১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, বৃহস্পতিবার, ১০:৩১

টাঙ্গাইল শাড়ির ভৌগোলিক নির্দেশক চিহ্ন (GI): এটা কার?

সম্প্রতি একটি বিতর্ক সোশ্যাল মিডিয়ায় উঠে এসেছে যে টাঙ্গাইল শাড়ি একটি ভৌগোলিক নির্দেশক (GI) দ্বারা সুরক্ষিত হতে পারে কিনা এবং এ পণ্যটির মালিকানা ভারত দাবি করতে পারে কিনা। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার ট্রিপস (TRIPS) চুক্তি ১৯৯৪ অনুযায়ী একটি ভৌগোলিক নির্দেশক/চিহ্ন (GI) এমন একটি নির্দেশক/চিহ্ন যা পণ্যগুলোতে ব্যবহৃত হয় যেগুলোর একটি নির্দিষ্ট ভৌগোলিক উৎস রয়েছে সদস্যের ভূখণ্ডে বা ভূখণ্ডের কোনো অঞ্চলে এবং সেগুলোর গুণাবলি, খ্যাতি বা অন্যান্য বৈশিষ্ট্য ওই নির্দিষ্ট ভৌগোলিক উৎসের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।

সাধারণভাবে ভৌগোলিক নির্দেশক/চিহ্নগুলো শিল্পপণ্য, হস্তশিল্প, কৃষিপণ্য, ভোগ্যপণ্য, এবং ওয়াইন ও স্পিরিট পানীয়গুলোতে ব্যবহার করা হয়। এখানে প্রশ্ন আসে যে, টাঙ্গাইল শাড়িকে উপরে বর্ণিত কোনো পণ্য হিসেবে যোগ্য বলে দাবি করা হয়েছে কিনা? হ্যাঁ, টাঙ্গাইলের শাড়ি একটি পণ্য, একটি হস্তশিল্প। তাছাড়া একটি ভৌগোলিক নির্দেশক/চিহ্ন এর জন্য যোগ্য পণ্যটির উৎপত্তিস্থল অবশ্যই একটি চুক্তিভুক্ত রাষ্ট্রে বা একটি মনোনীত অঞ্চলের মধ্যে থাকতে হবে। টাঙ্গাইল শাড়ির উৎপত্তি কোনো সদস্য রাষ্ট্রের ভূখণ্ডে না কি ওই রাষ্ট্রের কোনো নির্দিষ্ট অঞ্চলে তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এখানে টাঙ্গাইল শাড়ির ব্যুৎপত্তিস্থল ভারতের পশ্চিমবঙ্গের টাঙ্গাইল হিসেবে দাবি করা হয়েছে।

এ ছাড়া একটি পণ্যকে একটি ভৌগোলিক নির্দেশক/চিহ্ন পণ্য হিসেবে যোগ্যতা অর্জন করার জন্য এটিকে একটি নির্দিষ্ট গুণমান, খ্যাতি, বা অন্যান্য বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হতে হবে যা তার ভৌগোলিক উৎসের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত হবে। টাঙ্গাইল শাড়ির গুণমান, খ্যাতি বা অন্য কোনো গুণের জন্য প্রাথমিকভাবে এটিকে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের টাঙ্গাইলের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে সম্পৃক্ত করা যায় কিনা তা নিয়েও প্রশ্ন জেগেছে। টাঙ্গাইল শাড়ি, তার সূক্ষ্ম জামদানি মোটিফ, প্রাণবন্ত রং এবং পরিমার্জিত টেক্সচারের জন্য বিখ্যাত- এসব এ বৈশিষ্ট্যের জন্য এটিকে অঞ্চলের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের প্রতীক বলে দাবি করা হয়েছে।

আর এই গুণটি প্রাথমিকভাবে পশ্চিমবঙ্গের টাঙ্গাইলকে ইঙ্গিত করে। এর ফলে মনে হতে পারে যে টাঙ্গাইল ভারতের পশ্চিমবঙ্গ সংলগ্ন একটি অঞ্চল।

