কিলোমিটার দূরত্বে চাঁদা দিতে হয় দু’বার। প্রথমবার মাগুরার ঢাকা রোডে ৩০ টাকা, টার্মিনালে আরো ৩০ টাকা। এ রুটের কামারখালীতে টোল ৯০ টাকা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক সুপারভাইজার বলেন, এই রুটে আগে চাঁদা দিতে হতো খুলনাতে ৩০ টাকা, যশোরে ১৮ টাকা এবং মাগুরায় ৩০ টাকা। এর বাইরে কামারখালীতে টোল ছিল ৬৫ টাকা। এখন বেড়েছে চাঁদাবাজির স্পট। প্রথম দফায় কামারখালীর টোল বেড়েছে ৭৫। এখন এই টোলের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৯০ টাকা। আগে গাবতলী টার্মিনালে দিতে হতো ৩০ টাকা আর এখন দিতে হয় ৮০ টাকা। আরেকটি সূত্রের দেয়া তথ্যমতে, খুলনা টার্মিনালে প্রতিটি লোকাল বাসকে দিতে ১২০ টাকা। এছাড়া যশোর নিউমার্কেটে ১০০ টাকা, চাচড়া ৪০ টাকা, ঝিকরগাছা ২০ টাকা এবং ফরিদপুর মোড়ে ৫০ টাকা।
ঢাকা থেকে চুয়াডাঙ্গার দর্শনার উদ্দেশে ছেড়ে যাওয়া বাস প্রতি চাঁদার পরিমাণ ফেরি বকশিশ ১০, কামারখালী টোল ৯০ টাকা। তবে ফিরতি পথে অন্তত ১০টি পয়েন্টে চাঁদা দিতে হয়। এ রুটে দর্শনায় ২০ টাকা, খালিশপুর ১০ টাকা, কোটচাঁদপুর ৪০ টাকা, কালীগঞ্জ ৬০ টাকা, বিষয়খালী ১০ টাকা, ঝিনাইদহে ১৩০ টাকা, হাটগোপালপুরে ১০ টাকা এবং মাগুরার দু’পয়েন্টে ৬০ টাকা চাঁদা দিতে হয়।
মেহেরপুর-চুয়াডাঙ্গা-ঢাকা রুটে চাঁদার পরিমাণ মেহেরপুরে ১০ টাকা, চুয়াডাঙ্গায় ৪০ টাকা, সাধুহাটিতে ১০ টাকা, ঝিনাইদহে ১৩০ টাকা, হাটগোপালপুরে ১০ টাকা, মাগুরার দু’স্থানে ৬০ টাকা। কুষ্টিয়া থেকে ঢাকা ছেড়ে আসা প্রতিটি বাসে কুষ্টিয়াতে দিতে হয় ২২০ টাকা চাঁদা। এ জেলা থেকে আলাদা আলাদা রুটে চাঁদার পরিমাণের কমবেশি হয়। নাটোরের বনপাড়া হয়ে ঢাকায় আসলে বনপাড়ায় দিতে হয় ১৫০ টাকা, মোলাডুলি রেলগেটে আরো ৫০ টাকা। শৈলকুপা থেকে কুষ্টিয়া হয়ে একই রুটে বাড়তি চাঁদা যোগ হয়। শৈলকুপার গাড়াগঞ্জে চাঁদা গুনতে হয় অতিরিক্ত ১২০ টাকা। কুষ্টিয়া থেকে ছেড়ে আসা পরিবহন রাজবাড়ী হয়ে ঢাকায় প্রবেশ করলে ২২০ টাকার সঙ্গে এ জেলায় যোগ হয় আরো ২৭০ টাকা। সাতক্ষীরা থেকে আসা বাসগুলোকেও নির্ধারিত চাঁদা দিতে হয়।
ঢাকা থেকে সরাসরি নাটোরগামী বাসে গাবতলী টার্মিনালে আদায় করা চাঁদার পরিমাণ ৫৭০ টাকা। আবার ঢাকায় ফিরতি পথে নাটোরে দিতে হয় ৩১০ টাকা। এছাড়া উভয়মুখী বনপাড়ায় দিতে হয় আরো ২০ টাকা। ইশ্বরদী থেকে ঢাকাগামী বাসে ঈশ্বরদীতে ২৭০ টাকা, রূপপুরে ৫০ টাকা, মোলাডুলি ৫০ টাকা, বনপাড়া ১৫০ টাকা এবং দাশুড়িয়ায় আরো ৪০ টাকা চাঁদা দিতে হয়। রাজশাহী-ঢাকা রুটে দূরপাল্লার পরিবহনে চাঁদার পরিমাণ রাজশাহীতে ৪১০ টাকা, রাজশাহীর পুঠিয়ায় ২০ টাকা, নাটোরের বনপাড়ায় ১৫০ টাকা। ঢাকা-বরিশাল রুটে চাঁদা দিতে হয় ফরিদপুর মোড়ে ৫০ টাকা, মাদারীপুরে ২০ টাকা। এছাড়া আরো কিছু রুট আছে যেখানে যত্রতত্র চাঁদাবাজি হচ্ছে।
গাবতলীতে অবস্থিত একটি দূরপাল্লার পরিবহনের কাউন্টারে কর্মরত জেলাল নামে একব্যক্তি এসব চাঁদাবাজি নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, চাঁদাবাজি সবসময় ছিল। তবে বিভিন্ন রুটে আগের থেকে চাঁদার পরিমাণ কয়েকগুণ বেড়েছে। তিনি এই প্রতিবেদককে বলেন, এ সংক্রান্ত রিপোর্ট করে কোনো লাভ নেই। এ টাকা ভাগ-বাটোয়ারা হয়ে স্থানীয় পাতি নেতা থেকে শুরু করে কেন্দ্রের প্রভাবশালী নেতাদের পকেটে চলে যায়। এদিকে গাবতলীর বাস-ট্রাক ওনার্স এসোসিয়েশনের সভাপতি মো. সালাউদ্দিন জানান, গাবতলী থেকে ২০০-২৫০ কোম্পানির ব্যানারে উত্তর ও দক্ষিণবঙ্গের ৩৮ জেলায় দূরপাল্লার পরিবহন ছেড়ে যায়। এরমধ্যে দক্ষিণবঙ্গের ২২ জেলা এবং উত্তরবঙ্গের ১৬ জেলা। তিনি জানান, তাদের হিসাব মতো ১৬০০’র মতো বাস ছেড়ে যায়। তবে এর কমবেশিও হতে পারে। আরেকটি সূত্র জানায়, এর বাইরে আরো ৩০০-৪০০ দূরপাল্লার বাস রয়েছে যেগুলো এসোসিয়েশনভুক্ত নয়। চাঁদাবাজির ব্যাপারে মো. সালাউদ্দিন বলেন, ঢাকা ছাড়ার পর যে চাঁদাবাজিগুলো হয় সে ব্যাপারে তার জানা নেই। বলেন, যারা রাস্তায় চলাচল করেন তারাই বলতে পারবেন।

 

http://www.mzamin.com/article.php?mzamin=65474&cat=2/