১৫ মে ২০১৭, সোমবার, ৩:৩২

রাষ্ট্রে চতুর্থ স্তম্ভের স্বাধীনতা

দেখা অদেখা

|| সালাহউদ্দিন বাবর ||

কোনো দেশের সংবিধানে বা ভিন্ন কোনো বিধিবিধানে রাষ্ট্রের তিন স্তম্ভের বাইরে চতুর্থ স্তম্ভ বলে কোনো বিষয় নেই বটে, তবে নিজের অবস্থানগত কারণে ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার জন্য বিশ্বব্যাপী রাজনৈতিক অঙ্গনসহ অন্যান্য পর্যায়ে এবং সুশীলসমাজে সংবাদপত্র বা প্রিন্ট মিডিয়াকে রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ হিসেবে অভিহিত করা হয়। গণতন্ত্রের স্বার্থকতার জন্য সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনে জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠার স্বার্থে, দুস্থ মানবতার পাশে দাঁড়ানো এবং সমাজের অন্ধকার দিকটি উন্মোচন করার ক্ষেত্রে সংবাদপত্রের ভূমিকা অদ্বিতীয়। শুধু তাই নয়, রাষ্ট্রের তিন স্তম্ভ তথা নির্বাহী, বিচার ও আইন বিভাগ যে দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পাদন করে তা জনসম্মুখে তুলে ধরার ব্যাপারে সংবাদপত্র গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করে। নির্বাহী বিভাগের কর্ণ-চু হিসেবে সংবাদপত্র কাজ করে। সরকারি দায়িত্ব পালনে প্রজাতন্ত্রের কর্মীদের ভুলত্রুটি অবহেলা এবং তাতে যে জনভোগান্তি সৃষ্টি হয়, তা তুলে ধরেন সংবাদকর্মীরা। উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে যে ব্যত্যয় ঘটানো হয়, তার খবর প্রকাশ করে পত্রিকা। নির্বাহী বিভাগ যাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে পারে, সে ক্ষেত্রে সাহায্য করে সংবাদপত্র। সমাজের অগ্রগতি, অবনতি, সঙ্কট ও অবক্ষয়ের চিত্র এঁকে দেয় খবরের কাগজ। সেই বিবেচনায় সংবাদপত্র সমাজের দর্পণ হিসেবে কাজ করে। সেই সাথে বিচার বিভাগকেও সহায়তা করে থাকেন সাংবাদিকেরা। সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে যে অন্যায় ও অবিচার বিরাজ করে, তা বিচার বিভাগের গোচরে তুলে আনেন এবং তার সুবিচার হলে তাও প্রচার করেন। বিচার বিভাগ অন্যায় ও অবিচারের প্রতিবিধান করে এবং দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালনের সিদ্ধান্ত দেয়। তাতে সমাজে সুবিচার প্রতিষ্ঠা হয় এবং শান্তি-স্বস্তি বজায় থাকে। এ ক্ষেত্রে সংবাদপত্রের কর্মীদের কলম চালনা বিশেষ অবদান রাখে। আইনসভার সাথে সংবাদপত্রের সম্পর্ক আরো গভীর। আইনসভা যখন অধিবেশনে মিলিত হয়, তখন সে বৈঠকের আইনসভার সভ্যদের বাইরে আর যারা নেপথ্যে থেকে সংসদের সাংবাদিকদের গ্যালারিতে গভীর অভিনিবেশ সহকারে দায়িত্ব পালন করেন যেসব সংবাদ কর্মী, তারা রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভের সদস্য। তারা আইনসভার আলোচ্যসূচিতেও অবদান রাখেন। বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের