১৫ মে ২০১৭, সোমবার, ৩:২৮

নীতি দুর্নীতি অর্থনীতি

ব্যাংকিং খাতের সংশোধনী দুটির অর্থ কী?

ব্যাংক কোম্পানি আইন-১৯৯১ আবার সংশোধিত হবে বলে একটা খবর দেখলাম। এতে বলা হয়েছে, ব্যাংক পরিচালকরা ছয় বছরের জায়গায় নয় বছর পরিচালক থাকতে পারবেন- তা অবশ্যই একনাগারে। দ্বিতীয় সংশোধনটি হচ্ছে পরিবারপিছু এখন থেকে বোর্ডে দুইজনের স্থলে চারজন পরিচালক থাকতে পারবেন। সংশোধনীটিতে মন্ত্রিসভা অনুমোদন দিয়েছে। এরপর তা যাবে সংসদে এবং তা পাস হলে আইনটি কার্যকর হবে। কাগজেই দেখলাম এই সংশোধনীতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সম্মতি ছিল না। এতদসত্ত্বেও অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংকিং বিভাগ তা অনুমোদন দিয়ে মন্ত্রিসভায় নিয়ে গেছে। স্বভাবতই এতে নানা প্রশ্ন সামনে এসেছে। দেখলাম একযোগে প্রায় সব কাগজ সরকারি এ সিদ্ধান্তের কুফল নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে। অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংকাররাও বেসরকারি ব্যাংকের ভবিষ্যৎ নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। তারা বলছেন, প্রস্তাবিত সংশোধনী দুটি সংসদে পাস হয়ে আইনে পরিণত হলে ব্যাংকগুলো একেকটি পরিবারের নিয়ন্ত্রণে চলে যাবে। অর্থনৈতিক ক্ষমতা কুক্ষিগত হবে। এর ফলে সাধারণ আমানতকারীরা হবেন ক্ষতিগ্রস্ত। ব্যাংক চলবে হরেদরে। এ ধরনের নানামুখী আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন অনেকেই।


এ অবস্থায় প্রথমে সরকারের কাছে প্রশ্ন এ সংশোধনী দুটি কি জরুরি ছিল? ব্যাংকিং খাতের বর্তমান সমস্যা কি এতে দূরীভূত হবে, না ঘনীভূত হবে? সবাই চায় ‘ব্যাংকিং কমিশন’। অর্থমন্ত্রীও তা চান। এটা তার বহুদিনের প্রতিশ্রুতি। এই প্রতিশ্রুতি পালিত হলে ব্যাংকিং খাতের সমস্যাগুলো জানা যাবে এবং এর সমাধানে সুপারিশ আসবে গবেষক, ব্যাংকার, অর্থনীতিবিদ এবং সংশ্লিষ্টদের কাছ থেকে। সরকারের সুবিধা হবে পদক্ষেপ নিতে। এই কাজটি না করে হঠাৎ করে দেশে কী হল যে, সরকারকে এমন দুটো সংশোধনী আনতে হচ্ছে? এটা কি ‘ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশের’ পরিচালনা বোর্ড রদবদলের সঙ্গে সম্পর্কিত? জানি না। তবে বলাই যায়, ব্যাংকিং খাতের সমস্যার কথা বহুল আলোচিত। করণীয় কী, তা-ও জানা। ‘হলমার্ক’ সমস্যার সমাধান হয়নি, বেসিক ব্যাংকের জালিয়াতির কোনো সুরাহা হয়নি। খেলাপি ঋণ দিন দিন বাড়ছে। ঋণ পুনঃতফসিলেও কাজ হচ্ছে না। করতে হচ্ছে ঋণ পুনর্গঠন (রিস্ট্রাকচারিং)। শোনা যায়, পুনর্গঠিত ঋণগ্রহীতারা টাকা ফেরত দিতে পারছেন না। সরকারি ব্যাংকে মূলধনের ঘাটতি। ব্যাংকিং খাতের কম্পিউটারায়ন বিঘ্নিত। এসব সমস্যার কোনো সমাধানের পথে না গিয়ে হঠাৎ ব্যাংক মালিকদের নিয়ন্ত্রণ নিরংকুশ করায় এ পদক্ষেপ কার স্বার্থে- ব্যাংকিং খাতের, না সরকারের।