পশ্চিমবঙ্গের টাঙ্গাইল শাড়ির উৎপত্তি সম্পর্কে সোশ্যাল মিডিয়ায় উত্থাপিত প্রশ্নের আলোকে এখানে বিষয়টি সমাধানের চেষ্টা করা হলো। টাঙ্গাইল শাড়ি সম্পর্কিত ভারতের ভৌগোলিক নির্দেশক/চিহ্ন নিবন্ধন বিবরণের অনুপস্থিতির কারণে কিছু বিষয় অনুমান করা যায়। এ রকম একটি অনুমান হলো যে টাঙ্গাইল শাড়ির উৎপত্তি ভারতের পশ্চিমবঙ্গের টাঙ্গাইল নামক একটি ভৌগোলিক অবস্থানে হতে পারে, যেখান থেকে এর স্বতন্ত্র গুণ, খ্যাতি বা বৈশিষ্ট্য পাওয়া যেতে পারে। আরেকটি বিকল্প অনুমান বলে যে, টাঙ্গাইল শাড়ি তাঁতীদের অধিকাংশই দেশভাগের পর ভারতের পশ্চিমবঙ্গে স্থানান্তরিত হয়, যেখানে তারা এই প্রথাগত শৈল্পিক সৃষ্টি তৈরিতে অবিরত ছিল।

টাঙ্গাইলের ভৌগোলিক উৎপত্তির ক্ষেত্রে, তা ভারতের পশ্চিমবঙ্গ বা বাংলাদেশই হোক না কেন, ভারত ও বাংলাদেশ উভয়েরই আইনি ব্যবস্থার অধীনে সমজাতীয় ভৌগোলিক নির্দেশের (Homoûmous GI) নীতিগুলো স্বীকৃত। যদিও বানান এবং উচ্চারণের ক্ষেত্রে সমজাতীয় ভৌগোলিক নির্দেশক/চিহ্ন গুলো একইরকম নামকরণ করে, তবুও তারা স্বাধীন সুরক্ষা পাওয়ার জন্য মানদণ্ড পূরণ করতে পারে। তা সত্ত্বেও, সমজাতীয় GI রেজিস্ট্রেশন সিস্টেমটি অত্যন্ত জটিল যে সম্ভাবনার কারণে একই গুণাবলি, খ্যাতি এবং পণ্যের অন্যান্য গুণাবলি উভয় GI-তে উপস্থিত নেই। অধিকন্তু, এই ব্যবহার সম্ভাব্যভাবে ভোক্তাদের বিভ্রান্তির দিকে নিয়ে যেতে পারে, যার ফলে বাজারের মধ্যে অন্যায্য প্রতিযোগিতা (Unfair Competition) বৃদ্ধি পায়।

বাংলাদেশের টাঙ্গাইল থেকে অভিবাসী পশ্চিমবঙ্গের তাঁতীরা টাঙ্গাইল শাড়ি প্রস্তুত করে - এ দাবির প্রতি শ্রদ্ধা রাখলেও ভৌগোলিক নির্দেশক/চিহ্ন এর মৌলিক মানদণ্ড যে GI বহনকারী পণ্যটির উৎপত্তি অবশ্যই সেই অঞ্চলের সদস্য বা আঞ্চলিক এলাকার মধ্যে হতে হবে- এ শর্তটি পূরণে এখানে সমস্যা হতে পারে। এটি ইঙ্গিত করে যে যদি এটি প্রমাণিত না হয় যে একই নামের একটি সদৃশ অবস্থান ভারতের পশ্চিমবঙ্গে বিদ্যমান, তবে GI পণ্য হিসেবে যোগ্যতা অর্জনের জন্য টাঙ্গাইল শাড়িকে অবশ্যই বাংলাদেশের টাঙ্গাইলের হতে হবে। মোটকথা, টাঙ্গাইলের ভৌগোলিক উৎপত্তি এবং পণ্য ‘টাঙ্গাইল শাড়ি’র মধ্যে একটি দৃঢ় সম্পর্ক থাকা আবশ্যক। এই পারস্পরিক সম্পর্ক মানুষের হস্তক্ষেপ, প্রাকৃতিক ঘটনা, খ্যাতি, বা উভয়ের সংমিশ্রণের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে।

