১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, রবিবার, ৩:৩২

বুয়েট ছাত্র ফারদিন হত্যা মামলার তদন্ত

বছর পার হলেও অগ্রগতি শূন্য

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) মেধাবী ছাত্র ফারদিন নূর পরশ হত্যা মামলায় এক বছর পেরিয়ে গেলেও তদন্তের অগ্রগতি প্রায় শূন্য।

অধিকতর তদন্তের দায়িত্ব পাওয়ার ১০ মাস পর ৬ ফেব্রুয়ারি সিআইডির তদন্ত কর্মকর্তা ইন্সপেক্টর বেলায়েত হোসেন বাদীকে হোয়াটসঅ্যাপে এসএমএস করেন। এর মাধ্যমে ফারদিনের বিশ্ববিদ্যালয়ের পূর্ণ নাম, বিভাগ, শাখা, রোল নম্বর, হলের নাম এবং তার আইডি কার্ডের তথ্য জানতে চান।

বিষয়টিকে বিস্ময়কর উল্লেখ করে বাদী বলেন, প্রাথমিক তথ্যগুলো যদি তদন্ত কর্মকর্তা এখন জানতে চান, তাহলে এতদিন তিনি কী তদন্ত করলেন? তাহলে কী আমি ছেলে হত্যার বিচার পাব না? এই মামলাটিও কী সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনী হত্যা মামলার ভাগ্য বরণ করবে?

এ বিষয়ে জানতে চাইলে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা বেলায়েত হোসেন শনিবার যুগান্তরকে বলেন, ‘মামলাটির তদন্তে উল্লেখযোগ্য কোনো অগ্রগতি নেই। অগ্রগতি থাকলে বাদী এবং সাংবাদিকদের ডেকে নিশ্চয়ই সংবাদ সম্মেলন করতাম।’

এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘ইতোমধ্যেই সিআইডি থেকে আমার বদলির আদেশ এসেছে। শিগগিরই আমি একটি জেলায় যোগদান করব। তাই ফারদিন হত্যা মামলাটির জন্য নতুন তদন্ত কর্মকর্তা নিয়োগ করা হবে।’

ফারদিন হত্যা মামলার অবস্থা সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনী হত্যা মামলার পরিণতি হতে পারে বলে আশঙ্কা ফারদিনের বাবা ও মামলার বাদী নূরউদ্দিন রানার। তার দাবি, তদন্ত সংস্থাই অপহরণকারী ও খুনিদের আড়াল করে রাখছে।

তিনি বলেন, ‘ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এটি একটি হত্যাকাণ্ড। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) কীভাবে এটিকে আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দিল তা আমার বোধগম্য নয়। গত বছরের ৬ ফেব্রুয়ারি আদালতে দেওয়া ডিবির প্রতিবেদনের ওপর আমি নারাজি আবেদন দিয়েছি।

আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে গত বছরের ১৬ এপ্রিল মামলাটি অধিকতর তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয় ক্রিমিনাল ইনভেস্টিশন ডিপার্টমেন্টকে (সিআইডি)। কিন্তু তদন্তের নামে সিআইডি শুধু কালক্ষেপণ করছে।

প্রতিবেদন দাখিলের জন্য এ পর্যন্ত ১০ বার সময় প্রার্থনা করেছে সিআইডি। আদালত প্রতিবারই সময় বাড়ানোর আবেদন মঞ্জুর করেছেন। প্রতিবেদন দাখিলের জন্য ২৯ ফেব্রুয়ারি ফের সময় নির্ধারণ করেছেন আদালত।’

বুয়েটে ছাত্ররাজনীতির বিপক্ষে অবস্থান ছিল ফারদিনের। ছাত্রলীগের হাতে নিহত বুয়েট ছাত্র আবরার ফাহাদের স্মৃতি ধরে রাখতে আর্কাইভ তৈরির অন্যতম উদ্যোক্তাও ছিলেন ফারদিন।

ফারদিন ছিলেন ক্লাস রিপ্রেজেন্টেটিভ (সিআর)। ২০২২ সালের ১৫ আগস্ট বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের অনুষ্ঠান প্রতিহত করতে সাধারণ শিক্ষার্থীরা যে ‘লাউড অ্যান্ড ক্লিয়ার’ ক্যাম্পেইন শুরু হয়-ফারদিন ছিলেন এর অন্যতম উদ্যোক্তা।

ফারদিন নূরের ‘আমিই আবরার’ এবং ‘হাউ টু সারভাইভ ইন দিস কান্ট্রি’ লিখে ফারদিন তার প্রোফাইল পিকচার পরিবর্তন করেন। আবরার ফাহাদ হত্যার প্রেক্ষাপটে করা তার প্রোফাইল পিকচার (যাতে তিন বানরের চোখ, কান ও মুখবন্ধ কার্টুন) ভাইরাল হয়েছিল।

উদ্ভাস কোচিং সেন্টারের শিক্ষক ও বিটিভির তুখোড় বিতার্কিক ছিলেন ফারদিন। ফারদিনের লাশ উদ্ধারের কয়েকদিন পরই স্পেনের মাদ্রিদে অনুষ্ঠিত হয় ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটিজ ডিবেটিং চ্যাম্পিয়নশিপ। সেখানে অংশগ্রহণের কথা ছিল ফারদিনের। এর আগেই ২০২২ সালের ৪ নভেম্বর নিখোঁজের ৩ দিন পর ৭ নভেম্বর শীতলক্ষ্যা নদীর তীর থেকে ফারদিনের লাশ উদ্ধার হয়।