অনিয়মসহ সমাজের দুষ্কর্মসহ নানা সমস্যা পত্রিকায় তুলে ধরা হয়। আইনসভার সদস্যরা সে বিষয়গুলোও বৈঠকের আলোচনায় উপস্থাপন করেন। আইনসভার গুরুত্বপূর্ণ কার্যবিবরণী সংবাদপত্র প্রকাশ করে। তাতে জনগণ জানতে পারে আইন সভায় কী হচ্ছে। তাদের প্রতিনিধিরা সেখানে তাদের পক্ষে কী কথা বলছেন। আইনসভার সাথে জনগণের সেতুবন্ধন তৈরি করে সংবাদপত্র। এর মাধ্যমে দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হয়ে থাকে।
এ ছাড়া দেশ-বিদেশের রাজনীতি, শিল্প, সাহিত্য, বিজ্ঞান প্রযুক্তির যে নিত্যনতুন খবর তৈরি হচ্ছে; তা ছড়িয়ে দিয়ে থাকে খবরের কাগজ ও সংবাদমাধ্যম। নব আবিষ্কার ও উদ্ভাবন মানুষের জ্ঞানের দিগন্ত ক্রমান্বয়ে সম্প্রসারিত করে সংবাদপত্র নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করে থাকে। ক্রীড়া, সঙ্গীত ও অভিনয় শিল্প-সম্পর্কিত তথ্যাদি পরিবেশন করে পত্রিকা নির্মল নির্দোষ আনন্দ ছড়িয়ে দেয় পাঠকের মাঝে। বস্তুতপক্ষে এক বিরাট কর্মযজ্ঞের আয়োজন করে সংবাদপত্র। আজ মানুষের প্রতিমুহূর্তে সহচর সংবাদপত্র। তথ্যের অবাধ প্রবাহ এবং খবরের কাগজের নিরঙ্কুশ স্বাধীনতা ও বিকাশ কতটা জরুরি এবং গুরুত্বপূর্ণ সে কথা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। সংবাদপত্র ও অন্যান্য মিডিয়া সুশাসন, সুনীতি, মূল্যবোধ ও মানবাধিকার সংরক্ষণ নিয়ে জনমত তৈরি করে। সমাজ সংসারের দুঃখ-বেদনা-আনন্দ-উদ্দীপনার কাহিনী রচনা করলেও সাংবাদিকেরা ব্যক্তিগত দুঃখ-কষ্ট-অভাব-অভিযোগের কথা কখনোই তাদের কলমে প্রকাশ করেন না। নিঃস্বার্থ ও পরার্থে নিবেদিতপ্রাণ সংবাদকর্মীরা। দীর্ঘকাল থেকে আজ অবধি সাংবাদিকেরা এই মহান দায়িত্ব পালন করে আসছেন। এ জন্য তাদের বহু বাধা অতিক্রম করতে হয় একাকী। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা অবশ্যই সন্ত্রাসী ও অপরাধীদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করেন সশস্ত্র ও দলবদ্ধভাবে, কিন্তু নিরস্ত্র সাংবাদিক শুধু তাদের হাতে কলম নিয়ে এসব দুর্বৃত্তের সম্মুখে একাকী দাঁড়ান অসীম সাহসের ওপর নির্ভর করে। এসব দুঃসাহসিক অভিযানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা যখন জীবন বাজি রেখে অবতীর্ণ হন, তখন যদি এই সমাজবিরোধীদের হাতে তারা আক্রান্ত হয়ে হতাহত হন, তাদের জন্য সরকারিভাবে সাহায্য সহযোগিতা ও ক্ষতিপূরণ থাকে। তা ছাড়া ঝুঁঁকিপূর্ণ কাজের জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মীরা বিভাগীয় পুরস্কার এবং পদক পেয়ে থাকেন। এসব সাহায্য সহযোগিতা তাদের কাজে সাহস জোগায়। কিন্তু সাংবাদিকেরা তাদের দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে তেমন কোনো অনুপ্রেরণা পান না। অবশ্য কিছু দেশীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থা সাংবাদিকদের জন্য কিছু পুরস্কারের ব্যবস্থা করে থাকে। সাংবাদিকেরা তাদের কাজের বিনিময়ে কিছু আশা করেন না। কিন্তু তারা একটি দাবি করে থাকেন, আর তা হলো তাদের কলম ও লেখার স্বাধীনতা।
