১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, শনিবার, ১০:১৫

লক্কড়ঝক্কড় বাস বন্ধের দাবি

প্রায় আড়াই কোটি মানুষের নগরী রাজধানী ঢাকা। এই রাজধানীতে যোগাযোগে ইতোমধ্যেই এসেছে নানা পরিবর্তন। ঢাকার যনজট কমাতে চালু হয়েছে আধুনিক গণপরিবহন মেট্রোরেল। উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত চালু হওয়ার পর থেকে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে। যারা আগে এই রুটে বাসে অথবা অন্যকোনোভাবে যাতায়াত করতেন তারা এখন এই রুটে যাতায়াত করেন মেট্রোরেলে। যানজট কমানো ও সড়ক যোগাযোগ সহজ করার জন্য চালু হয়েছে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে। এতোকিছুর পরও এখনো ঢাকার রাজপথে চলছে লক্কড় ঝক্কড় বাস। যৌবন হারানো এসব যানবাহনে সামান্য কলকব্জা বদলে আর রঙের প্রলেপ দিয়ে ফিটনেস দেখানো হচ্ছে। এতে করে হয়রানি বাড়ছে নাগরবাসীর। নামছে না নতুন বাস। ইতোমধ্যেই রাজধানী থেকে লক্কড়-ঝক্কড় বাস বন্ধের দাবি উঠেছে। এসব বাস নগরবাসীকে সেবাতো দিতেই পারে না বরং রাজধানীর রাস্তায় সৃষ্টি করে দীর্ঘ যানজট। মেট্রোরেল ও এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে চালুর পর সময় এসেছে ঢাকার রাস্তা থেকে লক্কড়-ঝক্কড় বাস উঠিয়ে নতুন বাস চালু করার। এমনটাই জানালেন পরিবহন বিশেষজ্ঞরা।

ফিটনেস না থাকলেও ট্রাফিক পুলিশের সামনেই রাজপথে চলছে এসব যানবাহন। অথচ খালি চোখেই ধরা পড়ছে বাসগুলোর বেহাল অবস্থা। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ত্রুটিপূর্ণ এসব বাহনে যাতায়াতে বাধ্য হচ্ছে মানুষ। ভুক্তভোগীরা জানিয়েছেন, এসব গাড়িই সড়কে বিশৃঙ্খলার প্রধান কারণ। যত্রতত্র বিকল হয়ে সৃষ্টি হচ্ছে যানজট। ফলে প্রতিনিয়ত ঘটছে দুর্ঘটনা। এতে কেউ হারাচ্ছেন জীবন; আবার কেউ অঙ্গ হারিয়ে বোঝা হচ্ছেন পরিবারে।

সড়ক পরিবহন আইন, ২০১৮-এর ধারা-২৫ অনুযায়ী ত্রুটিমুক্ত যানবাহন চলাচলের বাধ্যবাধকতা এবং এর ব্যত্যয়ে আইনের ধারা ৭৫ অনুযায়ী কারাদ- বা অর্থদ- বা উভয় দ-ের বিধান রয়েছে। তবে এ আইন খাতাকলমেই সীমাবদ্ধ থাকছে। বাস্তবে প্রয়োগ হচ্ছে কম। ক্ষেত্রবিশেষে প্রয়োগ হলেও শৃঙ্খলা ফেরাতে ব্যর্থ ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা।

ডলার সঙ্কটের কারণে দেশে নতুন গাড়ি বিক্রি এবং নিবন্ধনে ভাটার টান দেখা দিয়েছে। ২০২৩ সালে দেশে ব্যক্তিগত গাড়ি বা প্রাইভেট কার, বাস, ট্রাক, পিকআপসহ প্রায় সব ধরনের নতুন যানবাহনের নিবন্ধন আগের বছরের তুলনায় ৩৮ শতাংশ কমে গেছে। ডলার সঙ্কটে অর্থনৈতিক মন্দায় নতুন গাড়ি ক্রয়-বিক্রয়ও কমে গেছে।

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) ও যানবাহন বিক্রেতারা বলছেন, নিবন্ধন কমে যাওয়া মানে বিক্রি কমে যাওয়া। বিক্রি কমার পেছনে মোটাদাগে তিনটি কারণ রয়েছে। এক, চড়া মূল্যস্ফীতির কারণে সংসারের খরচের যোগান দিতে ব্যয় বেড়ে যাওয়া। এতে নতুন গাড়ি কেনার আগ্রহ কমেছে। দুই, ডলারের মূল্যবৃদ্ধিতে গাড়ির দামও বেড়ে গেছে। তিন, নির্বাচনের বছরে বিনিয়োগে অনিশ্চয়তা। নির্বাচন হয়ে গেলেও এখনো সে অনিশ্চয়তা কাটেনি বরং বেড়েছে।