পরদিন ৮ নভেম্বর নারায়ণগঞ্জ ভিক্টোরিয়া হাসপাতালের ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসক ফরহাদ হোসেন সাংবাদিকদের জানান, ‘ফারদিনের বুকে ও মাথায় বেশ কয়েকটি আঘাতের চিহ্ন পাওয়া গেছে। ইন্টারনাল হেমারেজে রক্তক্ষরণ হয়ে প্রাণ হারিয়েছেন ভিকটিম। এটি অবশ্যই হত্যাকাণ্ড।’

কান্নাজড়িত কণ্ঠে মামলার বাদী নূরউদ্দিন রানা বলেন, ‘ময়নাতদন্তের ভিত্তিতেই আমি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ডের অভিযোগে মামলাটি করেছিলাম। প্রথম দুই-আড়াই মাস খুনিদের শনাক্ত করার তৎপরতায় ডিবি ও র‌্যাব ভিন্ন ভিন্ন তথ্য দিয়েছিল। পরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কী কারণে ‘ভিকটিম আত্মহত্যা করেছ’ দাবি করল, তা আমার বোধগম্য নয়।

তিনি বলেন, ফারদিন হত্যাকাণ্ডে সংক্ষুব্ধ হয়ে আন্দোলনে ছিলেন বুয়েটের শিক্ষার্থীরা। ভীতি প্রদর্শনের মাধ্যমে তাদের আন্দোলন থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। আবরার হত্যার তদন্ত নিয়ে যা হচ্ছে, তা ভাবতেই চোখে অন্ধকার নেমে আসে। হৃদয় ভেঙেচুরে যায়-বলেই কাঁদতে শুরু করেন হতভাগা এই পিতা।

নূরউদ্দিন রানা জানান, নিখোঁজের পর ফারদিনের অস্বাভাবিক মুভমেন্টের মোবাইল ডাটা প্রকাশ করলেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কোনো সংস্থাই সামনে আনেনি শহরের গুরুত্বপূর্ণ অংশের সিসিটিভি ফুটেজ। নিখোঁজের দিন রাতে ফারদিনকে যাত্রাবাড়ীতে লেগুনায় উঠতে দেখা গেছে।

ওই লেগুনায় আগে থেকে কারা উঠেছিল সেই ফুটেজ প্রকাশ্যে আসেনি। একই দিনের ওই দৃশ্যপটের ২০-২৫ মিনিট আগের ফুটেজ প্রকাশ করলেই লেগুনায় থাকা ৪-৫ জনের পরিচয় মিলবে। তারাই ফারদিনকে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে বুকে-পিঠে আঘাত করে হত্যা করেছে।

রানার অভিযোগ, চাঞ্চল্যকর এ হত্যাকাণ্ডের খুনিদের বাঁচাতে আড়াল করা হয়েছে যাত্রাবাড়ীর টেম্পো স্ট্যান্ডের ২০২২ সালের ৪ নভেম্বরের পুরো সিসিটিভি ফুটেজ।

নূরউদ্দিন রানার দাবি, রামপুরা থেকে ফারদিনকে অপহরণ করে হত্যার উদ্দেশ্যে পুরান ঢাকার জনসন রোড, বাবুবাজার ব্রিজ, কেরানীগঞ্জ ব্রিজ এলাকায় নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। গুলিস্তানের পাতাল মার্কেট এলাকায় টর্চার করা হয়েছে তার ছেলেকে।

পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ডকে আত্মহত্যায় রূপ দিতে ফারদিনের একটি সিঙ্গেল মুভমেন্টের দৃশ্য ধারণ করতেই অপহরণের হাত থেকে সামান্য সময়ের জন্য মুক্তি দিয়েছিল ছেলেটিকে। তিনি বলেন, তদন্তে নেমে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী শুধু বিভ্রান্তিকর তথ্য দিয়েছে। যা আমার পরিবারকে আঘাত করেছে।

তদন্তসংশ্লিষ্টদের প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করে ফারদিনের বাবা বলেন, ‘পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ডকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার কৌশল বেছে নিয়েছিল খুনিরা। অপহরণের পর ফারদিনের মোবাইলটি ব্যবহার করে ডাটা তৈরি করা হয়। রাত প্রায় পৌনে ৩টায় বাসা অভিমুখী যাত্রাবাড়ী টেম্পো স্ট্যান্ডের কাছে ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল ভিকটিমের সিঙ্গেল মুভমেন্ট তৈরির অংশ হিসাবে।

ওদিকে আগে থেকে টেম্পোতে উঠে থাকা খুনিচক্র ফারদিনকে পুনরায় তাদের কবজায় নেয়। পরে অজ্ঞাত কোনো স্থানে নিয়ে ছেলেটিকে হত্যা করে মোবাইলটি পুনরায় লাশের পকেটে ঢুকিয়ে রেখে শীতলক্ষ্যা নদীর পাড়ে ফেলে রাখা হয়। খুনিরা একটি স্মার্ট কিলিং মিশন সম্পন্ন করেছে।

https://www.jugantor.com/todays-paper/last-page/775520