প্রতি বছর ৩ মে বিশ্বব্যাপী পালিত হয় বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবস। এবারো বাংলাদেশসহ গোটা পৃথিবীতে পালিত হয় দিবসটি। এ উপলক্ষে দেশে সেমিনার, আলোচনা সভা ও বিশেষ রচনা প্রকাশ করা হয়। বিশেষ করে বাংলাদেশে আয়োজিত আলোচনায় পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত নিবন্ধে দেশের সংবাদপত্র এবং অন্যান্য গণমাধ্যমে স্বাধীনতার বিষয়টি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়েছে। ঢাকায় যত সেমিনার, আলোচনা বৈঠক হয়েছে এবং নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে তার প্রধান সুর ছিল হতাশা ও আক্ষেপ। সর্বত্রই বলা হয়েছেÑ দেশে সংবাদপত্র ও অন্যান্য গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নেই। সব কথা লিখতে ও বলতে বাধা রয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে আসছে নানা অন্তরায়। সাংবাদিকেরা দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে নানা বাধার মুখোমুখি হচ্ছেন। সম্প্রতি দায়িত্ব পালনকালে একজন নিবেদিতপ্রাণ সাংবাদিককে গুলিবিদ্ধ হয়ে প্রাণ হারাতে হয়েছে। আর যিনি এই গুলিবর্ষণ করেছেন, তিনি ক্ষমতাসীন দলের একজন নেতা।
সম্প্রতি ঢাকায় আয়োজিত একটি সেমিনারে তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু বলেছেনÑ তথ্য বিকৃতকারী, উসকানিদাতা ও চক্রান্তকারীরা চাপে রয়েছে। কোনো সংবাদমাধ্যম বা সাংবাদিক চাপে নেই। সংবাদপত্র ও সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়ে সম্প্রতি আন্তর্জাতিক সংস্থা অ্যামনেস্টির একটি প্রতিবেদন প্রকাশ পেয়েছে। তাতে বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমের নাজুক অবস্থার কথা বলা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে তথ্যমন্ত্রী বলেন, প্রতিবেদনটি পক্ষপাতদুষ্ট ও উদ্দেশ্যমূলক। তথ্যমন্ত্রী এক তথ্য প্রকাশ করে বলেন, এখন পর্যন্ত ৩৫টি অনলাইন পোর্টাল বন্ধ করা হয়েছে। তার কোনোটিই সরকারের বিরোধিতার জন্য নয়, বরং ধর্মীয় বিদ্বেষমূলক লেখা প্রকাশের জন্য। প্রশাসনের নির্দেশে ওই পোর্টাল বন্ধ করা হয়।
অ্যামনেস্টির প্রতিবেদন ‘বাংলাদেশে মত প্রকাশের স্বাধীনতার পথ রুদ্ধ’ রচনা নিয়ে প্রধানমন্ত্রীপুত্র ও তার উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয় ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছেনÑ আমি সন্দেহ করছি, তারা রাজনৈতিক অ্যাজেন্ডা বাস্তবায়নে কাজ করছে। তারা ক্ষমতায় একটি পুতুল সরকার আনতে চায়। আমাদের দেশকে অস্থিতিশীল করতে চায়। সংস্থাটি অপরাধীদের পক্ষে প্রচারণা চালাচ্ছে বলে তিনি অভিযোগ করেন। তিনি আরো অভিযোগ করেন, সেনা নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় ২০০৭ ও ২০০৮ সালে বাংলাদেশে মত প্রকাশের স্বাধীনতা নিয়ে সংস্থাটি কোনো বিবৃতি দেয়নি।
বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার ব্যাপারে যে পর্যবেক্ষণ দেশের ভেতরে ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডল থেকে এসেছে, তাতে সরকারি কর্তৃপক্ষ ুব্ধ হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর পুত্রের যে প্রতিক্রিয়া তাকে শীর্ষ পর্যায়ের দৃষ্টিভঙ্গি বলেই সাধারণভাবে মনে করা হচ্ছে। অবশ্য সরকার সমর্থক মিডিয়ার নেতারাও একই ধরনের মত পোষণ করেন।
দেশে সংবাদপত্রের স্বাধীনতার ওপর বর্তমান এবং অতীতে বহুবার খড়গ নেমে এসেছে। সংবাদমাধ্যমের লেখনী নিয়ে রাজনৈতিক মহল, বিভিন্ন ‘প্রেসার গ্রুপ’, প্রভাবশালী মহল ক্ষিপ্ত হয়ে এর কণ্ঠ রোধ করার চেষ্টা করে। তা ছাড়া সরকারের বিভিন্ন সংস্থাও সংবাদপত্রের স্বাধীন মতামত বিশেষ করে তাদের বিরুদ্ধে সাধারণ সমালোচনাকেও কোনোভাবেই সহ্য করতে পারে না। সংবাদপত্রের ওপর বড় ধরনের আঘাত আসে ১৯৭৫ সালে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে। সে সময় দেশে এক অরাজক অবস্থার সৃষ্টি হয়। প্রশাসন ধসে পড়ার পর্যায়ে চলে আসে, মারাত্মক খাদ্যাভাব দেখা দেয়, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি ঘটে, ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা সরকারি সম্পদ দখল করার কাজে মেতে ওঠে। দুর্নীতি সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে ও নৈতিকতার চূড়ান্ত অবক্ষয় দেখা দেয়। সামগ্রিক পরিস্থিতি সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে থাকে। সদ্য স্বাধীন দেশে দেশ গঠনের প্রক্রিয়াটি তখনো শুরু করা যায়নি। এমন নাজুক পরিস্থিতিতে সরকার সাংবিধানিক, গণতান্ত্রিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক সামাজিক ও সংবাদপত্রের ওপর সমাজতন্ত্রের ধ্যানধারণার বশবর্তী হয়ে এক আমূল পরিবর্তন ঘটায়। বাংলাদেশ রাতারাতি গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা থেকে পরিবর্তিত হয়ে সমাজতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার দেশে পরিণত হয়। সব শিল্পকারখানা ও প্রতিষ্ঠান রাষ্ট্রায়ত্ত করা হয়। সব রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করে একদলীয় শাসন কায়েম করা হয়। মৌলিক মানবাধিকারের বহু বিধিবিধান রহিত করা হয়। একই সাথে দেশের সব পত্রপত্রিকা বন্ধ করে দিয়ে সরকারের নিয়ন্ত্রণে মাত্র চারটি পত্রিকা রাখা হয়। সে পত্রিকাগুলোও স্বাধীনভাবে কোনো খবর, নিবন্ধ বা সরকারের বিপক্ষে কিছু লেখার অধিকার ছিল না। কঠিন সেন্সরশিপের মাধ্যমে পত্রিকা চারটি প্রকাশিত হতো। সব পত্রপত্রিকা বন্ধ করে