১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, শনিবার, ৯:৫৩

অপ্রতিরোধ্য কিশোর গ্যাং ছড়িয়ে পড়েছে সারাদেশে

চলতি মাসের শুরুতে কক্সবাজারে ‘কিশোর গ্যাংয়ের হাত থেকে নানিকে বাঁচাতে গিয়ে আলাউদ্দিন (১৫) নামে এক কিশোর খুন হয়। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, আলাউদ্দিনের নানি একজন চায়ের দোকানি। তার দোকানে প্রায় সময়ই চা-নাস্তা খেয়ে টাকা পরিশোধ করে না এলাকার কয়েকজন কিশোর। পাওনা টাকা চাওয়ায় ওই নারীকে ছুরিকাঘাত করে তারা। নানিকে বাঁচাতে এগিয়ে এলে আলাউদ্দিনকে ছুরি মেরে হত্যা করে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা। এভাবে কিছুদিন পরপরই বিভিন্ন এলাকায় কিশোর গ্যাংয়ের হাতে চাঞ্চল্যকর হত্যাকান্ডের ঘটনা ঘটছে। একসময় রাজধানী কেন্দ্রিক গড়ে ওঠা অপ্রতিরোধ্য এই গ্যাং কালচার ছড়িয়ে পড়েছে সারাদেশে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, খোদ রাজধানীতেই ভয়ংকর কিশোর গ্যাংয়ের সংখ্যা অন্তত ৮০। এসব গ্যাং গ্রুপের সদস্য সংখ্যা কমপক্ষে ৫ হাজার। কিশোর গ্যাংয়ের সঙ্গে কিছু কিশোরীও জড়িয়ে পড়ছে। এদের হাতে দেশীয় অস্ত্রের পাশাপাশি রয়েছে বিদেশী অবৈধ অস্ত্র। গত বছর (২০২৩) ঢাকায় কিশোর গ্যাংয়ের হাতে খুন হয় ২৫ জন। ২০২২ সালে ৩০ জন।

অনুসন্ধ্যানে জানা গেছে, অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠা কিশোর গ্যাং সারাদেশে বেপরোয়া হয়ে উঠছে। একে অপরকে ক্ষমতা দেখাতে কয়েকজন মিলে পাড়া-মহল্লায় বিভিন্ন নামে গ্যাং গ্রুপ গড়ে তুলছে। রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় নানা অপরাধমূলক কর্মকা-েও ব্যবহৃত হচ্ছে কিশোররা। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাদের অপরাধের ধরনও পাল্টে যাচ্ছে। এলাকায় আধিপত্য বিস্তার, সিনিয়র-জুনিয়র দ্বন্দ্ব, চাঁদাবাজি, চুরি-ছিনতাই, মাদক ও প্রেম নিয়ে বিরোধের জেরে তারা অহরহ সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ছে। অর্থের বিনিময়ে অর্থদাতার প্রতিপক্ষের ওপরও আক্রমণ চালাচ্ছে উঠতি বয়সী ছেলেরা। এমনকি সামান্য অর্থের বিনিময়ে খুনোখুনিতেও জড়িয়ে পড়ছে তারা। দখলবাজিতেও তাদের জুড়ি নেই। শুধু কী তাই। টিকটক ও নাটক-সিনেমার আড়ালে অপরাধ করার জন্যও কিশোর গ্যাং বানানো হচ্ছে বলে গোয়েন্দাদের তথ্যে উঠে এসেছে।

অপরাধ বিশ্লেষজ্ঞরা জানান, কিশোর গ্যাংয়ের সাম্প্রতিক সংঘর্ষের ঘটনাগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে দেশের বিভিন্ন এলাকায় কিশোর গ্যাং নিয়ন্ত্রণ করে স্থানীয় ‘বড় ভাই’রা। ‘হিরোইজম’ প্রকাশ করতে পাড়া-মহল্লায় কিশোর গ্যাং গড়ে উঠছে। ঢাকায় আন্ডারওয়ার্ল্ডের খুনোখুনিতে কিশোর ও তরুণদের ব্যবহারের ঘটনাও ঘটছে। র‌্যাব সূত্রে জানা যায়, বেশির ভাগ কিশোর গ্যাং গড়ে ওঠার পেছনে ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় নেতাকর্মীদের মদদ রয়েছে। কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা এলাকায় নিজের অস্তিত্ব বা প্রভাব জাহিরে বিভিন্ন অপরাধমূলক কা- ঘটায়। যেমন-উচ্চ শব্দে গান বাজানো, বেপরোয়া গতিতে মোটরসাইকেল চালানো, পথচারী ও কিশোরী-তরুণীদের উত্ত্যক্ত করা এবং তুচ্ছ ঘটনায় সাধারণ মানুষের ওপর চড়াও হয়ে বড় ধরনের অপরাধ ঘটানো।