যদি ব্যাংক মালিকদের নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা বৃদ্ধিই লক্ষ্য হয়ে থাকে তাহলেও প্রশ্ন। বর্তমানে একজন পরিচালক ছয় বছর একনাগারে পরিচালক থাকতে পারেন এবং এক পরিবার থেকে থাকতে পারেন দুইজন। এতে কী অসুবিধা হচ্ছে? ছয় বছর পর তাদের মনোনীত ছেলেমেয়ে, আত্মীয়স্বজন, ভাই-ব্রাদাররাই পরিচালক হন। শত হোক অবসরে যাওয়া পরিচালকের শেয়ার তো কেউ নিয়ে নেয় না। অতএব নিয়ন্ত্রণ তো মালিকদের হাতেই থেকে যায়। পরিবার পিছু দুইজনের স্থলে চারজন হলে নিয়ন্ত্রণের একটু সুবিধা হয় বটে। বর্তমানে ব্যাংকওয়ারি খবর নিলে দেখা যাবে প্রায় প্রতিটি বেসরকারি ব্যাংকই এক বা দুই পরিবারের নিয়ন্ত্রণে আছে। যে কোনো কর্মকর্তাকে জিজ্ঞেস করলেই এ খবর পাওয়া যাবে। যেখানে এক পরিবারের হাতে নানাভাবে কার্যকর নিয়ন্ত্রণ আছে সেখানে অসুবিধা নেই। কিন্তু দুই বা তিন পরিবারের হাতে নিয়ন্ত্রণ থকলেই ‘মারামারি’, ‘গণ্ডগোল’ হচ্ছে- যার শিকার অনেক ক্ষেত্রেই হয় কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা। এক মালিকের হাত থেকে আরেক মালিকের কাছে গেলেই বহুলোকের চাকরিচ্যুতি ঘটছে। এ অবস্থায় দুইজনের স্থলে চারজন পরিচালক এক পরিবার থেকে হলে একটি নির্দিষ্ট পরিবারের নিয়ন্ত্রণ পাকাপোক্ত হয়। কিছু প্রশ্ন আছে। বর্তমানে কোনো পরিবারই ব্যাংকের দশ শতাংশের বেশি শেয়ারের মালিক হতে পারে না। এ বিধান কি পরিবর্তিত হয়েছে? দুইয়ের জায়গায় চারজন পরিচালক হয়ে কি তারা ২০ শতাংশ শেয়ার ধারণ করতে পারবে? তা না হলে তো বোর্ড গঠনে তারা ক্ষমতা দেখাতে পারবে না। এ বিষয়টি আমার কাছে পরিষ্কার নয়। তবে ব্যাংক মালিকদের ‘খুশিখুশি’ ভাব দেখে মনে হয় ঝুলিতে বিধান আছে যা আগামীতে আসবে। মজার ঘটনা হচ্ছে সবাই জানে ব্যাংকিং খাত ধীরে ধীরে কিছুসংখ্যক পরিবারের হাতে চলে যাচ্ছে। সবাই উদাহরণও জানে; কিন্তু খোলাখুলি আলোচনা কেউ করে না। ব্যাংকগুলো তিন-চার দফায় তিনটি সরকার দিয়েছে। জাতীয় পার্টি, বিএনপি এবং আওয়ামী লীগের সৃষ্টিই এ ব্যাংকগুলো। আগে বড় ধরনের মারামারি ছিল রাজনৈতিকভাবে! এখন তা নেই। আপসে দলভেদে তারা ব্যাংক এখন নিয়ন্ত্রণ করে। হয়তো একে আনুষ্ঠানিক রূপ দেয়ার তাগিদেই নতুন নতুন পরিবর্তন হচ্ছে এবং আরও হবে এবং শেষ পর্যন্ত পরিবারভিত্তিক ব্যাংকই হবে। বলা যাবে অমুক পরিবারের অমুক ব্যাংক। বস্তুত সব ক্ষেত্রেই তা হচ্ছে। চিনি, চাল, ডাল, লবণ, তেল, পেঁয়াজ জাতীয় পণ্য আমদানি করে কয়েকটি পরিবার এবং এ ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ তারাই করে। বিদ্যুৎ ব্যবসা কারা নিয়ন্ত্রণ করে, কয় পরিবার করে তা-ও সবার জানা। নির্মাণ খাতের ব্যবসা কারা নিয়ন্ত্রণ করে তাও জানা। সব ব্যবসাই ধীরে ধীরে পরিবারের হাতে চলে যাচ্ছে। এটাই ‘বাজার অর্থনীতি’। অর্থনৈতিক ক্ষমতা কুক্ষিগত হচ্ছে কিছুসংখ্যক পরিবারের হাতে। ইসলামী ব্যাংকের বর্তমান পরিবর্তন এর একটা লক্ষণ মাত্র।