দেয়ায় সরকারি ভাষ্য ছাড়া ভিন্ন মত প্রকাশের যেমন সুযোগ ছিল না, তেমনি এতে বহু সাংবাদিকসহ অন্যান্য কর্মচারী-কর্মকর্তা চাকরিচ্যুত হয়ে দুর্বিষহ বেকার জীবন যাপন করেন। দেশে যে অরাজকতার কথা আগে উল্লেখ করা হয়েছে, তার শুরু কিন্তু ১৯৭৪ সালে। সে সময় খাদ্যাভাব চরম আকার ধারণ করে, সৃষ্টি হয় অরাজকতা। তা সামাল দেয়া সরকারের পক্ষে কঠিন হয়ে পড়েছিল। এসব প্রতিরোধের জন্য কঠোর নিবর্তনমূলক একগুচ্ছ আইন তৈরি করা হয়, যা ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইন নামে অভিহিত। সেই আইনের ১৬, ১৭ ও ১৮ অনুচ্ছেদ তিনটি ছিল সংবাদপত্রের কণ্ঠরোধকারী। সংবাদপত্রগুলো যাতে দেশের দুরবস্থা সম্পর্কে কিছু লিখতে না পারে, সেই উদ্দেশ্যেই এই বিধান তৈরি করা হয়। আর দেশের সংবাদপত্রের ওপর ’৭৪ সালে বিশেষ ক্ষমতা আইনটি ছিল প্রথম খড়গ। এই কালা কানুনটির সবচেয়ে বেশি প্রয়োগ হয়েছে সামরিক শাসক এরশাদের আমলে।
এই কালো আইন প্রয়োগ করে সে সময় একটি জাতীয় দৈনিকের প্রকাশনা বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। সাংবাদিকেরা সেই গোড়া থেকে এই কালো আইনের বিধানগুলো বাতিলের দাবিতে আন্দোলন করলেও কোনো সরকারই তাদের হাতের এই অস্ত্রটি ফেলে দেয়ার উদ্যোগ নেয়নি। শেষে বিচারপতি শাহাবুদ্দীন আহমদের তত্ত্বাবধায়ক সরকার অধ্যাদেশ জারি করে সেই তিনটি ধারা রহিত করে। সেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনে বিএনপি বিজয়ী হয়ে ক্ষমতায় এলে তারা সেই ধারা তিনটি স্থায়ীভাবে বাতিল করে দিয়েছিল। দেশের সংবাদপত্র আরো দুই দফা কঠিন সেন্সরশিপের আওতায় পড়েছিল। বাংলাদেশে দুইবার সামরিক আইন জারি হয়েছে। প্রতিবার সামরিক আইনের সময় সংবাদপত্রের স্বাধীনতা হুমকির মুখে পড়ে।
বাংলাদেশের সংবাদপত্রের স্বাধীনতার প্রশ্নে মিডিয়ার বিভিন্ন আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষণকারী সংস্থা কখনোই সন্তুষ্ট ছিল না। হালে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ও রিপোর্টার্স সেন্স ফ্রন্টিয়ার্সের (আরএসএফ) প্রকাশিত দু’টি রিপোর্ট নিয়ে এখন বিভিন্ন স্থানে আলোচনার সূচনা হয়েছে। এ কথা অস্বীকার করার সুযোগ নেই যে, বাংলাদেশে সংবাদপত্র এবং সাংবাদিকেরা মুক্তভাবে কাজ করতে পারছেন না। অ্যামনেস্টির প্রতিবেদনে প্রকাশ পেয়েছে, বাংলাদেশে সাংবাদিকেরা প্রতিদিন সরকারি বাহিনী অথবা উগ্রবাদী গোষ্ঠীগুলোর পক্ষ থেকে হুমকি পাচ্ছেন। শীর্ষস্থানীয় সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে মামলা দিয়ে, নানা কৌশলে হয়রানি করার মাধ্যমে সরকারের সমালোচনা থেকে তাদের বিরত থাকার বার্তা দেয়া হচ্ছে। আরএম ফ্রিডম ইনডেক্সে বাংলাদেশের অবস্থান ১৪৪ থেকে ১৪৬-এ নেমে গেছে। একজন জ্যেষ্ঠ সম্পাদক এক আলোচনা সভায় বলেছেন, আমরা কি জোরগলায় বলতে পারব আমাদের