১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, বুধবার, ৮:০৩

ভরা মৌসুমেও চড়া পেঁয়াজ

এখন পেঁয়াজের ভরা মৌসুম, কোথাও সংকট নেই

ফাইল ছবিবর্তমান সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে সচেষ্ট। সরকার বলছে, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে জোর দেওয়ার কথা। কিন্তু দাম কমছে না। উল্টো কোনো কারণ ছাড়াই হঠাৎ বেড়ে যাচ্ছে কোনো কোনো পণ্যের দাম। যেমন চলতি সপ্তাহে বেড়েছে পেঁয়াজের দাম, কেজিতে ৪০ টাকা পর্যন্ত। মসলাজাতীয় পণ্যটির এই ভরা মৌসুমেও দাম বাড়ার কারণ হিসেবে ব্যবসায়ীদের অজুহাত—সরবরাহ সংকট।
একই অজুহাত দেখিয়ে গত জানুয়ারির শেষ দিকে এক দফা বাড়ানো হয়েছিল পেঁয়াজের দাম। এর আগে ডিসেম্বরের প্রথমার্ধে ভারত পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধের ঘোষণা দিলে প্রতি কেজি দেশি পুরোনো পেঁয়াজের দাম উঠেছিল ২৪০ টাকা পর্যন্ত। অপরিণত মুড়িকাটা পেঁয়াজ বিক্রি হয় ১৭০ টাকায়। কয়েক বছর ধরে আগস্ট-সেপ্টেম্বরে পেঁয়াজের দাম লাফিয়ে বাড়া নিয়মিত ঘটনা হলেও ডিসেম্বর-জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতে মূল্যবৃদ্ধি বিরল।

বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম টিটু বলেছেন, মুড়িকাটা পেঁয়াজ উৎপাদনের তথ্য পেলে পরবর্তী করণীয় ঠিক করা হবে। ভারত থেকে শিগগির পেঁয়াজ আমদানি হচ্ছে।

ক্রেতারা বলছেন, এবার পেঁয়াজের মূল্যবৃদ্ধি কোনো যুক্তিতেই খাটে না। কারণ, ডিসেম্বরে বাজারে আগাম জাতের মুড়িকাটা পেঁয়াজ উঠেছে। এই পেঁয়াজ বাজারে উদ্বৃত্ত থাকতে থাকতেই মূল পেঁয়াজ অর্থাৎ হালি পেঁয়াজ বাজারে আসবে; যাতে আগামী কয়েক মাসেও দেশে পেঁয়াজের সংকট হওয়ার কোনো আশঙ্কা নেই। তাই এবারের দাম বাড়ার মূল কারণ ব্যবসায়ীদের অতি মুনাফার লোভ।
ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান আজকের পত্রিকাকে বলেন, দাম বাড়ালেই বেশি লাভ। এ কারণেই ব্যবসায়ীরা অতি মুনাফার লোভে দাম বাড়াচ্ছেন। ভোক্তার প্রত্যাশা পূরণে সরকারকে ব্যবসাবান্ধব না হয়ে জনবান্ধব হতে হবে।

রাজধানীর খুচরা বাজারে গতকাল মঙ্গলবার প্রতি কেজি মুড়িকাটা পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে ১১০-১২০ টাকায়। তিন-চার দিন আগে দাম উঠেছিল ১৩০-১৪০ টাকা। এক সপ্তাহ আগে বিক্রি হয় ৯০-১০০ টাকা। জানুয়ারির শেষে ঘন কুয়াশায় জমি থেকে পেঁয়াজ তুলতে না পারার কারণে সরবরাহ সংকটের অজুহাতে দাম উঠেছিল ১২০-১২৫ টাকায়। জানুয়ারির প্রথমার্ধে ছিল ৮০-৯০ টাকা। ডিসেম্বরের শুরুতে পুরোনো দেশি পেঁয়াজ ২৪০ টাকা এবং দাম বেশি থাকায় অপরিণত মুড়িকাটা পেঁয়াজ ১৭০ টাকায় বিক্রি হয়। পরে মুড়িকাটা পুরোদমে বাজারে এলে দাম কমে ৫৫-৬০ টাকা হয়েছিল।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ডিসেম্বরে বাজারে ওঠে আগাম জাতের মুড়িকাটা পেঁয়াজ। এবার এই পেঁয়াজের উৎপাদন হয়েছে ১০ লাখ টনের বেশি। তুরস্ক ও মিসর থেকেও পেঁয়াজ আমদানি করা হয়েছে। দেশে প্রতি মাসে পেঁয়াজের চাহিদা দুই লাখ টনের সামান্য বেশি। এই হিসাবে দেশে এখন পেঁয়াজের যথেষ্ট মজুত আছে। চলতি মাসের শেষে ও আগামী মাসে উঠবে হালি পেঁয়াজ। এটির উৎপাদন আরও বেশি।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী, দেশে বছরে পেঁয়াজের চাহিদা ২৫ লাখ টন। চাহিদার ৮৫ শতাংশই দেশে উৎপাদিত হয়। গত বছর জুন পর্যন্ত দেশে ১০ লাখ ৯২ হাজার টন পেঁয়াজ মজুত ছিল।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সূত্র জানায়, এবার ৬৩ হাজার হেক্টর জমিতে মুড়িকাটা পেঁয়াজ চাষের লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও আবাদ হয় ৬৬ হাজার ৭০০ হেক্টর জমিতে। হেক্টরপ্রতি সর্বনিম্ন ১৪ দশমিক ৭৯ টন পেঁয়াজ উৎপাদনের তথ্য এসেছে। কোনো কোনো জেলায় হেক্টরপ্রতি প্রায় ২৫ টন হয়েছে। তবে গড়ে ধরা হচ্ছে ২০ টন।