যখন এসব রোধ করা যাবে না, সরকার যখন এতে শক্তি জোগাবে তখন একটা ভরসার জায়গা হতে পারে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। একটা ব্যাংক যাতে যাচ্ছেতাই না করতে পারে তার জন্য রক্ষাকবচ হতে পারে বাংলাদেশ ব্যাংক। তাকে সেই ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। প্রশ্নটি শুধু ক্ষমতা ব্যবহারের। আশঙ্কা ব্যাংক মালিকরা নিজ নিজ ব্যাংকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে লুটপাট করবে- অন্তত এ আশঙ্কাই প্রকাশ করা হচ্ছে। এর প্রতিষেধক হতে পারে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। লুটপাট করে পরিচালকরা ব্যাংকের ক্ষতি করলে বাংলাদেশ ব্যাংক একজন, দুই বা ততোধিক পরিচালককে বরখাস্ত করতে পারে, প্রয়োজনে পুরো বোর্ড বাতিল করতে পারে। সরকার ব্যাংক অধিগ্রহণ করতে পারে। কোনো ব্যাংকের ঋণদান কার্যক্রম বন্ধ করে দিতে পারে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। কোনো ‘এমডি’ ব্যাংকের ক্ষতি বন্ধে বাংলাদেশ ব্যাংকে অভিযোগ করতে পারে। মালিকরা তার চাকরি যাতে না খেতে পারে তার সুরক্ষাও দিয়ে রেখেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। যদি দেখা যায়, সরকার সত্যি সত্যি সংশোধনী দুটি সংসদে পাসই করে ফেলবে, তাহলে দেশবাসী কেন্দ্রীয় ব্যাংককে বলতে পারে মেরুদণ্ড সোজা রেখে কাজ করতে, যাতে কোনো পরিবার ব্যাংক লুটপাট না করতে পারে। প্রশ্ন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক তার মেরুদণ্ড সোজা করতে পারবে কিনা। এ ব্যাপারে আমি নিশ্চিত নই। কারণ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন সবাই চাকরিজীবী। পদ-পদবি তাদের দরকার। এ অবস্থায় করণীয় কী? শক্তিশালী জনমত একে রোধ করতে পারবে? তা-ও তো মনে হয় না। ঈশ্বরের কাছে তাই প্রার্থনা- ‘প্রাইমারি একুমেলেশান অব ক্যাপিটেল’-এর জমানা শেষ হোক। যত তাড়াতাড়ি তা শেষ হয় ততই মঙ্গল। মেধা, পরিশ্রম ও প্রতিযোগিতাভিত্তিক অর্থনীতি গড়ে উঠুক দেশে। ‘এক্সেস টু পাওয়ার’ ব্যবসার ভিত্তি না হোক, নিয়ন্ত্রণের মাধ্যম না হোক, এ প্রার্থনা করে আজকের নিবন্ধ এখানেই শেষ করছি।

ড. আরএম দেবনাথ : সাবেক শিক্ষক ঢাবি

http://www.jugantor.com/sub-editorial/2017/05/15/124643/