সব সমস্যা শেষ হয়ে গেছে? অন্ততপক্ষে আমি বলতে চাই, এই সমস্যাগুলো থেকে আমরা এখনো মুক্তি পাইনি। সংবাদমাধ্যমের জন্য সমস্যা আছে, চাপ আছে ভয়ভীতি আছে। অ্যামনেস্টি রিপোর্টে আরো বলা হয়েছে, স্বাধীন মত প্রকাশের সুরক্ষা দিতে না পারার পাশাপাশি বাংলাদেশ সরকার বাকস্বাধীনতা খর্ব করতে খড়গহস্ত বলে দাবি করা হয়েছে। উগ্রবাদীদের হামলা আর হুমকির ভয়ে স্বাধীনভাবে মত প্রকাশের সুযোগ বংলাদেশে কমে এসেছে। সরকার সাংবাদিকদের সুরক্ষা দেয়ার বদলে উল্টো নানা কৌশল ও আইনের বেড়াজালে বাকস্বাধীনতার পথ বন্ধ করে চলেছে।
সাম্প্রতিক গণমাধ্যম বিষয়ে এক গবেষণায় টিআইবি বলেছেÑ বংলাদেশের গণমাধ্যমে স্বাধীনতা আফগানিস্তানের চেয়েও পেছনে রয়েছে। এটি একটি আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষণ। কিন্তু সরকার তা স্বীকার করে না। বাংলাদেশের গণমাধ্যম কতটা স্বাধীন তা নিয়ে বিস্তর বিতর্ক রয়েছে। গণমাধ্যমের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানেও সুশাসনের ঘাটতি রয়েছে ও নিয়োগে স্বচ্ছতার ঘাটতি রয়েছে। দেশে এখন নির্ভীক সাংবাদিকতা করা কঠিন। গণমাধ্যমের জন্য সহায়ক আইনি পরিবেশ নিশ্চিত করা এবং সরকারের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার প্রশ্নে গণমাধ্যম সব সময় বিদ্যমান নানা ধরনের সামাজিক, রাজনৈতিক ও পেশাজনিত চাপ, হুমকি, অসহযোগিতা, বাধাবিপত্তি, নিরাপত্তাহীনতা, স্বআরোপিত সেন্সরশিপ ইত্যাদি মোকাবেলা করেই গণমাধ্যমের কর্মীদের যেমন এগিয়ে যেতে হবে; তেমনি এসব বাধাবিপত্তি সরিয়ে গণমাধ্যমের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করতে জনগণ বিশেষ করে সরকারকে অধিকতর দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে। সংবাদমাধ্যম নিয়ে এমন আলোচনা কেউ কারো বিরুদ্ধে প্রচারণা বলে ধরে নেয়া ঠিক হবে না, বরং বিষয়টি এভাবে দেখা উচিত, বাংলাদেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠার একটা নীরব আন্দোলন চলছে। এসব আলোচনা-সমালোচনার মাধ্যমে যে সমস্যাগুলো চিহ্নিত হবে এবং সেগুলো প্রতিবিধানের পথ বের হবে। তাতে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো প্রাতিষ্ঠানিকতা পাওয়ার ক্ষেত্রে এগিয়ে যাবে।
সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ছাড়া দেশের গণতন্ত্র অর্থহীন হয়ে পড়ে। দেশের মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার নিশ্চিত করতে হলে সংবাদমাধ্যম তা প্রিন্ট বা ইলেকট্রনিকস যে মিডিয়াই হোক তার প্রবাহ অবাধ হওয়া একান্ত প্রয়োজন। একটি জবাবদিহিমূলক প্রশাসন কায়েম এবং জনগণের অভিপ্রায় উপলব্ধি করার জন্য সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা প্রয়োজন। একটি গণতান্ত্রিক সমাজে বহুমতের বিকাশ ঘটাতে হয়। আর সেই বহুমত ডানা মেলে সংবাদমাধ্যমের