অধিদপ্তরের এই হিসাবের সঙ্গে পেঁয়াজ উৎপাদনের প্রধান জেলা পাবনার কৃষকদের তথ্যে মিল রয়েছে। তাঁদের মতে, দাম ভালো পাওয়ায় এবার হালি পেঁয়াজের কাছাকাছি পরিমাণ জমিতে মুড়িকাটা আবাদ করা হয়। পাবনার পাশাপাশি রাজবাড়ী, ফরিদপুরেও প্রচুর পেঁয়াজ চাষ হয়।

বিভিন্ন জেলার মোকাম, পাইকারি ও খুচরা বাজারে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কোথাও পেঁয়াজের সংকট নেই। পাবনা ও ফরিদপুরে পেঁয়াজ আছে। ফরিদপুর সদর উপজেলার কৃষক আবদুল মাজেদ বলেন, তিন দিন আগে তাঁদের এলাকায় প্রতি কেজি পেঁয়াজের দাম উঠেছিল ৯০-৯৫ টাকা। ব্যাপারীরা বিক্রি করেন ১১০-১১৫ টাকায়। বাজারে ম্যাজিস্ট্রেট এলে দাম কমে ৮০-৮৫ টাকা হয়েছে।

দাম বাড়ায় পেঁয়াজ কেনার পরিমাণ কমিয়েছেন ভোক্তারা। বেসরকারি চাকরিজীবী ইমরান হোসেন রাজধানীর বনশ্রীর একটি দোকান থেকে গতকাল ৩০ টাকায় ২৫০ গ্রাম পেঁয়াজ কেনেন। তিনি বলেন, এক মাস আগেও তিনি এই পেঁয়াজ ৮০ টাকা কেজি কিনেছেন। দাম বাড়ায় পরিমাণ কমিয়েছেন।

রামপুরা বাজারে ফুটপাতে পেঁয়াজ বিক্রেতা আরিফ হোসেন প্রতি কেজির দাম চাইলেন ১২০ টাকা। তিনি বললেন, কারওয়ান বাজারের আড়ত থেকে প্রতি কেজি ৯৫ টাকায় কিনেছেন। সঙ্গে আছে ভ্যানভাড়া ও অন্যান্য খরচ। এর সঙ্গে লাভ যোগ করে ১২০ টাকায় বিক্রি করছেন।

কারওয়ান বাজার ক্ষুদ্র আড়তদার সমিতির সভাপতি এ টি এম ফারুক ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, এই সময়ে প্রতি কেজি পেঁয়াজ ৫০ টাকার বেশি হওয়ার কথা নয়। অথচ দাম ১০০ টাকার বেশি। বাজারে পাকিস্তান ও তুরস্কের পেঁয়াজের সরবরাহ কমার সুযোগ নিয়ে কৃষকেরা পেঁয়াজ তোলা ও সরবরাহ কমিয়েছেন। এ কারণে দাম বাড়তি।

তবে পাবনার মথুয়াপুর গ্রামের কৃষক মামুনুর রহমান বলেন, তাঁদের এলাকায় মুড়িকাটা পেয়াঁজের মজুত প্রায় শেষ। আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে বাজারে হালি পেঁয়াজ উঠবে। কিছু কিছু জায়গায় হালি পেঁয়াজ তোলা শুরু হয়েছে।

পেঁয়াজ আমদানিকারক ঢাকার শ্যামবাজারের হাফিজুর রহমান বলেন, সরবরাহ সংকটে দাম কিছু বেড়েছিল। শিগগির ভারত থেকে পেঁয়াজ আমদানি শুরু হবে। তিন-চার দিনের মধ্যে দাম কমে আসবে।

হঠাৎ পেঁয়াজের মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে জানতে চাইলে বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আজকের পত্রিকাকে বলেন, কৃষি মন্ত্রণালয় থেকে উৎপাদনের তথ্য নেওয়া হচ্ছে। দেশে এবার কী পরিমাণ মুড়িকাটা পেঁয়াজ উৎপাদিত হয়েছে, সেই তথ্য পাওয়া গেলে পরবর্তী করণীয় ঠিক করা হবে। তবে ভারত থেকে শিগগির পেঁয়াজ আমদানি হচ্ছে।

https://www.ajkerpatrika.com/319552