‘গাড়ি নিবন্ধন ব্যাপকভাবে কমে যাওয়া কীসের ইঙ্গিত দেয়’ জানতে চাইলে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক মো. হাদিউজ্জামান বলেন, এর কিছু নেতিবাচক প্রভাব আছে। মানুষের আর্থিক সংগতি কমে যাওয়ায় নতুন গাড়ি কিনছেন না। নতুন গাড়ি যদি সড়কে না নামে, পুরোনো গাড়ি চালাতে থাকলে সেটি সড়ক নিরাপত্তার জন্য বড় হুমকি। ফলে যানজট, দুর্ঘটনা ও পরিবেশদূষণ বেড়ে যাবে।

বিআরটিএর হিসাব অনুযায়ী, দেশে ২০২২ সালে ৫ লাখ ৭৮ হাজার ১৫১টি গাড়ি নিবন্ধিত হয়েছিল। ২০২৩ সালে এ সংখ্যাটি কমে দাঁড়িয়েছে ৩ লাখ ৬০ হাজার ৮৬১টিতে। অর্থাৎ এক বছরে দেশে ২ লাখ ১৭ হাজার ২৯০টি যানবাহনের নিবন্ধন কমেছে।

বিআরটিএ যানবাহন নিবন্ধনের তথ্য দেয় ১৯টি শ্রেণিতে। এর বাইরে ‘অন্যান্য’ নামের একটি শ্রেণি রয়েছে। দেখা যায়, শুধু অটোরিকশা নিবন্ধন বেড়েছে। বাকি সব শ্রেণিতে নিবন্ধন কমেছে। বাণিজ্যিক যানবাহনসহ মোটরসাইকেল বিপণনকারী এসিআই মোটরস লিমিটেডের নির্বাহী পরিচালক সুব্রত রঞ্জন দাস জানান, ডলারের দাম, মূল্যস্ফীতি, আমদানির জন্য ঋণপত্র (এলসি) খুলতে সমস্যা, নির্বাচন ইস্যুতে রাজনৈতিক অস্থিরতা এসবের সম্মিলিত প্রভাবে যানবাহন বিক্রি কম হয়েছে।

জানা যায়, রাজধানী ঢাকা মোটর সাইকেলের বাড়বাড়ন্ত বেড়েছে কয়েকগুণ। গত কয়েক বছর ধরে দেশে বছর বছর মোটরসাইকেল বিক্রি বাড়ছিল। তবে এবার ধস নেমেছে। বিআরটিএর হিসাবে ২০২২ সালে ৫ লাখের বেশি মোটরসাইকেল নিবন্ধিত হয়েছিল। ২০২৩ সালে বিক্রি হয়েছে তিন লাখের মতো। মোটরসাইকেল বিক্রেতারা জানান, ডলারের মূল্যবৃদ্ধির কারণে একেকটি মোটরসাইকেলের দাম বেড়েছে ১০ থেকে ৩০ হাজার টাকা। এ ছাড়া ইতিমধ্যে দু-একটি প্রতিষ্ঠান ১৬৫ সিসির (ইঞ্জিন ক্ষমতা) ওপরের মোটরসাইকেল বাজারে আনতে শুরু করেছে। আরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠানও আনবে। কিছু ক্রেতা বেশি সিসির মোটরসাইকেল কেনার অপেক্ষায় রয়েছেন। তবে সার্বিকভাবে মোটরসাইকেল বিক্রি কমে যাওয়ার কারণ মূল্যবৃদ্ধি ও মানুষের ওপর মূল্যস্ফীতির চাপ তৈরি হওয়া।

২০২২ সালের তুনলায় ২০২৩ সালে প্রাইভেট কার নিবন্ধন কমেছে ৩৫ শতাংশ। বিক্রেতারা বলছেন, ডলারের মূল্যবৃদ্ধি ও শুল্ক বাড়ায় একেকটি গাড়ির দাম ২ থেকে ৩ লাখ টাকা বেড়েছে। এর প্রভাব পড়েছে বিক্রিতে।