উপরে বর্ণিত কারণে বাংলাদেশ থেকে আগ্রহী পক্ষ ভারতীয় GI রেজিস্ট্রি এবং প্রয়োজনে আপিল বোর্ডের কাছে টাঙ্গাইল শাড়ির নিবন্ধন বাতিল করার জন্য আবেদন করতে পারে। যদি সম্ভাব্য প্রতিটি পদক্ষেপের চেষ্টা করা সত্ত্বেও স্বত্বাধিকারীগণ এই মত পোষণ করে যে বিরোধটি বাণিজ্য বিধি লঙ্ঘনের সঙ্গে সম্পর্কিত, তবে স্বত্বাধিকারীগণের প্রতিনিধিত্বকারী বাংলাদেশ রাষ্ট্র WTO-এর বিরোধ নিষ্পত্তি সংস্থার আশ্রয় নেয়ার কথা বিবেচনা করতে পারে। তবে বাংলাদেশ একটি অসুবিধার সম্মুখীন হতে পারে এ কারণে যে এটি এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে GI পণ্য হিসেবে টাঙ্গাইল শাড়ি নিবন্ধন করেনি। আদি দেশ হিসেবে টাঙ্গাইল শাড়ি নিবন্ধনে বাংলাদেশের ব্যর্থতা দেশটিকে ভারতীয় আদালতে GI পণ্য হিসেবে টাঙ্গাইল শাড়ি নিবন্ধন বাতিলের মামলা রুজু করতে সমস্যায় ফেলতে পারে, কারণ মেধাস্বত্ব চুক্তির স্বাধীনতার সুরক্ষা বিধিতে ব্যতিক্রম হিসেবে GI পণ্যগুলোকে প্রাথমিকভাবে মূল দেশে নিবন্ধন করার কথা বলা হয়েছে।
তদুপরি, বাংলাদেশের টাঙ্গাইল নামের একটি ভৌগোলিক অঞ্চল ভারতের পশ্চিমবঙ্গে অবস্থিত অনুরূপ নামের সঙ্গে মিল হওয়ার ঘটনাটি প্রতিষ্ঠিত হলে টাঙ্গাইল শাড়ির সুরক্ষা আন্তর্জাতিক উদ্বেগের বিষয় হয়ে উঠবে। লিসবন অ্যাগ্রিমেন্ট অন অ্যাপিলেশনস অফ অরিজিন অ্যান্ড জিওগ্রাফিক্যাল ইন্ডিকেশনস এর জেনেভা অ্যাক্ট ২০১৫ যা GI-এর কেন্দ্রীয় রেজিস্ট্রি হিসেবে কাজ করে, উৎপত্তির ট্রান্স-বর্ডার ভৌগোলিক এলাকা সম্পর্কে বিদ্যমান উদ্বেগ নিয়ে সম্বোধন করেছে। এটি শর্ত দেয় যে যদি একটি ভৌগোলিক অঞ্চলে একটি আন্তঃসীমান্ত অঞ্চল থাকে তবে প্রতিবেশী চুক্তিকারী পক্ষগুলো তাদের চুক্তি অনুসারে একটি সাধারণভাবে মনোনীত সক্ষম কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে যৌথভাবে একটি আবেদন জমা দিতে পারে। লিসবন ইউনিয়নের কাঠামোর মধ্যে, লিসবন চুক্তির জেনেভা আইন ২০১৫ এইভাবে ট্রান্স-বর্ডার GI-এর একীভূত নিবন্ধনের পথ প্রশস্ত করে। বাংলাদেশ ও ভারত অবশ্য লিসবন চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী না হওয়ায় জেনেভা আইন ২০১৫ এদের মধ্যে বিরোধ সমাধানে অক্ষম।

অভ্যন্তরীণভাবে টাঙ্গাইল শাড়ির মতো সমজাতীয় ভৌগোলিক নির্দেশক (Homoûmous GI) হিসেবে আন্তঃসীমান্ত ভৌগোলিক নির্দেশ (GI) এর ক্ষেত্রে বাংলাদেশি টাঙ্গাইল শাড়ি এবং ভারতীয় টাঙ্গাইল শাড়ি নামে স্বতন্ত্র এবং স্বাধীন নিবন্ধন সম্ভব হতে পারে। তবে স্বতন্ত্র নিবন্ধন পদ্ধতি দীর্ঘ, ব্যয়বহুল এবং কষ্টকর। তদ্বিষয়ক, এটি সম্ভাব্যভাবে টাঙ্গাইল শাড়িকে GI পণ্য হিসেবে অন্যান্য দেশে সেমি-জেনারিক করতে পারে, যার ফলে সেই নির্দিষ্ট দেশে টাঙ্গাইল শাড়ির GI সুরক্ষা প্রত্যাহার হতে পারে।

https://mzamin.com/news.php?news=97799