একটি গোয়েন্দা সংস্থার সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কিশোর গ্যাং সবচেয়ে বেশি সক্রিয় ঢাকায়। পুলিশ ও র‌্যাবের কর্মকর্তারা বলছেন, এসব অপরাধীচক্রের নেতা বা সদস্যদের বড় অংশ পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন। বেশির ভাগ থাকে বস্তি এলাকায়। তবে সঙ্গদোষে অনেক স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীও এসব চক্রে জড়িয়ে পড়ে। ডিএমপির আটটি অপরাধ বিভাগের মধ্যে সবচেয়ে বেশি কিশোর গ্যাং মিরপুর বিভাগে। এই বিভাগে ১৩টি কিশোর অপরাধীচক্রের ১৭২ জন সক্রিয় বলে পুলিশের তালিকায় উল্লেখ রয়েছে। তেজগাঁও ও উত্তরায়ও কিশোর গ্যাং তৎপর। র‌্যাবের পক্ষ থেকে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের গ্রেপ্তারের একটি তালিকা করা হয়েছে। ওই তালিকার তথ্য অনুযায়ী, গত বছরে র‌্যাবের অভিযানে ৩৪৯ জন কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব। র‌্যাব জানায়, ২০১৭ সাল থেকে গত বছর পর্যন্ত এক হাজার ১২৬ জন কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে র‌্যাব। এর ভেতর মোট ৪০ জনের মধ্যে ৩০ জনকে অর্থদ- ও ১০ জনকে মুচলেকা দিয়ে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়। এছাড়াও গত বছরের ২২ মে রাজধানীর দারুসসালাম থানার লালকুঠি এলাকার বসুপাড়ায় স্কুলছাত্র সিয়াম খানকে প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। তার আগে ১০ মে দনিয়া কলেজের সামনে ‘জুনিয়র-সিনিয়র’ দ্বন্দ্বে খুন হয় মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী তাজুন ইসলাম ওরফে মুশফিক। পুলিশ জানায়, দুটি হত্যাকা-ের পেছনে এলাকাভিত্তিক কিশোর অপরাধী চক্র জড়িত বলে অভিযোগ রয়েছে।