রাজধানীর মণিপুরিপাড়ার সংসদ অ্যাভিনিউয়ে গাড়ি কেনাবেচার প্রতিষ্ঠান রনি কারসের বিক্রয় কর্মকর্তা শুভন খান জানান, প্রাইভেট কার বিক্রি আগের চেয়ে কমে গেছে। এখন মানুষের হাতে টাকাপয়সা কম। তাই মানুষ গাড়ি কেনার পেছনে ব্যয় কম করছে। উচ্চবিত্তরা স্পোর্ট ইউটিলিটি ভেহিকেল (এসইউভি) কেনেন, যা জিপ নামে পরিচিত। ২০২৩ সালে এসইউভি নিবন্ধিত হয়েছে ৭ হাজার ৭৫৬টি, যা আগের বছরের চেয়ে ২ হাজার ৪৭৫টি কম। বিক্রেতারা বলছেন, সরকারি প্রকল্পে গাড়ি কেনা নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। এটিই বিক্রি কমে যাওয়ার একটি বড় কারণ। এর পাশাপাশি দাম বেড়ে যাওয়া এবং আমদানিতে ডলারের অভাব গাড়ির বাজারে প্রভাব ফেলেছে।
বাস, ট্রাক, পিকআপ, কাভার্ড ভ্যান ইত্যাদি বাণিজ্যিক যানবাহন নিবন্ধনে ভাটার টান ধরেছে। পরিবহন ব্যবসায়ীরা বলছেন, রাজধানীতে কয়েক বছর ধরে বাসের রুট পারমিট (নির্দিষ্ট পথে চলাচলের অনুমতি) দেওয়া বন্ধ আছে। এ জন্য নতুন বাস কম নামছে।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্যাহ বলেন, সারা বিশ্বের মতো দেশেও মন্দা পরিস্থিতি। টায়ার টিউব থেকে যানবাহনের সব ধরনের যন্ত্রাংশের দাম বাড়তি। তাই এই খাতে মুনাফা কমেছে। বিনিয়োগকারীরাও কম আসছেন। স্বাভাবিকভাবে এর প্রভাব পড়েছে বাস বিক্রিতে।

ট্রাক নিবন্ধন প্রায় অর্ধেকে নেমেছে। ২০২২ সালে সাড়ে ৪ হাজারের মতো ট্রাক নিবন্ধিত হয়েছিল। ২০২৩ সালে নেমেছে ২ হাজার ২৯২টিতে। তবে ব্যতিক্রম কেবল অটোরিকশা। বিআরটিএর হিসাব অনুযায়ী, ২০২২ সালের তুলনায় গত বছর বাড়তি এক হাজার ৬৫১টি অটোরিকশার নিবন্ধিত হয়েছে। এ সময় মোট ৯ হাজার ২৫৭টি অটোরিকশার নিবন্ধন করানো হয়। মূলত শিল্প ও সেবা খাতে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টির হার কমে যাওয়ায় তরুণদের অনেকে অটোরিকশা চালানোকে পেশা হিসেবে বেছে নিচ্ছেন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সামগ্রিকভাবে দেশের অর্থনীতি যে চাপে রয়েছে, তার একটি চিত্র যানবাহন নিবন্ধনের হিসাবে দেখা যায়।

রাজধানীতে চলাচলরত ফিটনেসবিহীন যানবাহনের প্রকৃত সংখ্যা কত, তার সঠিক হিসাব বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের কাছে (বিআরটিএ) নেই। বিআরটিএ সূত্র বলছে, বাস ও ট্রাক চলাচলের বয়সসীমা নির্ধারণ করে দেয়ার পর সংস্থাটি একটি তালিকা করেছে। এতে দেখা গেছে, ২০ বছরের সীমা নির্ধারণ করা হলে ৩৩ হাজার ১৭৪টি বাস-মিনিবাস রাস্তা থেকে উঠে যাবে। হিসাব করে দেখা যায়, বাস-মিনিবাসের প্রায় ৪১ শতাংশই ২০ বছরের পুরোনো। বাসের ভাড়া নির্ধারণ করার সময় ধরে নেয়া হয় একটি বাস সর্বোচ্চ ১০ বছর চলাচল করবে। এ সময়সীমার মধ্যেই ব্যাংক ঋণ পরিশোধ করার বিষয়টিও উল্লেখ করা হয়। অর্থাৎ ১০ বছর পর বাস আর বাণিজ্যিক কাজে ব্যবহার করার প্রয়োজন হবে না ধরে নিয়েই যাত্রীদের ভাড়া নির্ধারণ করা হয়।

কাউসার নামের এক যাত্রী বলেন, বাধ্য হয়েই লক্কড় ঝক্কড় গাড়িতে চড়তে হচ্ছে। এমন লক্কড়-ঝক্কড় বাস রাস্তায় যাতে চলতে না পারে, তা দেখার দায়িত্ব তো পুলিশের। কিন্তু পুলিশ রহস্যজনক কারণে কিছু বলে না, তাই এরা আমাদের কাছে থেকে ভাড়া ঠিকই নিচ্ছে কিন্তু সেবা দিচ্ছে না।

