১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, বৃহস্পতিবার, ১০:৩৭

বিশ্ববাজারে দাম কমলেও দেশে বাধা ডলার সংকট

দেশে গ্যাসের চাহিদার তুলনায় সরবরাহে বড় ধরনের ঘাটতি রয়েছে। এ ঘাটতি শিগগিরই নিরসনের সম্ভাবনা নেই। এ তথ্য জানিয়ে পেট্রোবাংলার কর্মকর্তারা বলছেন, এই ঘাটতি কমিয়ে আনতে দেশীয় গ্যাসের উৎপাদন বাড়ানোর নানা উদ্যোগের পাশাপাশি সরকার উচ্চমূল্যের জ্বালানি তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানিতেও জোর দিচ্ছে। এতে জ্বালানি খাতে ব্যয় আরো বাড়বে বলে জানান বিশেষজ্ঞরা।

দেশে বর্তমানে দৈনিক গ্যাসের চাহিদা প্রায় চার হাজার মিলিয়ন ঘনফুট। সরবরাহ হচ্ছে গড়ে দুই হাজার ৭০০ থেকে দুই হাজার ৭৫০ মিলিয়ন ঘনফুট। দৈনিক গ্যাসের ঘাটতি থাকছে প্রায় এক হাজার ২৫০ থেকে এক হাজার ৩০০ মিলিয়ন ঘনফুট।
বর্তমানে বিশ্ববাজারে এলএনজির দাম সর্বনিম্ন পর্যায়ে রয়েছে।

এতে সরকার চলতি বছর স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি আমদানি বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে। তবে এই বাজার সব সময় ওঠানামা করে। ২০২২ সালের আগস্টে স্পট মার্কেটে প্রতি মিলিয়ন ব্রিটিশ থার্মাল ইউনিট (এমএমবিটিইউ) এলএনজির দাম রেকর্ড পরিমাণ ৬০ ডলার ছাড়িয়ে যায়। তখন স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি আমদানি বন্ধ করে দেয় সরকার।

এখন সেই দাম নেমে এসেছে ৯ ডলারে।
এলএনজির জাপানভিত্তিক বাজার জেকেএমে প্রতি এমএমবিটিইউ এলএনজির দাম গত মঙ্গলবার ছিল ৯ ডলার, গত বছর একই সময়ে দাম ছিল ১৮ ডলার। তবে ২০২২ সালের একই সময়ে দাম ছিল ৩২ ডলার।

এখন বিশ্ববাজারে দাম কমলেও স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি আমদানিতে চ্যালেঞ্জ ডলার সংকট। একই সঙ্গে এলএনজি রূপান্তর করে গ্রিডে দেওয়ার পর্যাপ্ত ব্যবস্থাপনার ঘাটতি থাকায় চাইলেই সক্ষমতার বেশি এলএনজি আমদানি করার সুযোগ নেই পেট্রোবাংলার।

দেশীয় গ্যাসের উৎপাদন ও এলএনজি সরবরাহ কার্যক্রম নিয়ে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত একটি প্রক্ষেপণ করেছে পেট্রোবাংলা। এতে দেখা গেছে, এ সময়ে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির আওতায় কাতার ও ওমান থেকে এলএনজির কার্গো আসবে ৪৬টি এবং স্পট মার্কেট (খোলাবাজার) থেকে ২২টি কার্গো আনার কথা রয়েছে। এ দিয়েই চলতি বছর গ্যাস সরবরাহ কার্যক্রম নিরবচ্ছিন্ন রাখার পরিকল্পনা সংস্থাটির। তবে স্পট মার্কেট থেকে পরিকল্পনা অনুযায়ী এলএনজি কার্গো আমদানির বিষয়টি নির্ভর করছে দাম ওঠানামার ওপর। বিশ্ববাজারে এলএনজির দাম সহনীয় থাকলে আমদানি আরো বাড়িয়েও গ্যাস সরবরাহ কার্যক্রম ঠিক রাখার চেষ্টা করা হবে বলেও জ্বালানি ও পেট্রোবাংলার কর্মকর্তারা জানান।

পেট্রোবাংলা কর্মকর্তারা বলছেন আগামী অক্টোবর পর্যন্ত ২২ কার্গো এলএনজি স্পট মার্কেট থেকে আনতে বর্তমান দর অনুযায়ী খরচ পড়বে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা। প্রতিটি কার্গোতে এলএনজি থাকে ৩৩ লাখ ৬০ হাজার এমএমবিটিইউ।

জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই এলএনজি আমদানি করতে সরকারকে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করতে হবে। বিশ্ববাজারে এলএনজির দাম কমলেও স্পট মার্কেট থেকে এখন বাড়তি এলএনজি আমদানিতে বড় চ্যালেঞ্জ ডলার সরবরাহ। এর পরও বিদ্যুৎ উৎপাদন ঠিক রাখতে এবং শিল্পের চাকা সচল রাখতে সরকারকে এলএনজি আমদানি ঠিক রাখতে হবে।

সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা আরো বলছেন, বর্তমানে দুটি এলএনজি টার্মিনালের যে সক্ষমতা রয়েছে, বিশ্ববাজারে এলএনজির দাম কম থাকলেও চাইলেই সক্ষমতার বেশি এলএনজি আমদানির সুযোগ নেই। কারণ দেশে এলএনজি এনে তা গ্যাসে রূপান্তর করার পর্যাপ্ত টেকসই ব্যবস্থাপনার ঘাটতি রয়েছে। এতে চলতি বছরও বিদ্যুেকন্দ্র, শিল্পকারাখানা ও আবাসিকে চাহিদা অনুযায়ী গ্যাস সরবরাহ সম্ভব হবে না। তাই চলতি বছরেও চাহিদা ও সরবরাহে ঘাটতি থাকবেই।

পেট্রোবাংলা সূত্রে জানা গেছে, কক্সবাজারের মহেশখালীতে বর্তমানে দুটি ভাসমান এলএনজি টার্মিনাল রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের এক্সিলারেট এনার্জি ও সামিট গ্রুপের এই দুই টার্মিনাল দিয়ে বিদেশ থেকে জাহাজে করে আনা এলএনজি জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ করা হয়। টার্মিনাল দুটির প্রকৃত সক্ষমতা এখন এক হাজার ১০০ মিলিয়ন ঘনফুট। স্বাভাবিক সময়ে দুই টার্মিনালের মাধ্যমে ৮০০ থেকে ৯০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস গ্রিডে সরবরাহ করা হতো। এখন ৭০০ মিলিয়ন ঘনফুটেরও কম গ্যাস সরবরাহ করা হচ্ছে।

জানতে চাইলে পেট্রোবাংলার পরিচালক (অপারেশন অ্যান্ড মাইনস) মো. কামরুজ্জামান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এলএনজির দাম এখন স্পট মার্কেটে কম রয়েছে। বিশ্ববাজারে দাম সহনীয় থাকলে চলতি বছর স্পট মার্কেট থেকে বাড়তি এলএনজি আনার পরিকল্পনা আমরা করেছি। যদিও স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি আমদানির বিষয়টি দাম ওঠানামার ওপর নির্ভর করে। যেহেতু দেশীয় গ্যাসের মজুদ কমে আসছে, তাই সরবরাহ ঠিক রাখতে আমদানি বাড়াতে হচ্ছে।’

গ্যাস উৎপাদন ও এলএনজি সরবরাহ প্রক্ষেপণ-২০২৪-এ দেখা গেছে, গ্যাস সরবরাহ প্রক্ষেপণে চলতি ফেব্রুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত গড় সরবরাহ ধরা হয়েছে দৈনিক দুই হাজার ৭০০ থেকে দুই হাজার ৮৭৫ মিলিয়ন ঘনফুট।

প্রাক্কলনে বলা হয়েছে, চলতি ফেব্রুয়ারি মাসে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির আওতায় পাঁচটি ও স্পট মার্কেট থেকে একটি কার্গো আসবে। মার্চে দীর্ঘমেয়াদি ও স্পট মার্কেট মিলিয়ে আটটি কার্গো আসবে, এপ্রিলে দীর্ঘমেয়াদি পাঁচটি, স্পট মার্কেট থেকে দুটিসহ মোট সাতটি কার্গো আসবে। মে মাসে দীর্ঘমেয়াদি ছয়টি ও স্পট মার্কেট থেকে তিনটি কার্গো এবং জুনে দীর্ঘমেয়াদি পাঁচটি ও স্পট মার্কেট থেকে দুটি কার্গো এলএনজি আসবে। জুলাই ও আগস্টে আটটি কার্গোতে করে এলএনজি আনা হবে। সেপ্টেম্বরে দীর্ঘমেয়াদি চার কার্গো ও স্পট থেকে তিন কার্গো এবং অক্টোবরে দীর্ঘমেয়াদি ও স্পট মার্কেট মিলিয়ে সাত কার্গো আনা হবে।

জানতে চাইলে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক বদরূল ইমাম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বর্তমানে দেশে গ্যাসের বড় ঘাটতি চলছে, সামনে এই ঘাটতি আরো বাড়বে। বিশেষ করে আসছে গ্রীষ্মকালে বড় ঘাটতি দেখা যাবে। গ্রীষ্মকালে আমাদের বড় রকমের সংকট মোকাবেলা করতে হতে পারে।’

বদরূল ইমাম বলেন, ‘স্পট মার্কেট এলএনজির বাজার অনিশ্চিত। এখন দাম কম থাকলেও এটা যেকোনো সময় বেড়ে যেতে পারে। তাই এটার ওপর ভিত্তি করে যদি ভবিষ্যৎ সরবরাহের পরিকল্পনা করা হয়, তাহলে সরবরাহ ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যাবে।’

দেশীয় গ্যাসের উৎপাদন বাড়াতে ৪৬টি কূপ খননের উদ্যোগ নিয়ে কাজ শুরু করেছে সরকার। আগামী ২০২৫ সালের মধ্যে এসব কূপ থেকে বাড়তি প্রায় ৫০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের উৎপাদন বাড়ানোর লক্ষ্য রয়েছে সরকারের। আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে আরো ১০০ কূপ খননের পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করছে পেট্রোবাংলা।

https://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2024/02/15/1363770