এরআগে গত ৯ জানুয়ারি রাজধানীর হাতিরঝিল থানাধীন মধুবাগ এলাকায় একটি মাঠের পাশে খুন হওয়া কিশোর আশিক মিয়ার মা শাহনাজ বেগম জানান, এলাকায় ব্যাডমিন্টন খেলাকে কেন্দ্র করে বিরোধের জের ধরে এক দল কিশোর এই হত্যাকা- ঘটিয়েছে। নিহত আশিক মিয়ার পরিবারের অভিযোগ হত্যাকা-ে এলাকার বখাটে মইনুদ্দিন, তানভির, জাহাঙ্গীর, বেলাল, রাসেলসহ অন্তত ১১ জন জড়িত। এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এসব কিশোর-তরুণ সন্ধ্যা থেকে গভীর রাত পর্যন্ত এলাকায় মোটরসাইকেল নিয়ে মহড়া দেয়।
র‌্যাব জানায়, গত ৯ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর আদাবরের মোহাম্মদিয়া হাউজিং সোসাইটি এলাকায় অভিযান চালিয়ে ‘দে ধাক্কা’ ও ‘ডায়মন্ড’ নামে কিশোরগ্যাং চক্রের অন্যতম হোতা মো. জুলফিকার আলীসহ পাঁচ সদস্যকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব)। সাংবাদিক সম্মেলনে এসব তথ্য জানান র‌্যাব-৩-এর সিও লেফটেন্যান্ট কর্নেল আরিফ মহিউদ্দিন আহমেদ। গ্রেপ্তার ব্যক্তিরা হলেন-জুলফিকার আলী (৩৭), হারুন অর রশিদ (৩৮), শামছুদ্দিন বেপারী (৪৮), কৃষ্ণ চন্দ্র দাস (২৮) ও মো. সুরুজ মিয়া (৩৯)। আরিফ মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, রাজধানীর মোহাম্মদপুর এলাকায় বেশকিছু কিশোরগ্যাং সক্রিয় রয়েছে। তার মধ্যে জুলফিকারের নেতৃত্বে ‘ডায়মন্ড’ ও ‘দে ধাক্কা’ নামে দুটি কিশোরগ্যাং পরিচালনা করতেন। এলাকার বেশকিছু বেপরোয়া ও মাদকসেবী কিশোরদের বিভিন্ন প্রলোভন দেখিয়ে কিশোরগ্যাং পরিচালনার মাধ্যমে এলাকায় অস্ত্র, মাদক কারবার, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, অপহরণ, ডাকাতি ও ভূমি দখলসহ বিভিন্ন অপকর্ম করতেন। জুলফিকারের কিশোরগ্যাং পরিচালনা করার জন্য হারুন, শামছুদ্দিন বেপারী, কৃষ্ণ চন্দ্র দাস এবং সুরুজ মিয়া সার্বিক সহযোগিতা করতেন। জুলফিকার মূলত ‘ডায়মন্ড’ এবং ‘দে ধাক্কা’ গ্রুপের কিশোর গ্যাংদের দেশি-বিদেশি পিস্তল ও বিভিন্ন দেশীয় অস্ত্র সরবরাহ করতেন। তারা আধিপত্য বিস্তারের জন্য কিশোর গ্যাংকে অস্ত্র সরবরাহ করে তাদের দিয়ে দলবদ্ধভাবে মোটরসাইকেলের মহড়া দিয়ে এলাকায় ভীতিকর পরিবেশের সৃষ্টি করতেন।

র‌্যাব জানিয়েছে, রাজধানীর মোহাম্মদপুরজুড়ে তাদের ছত্রছায়ায় গড়ে ওঠা ‘ডায়মন্ড’ এবং ‘দে ধাক্কা’ দুটি কিশোর গ্যাংয়ের তৎপরতায় প্রতিনিয়ত তারা নিজেদের অস্তিত্ব জানান দিতে দেশীয় অস্ত্রসস্ত্র নিয়ে মহড়া দিয়ে বিরোধী অন্য গ্যাংসগুলোর সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়তেন। খুবই তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে তাদের নির্দেশে প্রকাশ্যে আগ্নেয়াস্ত্রসহ দেশীয় বিভিন্ন ধারাল অস্ত্রসস্ত্র নিয়ে এলাকায় ত্রাসের সৃষ্টি করা হতো। এসব ঘটনায় তারা হরহামেশাই যে কাউকে গুলিবিদ্ধ, কুপিয়ে জখম, ছিনতাই ও ডাকাতির মতো ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটাতেও দ্বিধাবোধ করত না তারা। এ ছাড়া মোহাম্মদপুর তিন রাস্তার মোড়, চাঁদ উদ্যান, লাউতলা, নবীনগর হাউজিং, বসিলা চল্লিশ ফিট, কাঁটাসুর, তুরাগ হাউজিং, আক্কাস নগর, ঢাকা উদ্যান নদীর পাড়, চন্দ্রিমা হাউজিং, নবীনগর হাউজিং, বসিলা হাক্কার পাড় ইত্যাদি এলাকাজুড়ে আগ্নেয়াস্ত্র ও ধারাল দেশীয় অস্ত্রসহ কিশোর গ্যাংয়ের মহড়া দিত। কিশোরদের দিয়ে এলাকার মাদক কারবার নিয়ন্ত্রণ করা হতো।