এদিকে, মোটরসাইকেলের বেপরোয়া গতি সড়কে বাড়ছে দুর্ঘটনা। এসব দুর্ঘটনায় বেশিরভাগই প্রাণ হারাচ্ছে উঠতি বয়সের ছেলেরা। অনেক ক্ষেত্রে শখের বাইক কেড়ে নিচ্ছে প্রাণ। ২০২৩ সালে ২০৩১টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় ২১৫২ জন নিহত ও ১৩৩৯ জন আহত হয়েছে। যা মোট দুর্ঘটনার ৩২ দশমিক ৪৩ শতাংশ, নিহতের ২৭ দশমিক ২৩ শতাংশ ও আহতের ১২ দশমিক ৯০ শতাংশ। বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির দুর্ঘটনা মনিটরিং সেলের বার্ষিক দুর্ঘটনা পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদনে এই তথ্য উঠে এসেছে। বিগত ৯ বছরে নিবন্ধিত যানবাহনের পাশাপাশি ছোট যানবাহন বিশেষ করে মোটরসাইকেল ও ইজিবাইকের সংখ্যা ৪ থেকে ৫ গুণ বৃদ্ধি পাওয়ার পাশাপাশি ইজিবাইক, মোটরসাইকেল ও ত্রি-হুইলার সরকারের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে জাতীয় ও আঞ্চলিক মহাসড়কে অবাধে চলাচলের কারণে সড়কে দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি বাড়ছে।

সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে কাজ করেন, এমন গবেষকরাও বলছেন, অন্য যানের চেয়ে মোটারসাইকেলের দুর্ঘটনার ঝুঁকি ২৯ গুণ বেশি। এর প্রধান কারণ বেপরোয়া গতি। এছাড়া দুর্বল অবকাঠামো ও ট্রাফিক ব্যবস্থা, আইন না জানা ও না মানার প্রবণতা, অপ্রাপ্তবয়স্ক ও অদক্ষ চালক, অন্য যানকে পিছে ফেলার চেষ্টা, হুটহাট লেন বদল, চলন্ত অবস্থায় ফোনে আলাপ, যথাযথ হেলমেট ব্যবহার না করা।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাক্সিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউট (এআরআই) তাদের গবেষণায় উঠে এসেছে, মোটরসাইকেলের কারণে সড়কে দুর্ঘটনা ক্রমেই বাড়ছে। বর্তমানে সড়কে যত হতাহতের ঘটনা ঘটছে, তার ৪০ শতাংশই মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় হচ্ছে। বেসরকারি সংস্থা রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দেশে ২০১৯ সালে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান ৯৪৫ জন। এর পরের বছর এই সংখ্যা বেড়ে হয় ১ হাজার ৪৬৩ জন। ২০২১ সালে প্রাণ হারান ২ হাজার ২১৪ জন। ২০২২ সালে এই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৩ হাজার ৯১ জন।

রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক সাইদুর রহমান বলেন, বাইক চালকদের ৫৮ শতাংশেরই বয়স ১৪-১৮ বছরের মধ্যে। শখ পূরণে অনেক অভিভাবকই কম বয়সী সন্তানদের হাতে আধুনিক মডেলের উচ্চগতির মোটরসাইকেল তুলে দিচ্ছেন। এই কিশোরদের অধিকাংশই কোনো নিয়ম মানে না। বেপরোয়াভাবে উচ্চগতিতে মোটরসাইকেল চালিয়ে দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছে তারা। এতে একদিকে তারা নিজেরা যেমন হতাহত হচ্ছে, অন্যদিকে তাদের কারণে আক্রান্ত হচ্ছেন সাধারণ পথচারীরাও। রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতায় থাকা মোটরসাইকেল চালকরাও বেপরোয়া। তারাও ট্রাফিক আইন মানতে চায় না, হেলমেট ছাড়াই বেপরোয়া গতিতে মোটরসাইকেল চালান। এই বেপরোয়া গতির কারণেই মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় হতাহতের সংখ্যা বেড়েই চলেছে।

সাইদুর রহমান জানান, দেশে নিবন্ধিত মোটরযানের প্রায় ৭১ শতাংশই মোটরসাইকেল। এই মোটরসাইকেল চলে গেছে দুই ধরনের লোকের কাছে। যাদের কেউ শখ করে মোটরসাইকেল ব্যবহার করেন, কেউ বাধ্য হয়ে। আর এদের অনেকেই হচ্ছেন অদক্ষ চালক। একটি মানসম্মত হেলমেট বাইক চালকের মৃত্যুঝুঁকি ৪৮ শতাংশ কমিয়ে আনতে পারে। কিন্তু বাইক চালকদের অধিকাংশের হেলমেট নিরাপদ না। তারা হেলমেটের নামে যা মাথায় দেয়, তাকে বড় জোর ‘প্লাস্টিকের ক্যাপ’ বলা যায়।

বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা প্রতিষ্ঠান এআরআইর সাবেক পরিচালক গণপরিবহন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক মো. হাদিউজ্জামান বলেন, আবদার পূরণে কিশোর-তরুণদের হাতে মোটরসাইকেল তুল দিচ্ছেন অভিভাবকরা। তরুণদের অনেকে দক্ষতা অর্জন না করে এবং নিয়ম না জেনেই মোটরসাইকেল নিয়ে মহাসড়কে উঠে যাচ্ছে। মহাসড়কে গিয়ে আবার সেটিকে তারা রেসিং ট্র‌্যাক বানিয়ে ফেলছে। সেসব রেসিংয়ের ভিডিও ধারণ করে সেগুলো আবার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্ট করা হচ্ছে। এসব ভিডিও দেখে প্রভাবিত হচ্ছেন আরও অনেকে। এতে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা বাড়ছে।

সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, নোটিস আর চিঠিতেই সীমাবদ্ধ বিআরটিএর কার্যক্রম। মাঝেমধ্যে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হলেও নেই মনিটরিং। বিআরটিএর ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার সময় সড়কে বের হয় না এসব লক্কড়-ঝক্কড় বাস। মোবাইল কোর্ট পরিচালনার সময় তারা আগেভাগেই জেনে যায়। সে সময় সড়কে গাড়ি কমে যায়। আবার মোবাইল কোর্ট উঠে গেলেই সড়কে দাপিয়ে বেড়ায় এসব বাস। এসব যানবাহন সড়কে চলছে ১৫ থেকে ২০ বছরের অধিক সময় ধরে।

পরিবহন বিশেষজ্ঞ ড. হাদিউজ্জামান বলেন, সাধারণত একটা সাবের ফিটনেসের সময়কাল ১০ বছর। কিন্তু ঢাকা শহরে ১০ বছর পেরিয়ে যাওয়া অসংখ্য বাস চলছে। তারা চলছে কীভাবে। তারা যে বলছে লোকসানে আছে, এটা একেবারেই খোঁড়া যুক্তি।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, সারাদেশে এখন প্রায় ৫ লাখ ফিটনেসবিহীন গাড়ি চলছে। স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে হলে গণপরিবহনকে স্মার্ট হতে হবে। স্মার্ট গণপরিবহনের বিকল্প নেই। গণপরিহনের মান উন্নত করতে হবে। সরকার হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করেছে মেট্রোরেল ও এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ করার জন্য কিন্ত মাত্র ৫ হাজার কোটি টাকা খরচ করলেই ঢাকার রাস্তার গণপরিবহনের চেহারা পাল্টে যাবে। এখানে সরকারের সদিচ্ছার অভাব রয়েছে। সরকার চাইলেই সবকিছু সম্ভব। তেমনি সরকার চাইলেই সড়কে ফিটনেসবিহীন গণপরিবহন বন্ধ করা সম্ভব।

বায়ুমন্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র (ক্যাপস) প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার বলেন, আমাদের মেজর বায়ুদূষণের ৬টা উৎস রয়েছে। এর মধ্যে একটি লক্কড়-ঝক্কড় মেয়াদোত্তীর্ণ যানবাহন। এই যানবাহনগুলো আমাদের ১৫ ভাগ বায়ু দূষণের জন্য দায়ী। যেসব যানবাহন বায়ুদূষণের জন্য দায়ী তার বেশিরভাগই গণপরিবহন। ব্যক্তিগত গাড়িগুলো তুলনামূলকভাবে ফিটনেস থাকার কারণে বায়ুদূষণ হয় না।

বিআরটিএ চেয়ারম্যান নুর মোহাম্মদ মজুমদার বলেন, মেয়াদ উত্তীর্ণ গাড়িগুলো আর রাস্তায় চলবে না। সেই ক্ষেত্রে গাড়ি রাস্তায় চললে ধরা পরলে আমরা সেগুলো আমরা ডাম্পিং করে ফেলবো। এর পরে এই ডাম্পিং গাড়িগুলো আমরা স্কেপ করে ফেলবো। এটাতো মানসিকতার বিষয়। একটা গাড়ি সুন্দর ফিটফাট হলে যাত্রীরা গাড়িতে উঠবে। চলাচল করেও শান্তি পাবে।

https://dailyinqilab.com/national/article/639281