মধ্য দিয়ে। যে দেশের সরকার যতটা স্বচ্ছতায় বিশ্বাস করে এবং বহুমতের লালন করে, সেখানে সংবাদমাধ্যম ততটা মুক্ত। সমাজ তথা রাষ্ট্রে ক্রমাগত উগ্রতা ও অসহিষ্ণুতা ছড়িয়ে পড়ে যদি সংবাদপত্রের স্বাধীনতা না থাকে। পরস্পরের প্রতি সহনশীলতা সৃষ্টি ও মানুষের শুভবোধ বিকাশের ক্ষেত্রে সংবাদমাধ্যম বিরাট ভূমিকা রাখতে পারে। সাংবাদিকেরা তাদের লেখনীর মাধ্যমে শুভবোধগুলোকে জাগ্রত এবং অশুভ-অসুন্দরের বিরুদ্ধে জনমত গঠন করে এসবের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের দেয়াল তুলতে সক্ষম হন। তা ছাড়া বঞ্চিত মানুষের অপ্রাপ্তির চিত্রগুলো তুলে ধরে সমাজকে বঞ্চনার বিরুদ্ধে সচেতন করে তোলেন।
সংবাদপত্রের এসব মহান দায়িত্ব পালনের জন্য সাধুবাদ জানানো উচিত এবং তাদের স্বাধীনতা খর্ব করা হলে এর বিরুদ্ধে সোচ্চার প্রতিবাদ ও আন্দোলন গড়ে তোলা উচিত। একই সাথে সংবাদকর্মীদের এই গুরুদায়িত্ব পালনের সময় তাদেরও মনে রাখতে হবে, তারা বা তাদের রচনা আইনের ঊর্র্ধ্বে নয়। আইন মেনেই সুনীতি বিকাশ ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে তারা দাঁড়াবেন। মনে রাখতে হবে, তাদের অনুরাগ-বিরাগের বশবর্তী হওয়া চলবে না। সত্যকে মিথ্যা দিয়ে ঢাকা যাবে না। আবার মিথ্যাকে অনুরাগের বশবর্তী হয়ে মোড়কে মুড়ে প্রকাশ করা অনৈতিক কাজ। সমাজের অন্যায়-অনৈতিকতার বিরুদ্ধে তাদের সাহসী সংগ্রাম। কোনোভাবেই অনৈতিকতার সাথে আপস করা যাবে না। সত্য ঘটনা যেমন তুলে ধরতে হবে, তেমনি বিরাগের বশবর্তী হয়েছে কোনো ঘটনার বা ব্যক্তির বিরুদ্ধে কুধারণা-কটূক্তি ন্যায়ানুগ নয়। শুধু তখনই সত্য প্রকাশের স্বাধীনতার সংগ্রামে তারা দেশের সাধারণ মানুষের সমর্থন ও সহানুভূতি পাবেন। সমাজে তাদের স্থান হবে উচ্চতর শিখরে।
একটি ইংরেজি দৈনিক এবং বাংলা দৈনিকে বিশ্ব মুক্ত সাংবাদিকতা দিবস উপলক্ষে প্রকাশিত দু’টি নিবন্ধে বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী প্রবীণ অধ্যাপক রেহমান সোবহানের উদ্ধৃতি দেয়া হয়েছে। তার উক্তি দু’টি অত্যন্ত মূল্যবান এবং সময়োপযোগী বলে এখানে উদ্ধৃতি দেয়া প্রয়োজন বোধ করছি। ইংরেজি দৈনিকটিতে তার বক্তব্যে এসেছে, ‘আজকে যখন একটি নিবন্ধ লিখি, তার জন্য এক সপ্তাহ লাগে। লেখার পর তা পাঁচবার পড়ি সেন্সরের জন্য। তারপর তৈরি হই তা প্রকাশের জন্য। লেখার প্রতিটি শব্দ নিয়ে আমি চিন্তা করি আজকের এই স্বাধীন বাংলাদেশে। কিন্তু যখন আমরা সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে লড়ছিলাম, তখন বসে দুই ঘণ্টার মধ্যে একটি লেখা তৈরি করে ফেলতাম।’ বাংলা দৈনিকে তার যে উদ্ধৃতি প্রকাশ পেয়েছে তাতে রয়েছে, ‘আমার সমালোচকরাই আমার বড় বন্ধু।’ এই বক্তব্য দুটোকে সংশ্লিষ্ট সবার উচিত সুবিবেচনায় নেয়া।


 

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/220028