কয়েকটি ঘটনা: জানা গেছে, গত ডিসেম্বরে চট্টগ্রামে দুই কিশোর বন্ধু খেলছিল সহিংসতা ভরা ‘ফ্রি ফায়ার’ নামের একটি গেম। খেলার একপর্যায়ের ঝগড়া বেঁধে যায় দুজনের মধ্যে। তর্কাতর্কি ও হাতাহাতির একপর্যায়ে এক কিশোর আরেক কিশোরের কণ্ঠনালিতে আঘাত করলে ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয় তার। চট্টগ্রাম নগরের বন্দরটিলায় কিশোর আবদুল্লাহর হত্যায় জড়িত ১৫ বছর বয়সী কিশোর ও তার মাকে গ্রেপ্তারের পর এই তথ্য জানতে পারে পুলিশ। চট্টগ্রাম নগরের বন্দরটিলা থেকে আবদুল্লাহর বস্তাবন্দী লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। চট্টগ্রাম নগর পুলিশের গোয়েন্দা (পশ্চিম/বন্দর) বিভাগের উপপুলিশ কমিশনার মুহাম্মদ আলী হোসেন নিজ কার্যালয়ে সাংবাদিক সম্মেলনে এ তথ্য জানান।

গত ১৫ বছর এপ্রিল বগুড়ার ধুনট উপজেলায় ভান্ডারবাড়ি ইউনিয়নে দেশীয় তৈরি অবৈধ অস্ত্র (রাম দা) হাতে কিশোর গ্যাংয়ের দুই সদস্যের ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে (ফেসবুক) ছড়িয়ে পড়েছে। একই সাথে তারা দেশীয় তৈরি অস্ত্র মজুদের ছবিও পোস্ট করে। এসব অস্ত্র প্রদর্শন করায় এলাকাবাসীর মাঝে চরম আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। অবৈধ অস্ত্রধারীরা উপজেলার ভান্ডারবাড়ি ইউনিয়নের ভুতবাড়ি গ্রামের বাসিন্দা। এদের একজন ২০২২ সালে ভান্ডারবাড়ি ছালেহা-জহুরা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করেছে। অপরজন একই বিদ্যালয়ে ৯ম শ্রেণীর শিক্ষার্থী। প্রথমজন ১০ এপ্রিল নিজেই তার ফেসবুকে অস্ত্র হাতে ছবি পোস্ট করে।

বরিশালের উজিরপুরে কিশোর গ্যাংয়ের তোপের মুখে ব্যবসায়ী পরিবার ৯৯৯ এ ফোন দিয়ে রক্ষা পায়। অভিযোগ ও ভুক্তভোগী সূত্রে জানা যায়, উপজেলার বড়াকোঠা ইউনিয়নে গত বছল ৬ জুন রাত ৯ টায় দিকে নতুন হাট বাজারে মায়ের দোয়া হোটেলের পিছনে মাদক সেবন করার প্রস্তুতি নিলে এর প্রতিবাদ করে ওই এলাকার নূর মোহাম্মদ গোমস্তার ছেলে মোঃ নজরুল গোমস্তা (৫৫)। পাশাপাশি মাদক কেনা বেচা সহ নানা সহিংসতার ঘটনা জন্ম দিয়ে থাকে। এরই ধারাবাহিকতায় রাতে ক্ষিপ্ত হয়ে শামীম হাওলাদারের ছেলে ইমন হাওলাদার (২০), ফজলুল হক রাড়ীর ছেলে বাধন রাড়ী (২১), ছালেক রাড়ীর ছেলে সজল রাড়ী (১৯),শামীম হাওলাদারের ছেলে মমিন হাওলাদার (২৫), মিলে লাঠিসোটা দিয়ে মারধর করতে উদ্যত হয়। পরে ৯৯৯ এ ফোন করা হলে তাৎক্ষণিক ভাবে উজিরপুর মডেল থানার ওসি (তদন্ত) মো. তৌহিদুজ্জামান সোহাগ ও এসআই রাকিবসহ পুলিশের টিম ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন এবং পুলিশ ঘটনাস্থলে গেলে পুলিশের উপস্থিতি টের পেয়ে পালিয়ে যায়। খুলনার অধিকাংশ ওয়ার্ডে রয়েছে নামে বেনামে এদের একাধিক গ্রুপ। একটি গোয়েন্দা সংস্থার দেয়া গত বছর জুন মাসের তথ্য অনুযায়ী নগরীর আট থানায় তালিকাভুক্ত কিশোর অপরাধীর সংখ্যা ২শর মতো। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশিরয়েছে সদরে। এছাড়া লবণচরা, খালিশপুর, দৌলতপুর, সোনাডাঙাসহ অন্যান্য থানায়ও এদের সংখ্যা কম নয়।

https://www.dailysangram.info/post/549089