১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, বুধবার, ৮:০১

গ্রামে গ্রামে ‘কঙ্কাল’ সড়ক

খুলনার কয়রার দেউলিয়া বাজার থেকে ঘোলপাড়া হয়ে ঝিলেঘাটা বাজারে যে সড়ক গেছে, সেটির দৈর্ঘ্য প্রায় ছয় কিলোমিটার। সড়কটির পিচ উঠে ইটের খোয়া বেরিয়ে যাওয়ায় গাড়ি চলে হেলেদুলে। রাস্তাটি থাকে ধুলায় ধূসর। এতে সড়কের পাশের গাছপালা, বসতবাড়ি, দোকানপাট, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়েছে বালুর প্রলেপ। এ রাস্তা দিয়ে চলাচলকারী যাত্রীদের যেমন দুর্ভোগের শেষ নেই, তেমনি সড়কের দু’পাশের বাসিন্দারাও ধুলাবালির যন্ত্রণায় হাঁপিয়ে উঠেছেন।

শুধু এ সড়কই নয়; দেশের প্রায় সব গ্রামীণ সড়কের এখন একই প্রতিচ্ছবি। পাকা রাস্তার বেশির ভাগের অবস্থা খারাপ। আর কাঁচা রাস্তা যাচ্ছেতাই। অনেক সড়কের বিটুমিন ও ইট উঠে কঙ্কালসার। রাস্তার রাস্তায় তৈরি হয়েছে বড় বড় গর্ত। কিছু কিছু সড়ক ভেঙেচুরে একাকার। আবার গত বন্যায় হাওরের তছনছ সড়ক এখনও থেকে গেছে সংস্কারের বাইরে।

এমনকি গ্রামীণ সড়ক নির্মাণ, আধুনিকায়ন ও মেরামতের দায়িত্ব পালন করে যে সংস্থা, সেই স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি) নিয়ন্ত্রণাধীন মন্ত্রণালয় স্থানীয় সরকার বিভাগের মন্ত্রী তাজুল ইসলামের নিজ জেলা কুমিল্লার বেশির ভাগ গ্রামীণ সড়কও বিধ্বস্ত।

গ্রামীণ সড়কের ‘মুমূর্ষু’ পরিস্থিতি নিয়ে জনপ্রতিনিধির হৃদয়েও হচ্ছে রক্তক্ষরণ। সেই চোটের বহিঃপ্রকাশ ঘটে ৪ ফেব্রুয়ারি। জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে সাতক্ষীরা সদর আসনের জাতীয় পার্টির এমপি আশরাফুজ্জামান আশু তাঁর নির্বাচনী এলাকার রাস্তাঘাটের করুণ চিত্র তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ‘পোস্ট অফিস মোড় থেকে সাতক্ষীরা সরকারি কলেজ সড়ক হয়ে কোনো অন্তঃসত্ত্বা যদি যাতায়াত করেন, তাহলে রাস্তায় তাঁর ডেলিভারি (সন্তান প্রসব) হয়ে যাবে।’

জানা গেছে, সারাদেশে গ্রামীণ সড়ক রয়েছে ৩ লাখ ৭০ হাজার কিলোমিটার। এর মধ্যে পাকা সড়ক ১ লাখ ৭০ হাজার কিলোমিটার। এসব রাস্তার দেখভাল করে এলজিইডি। প্রতিবছরের মে মাসে প্রতিষ্ঠানটি সড়কের বাস্তব পরিস্থিতি সংগ্রহ করে তা মেরামতের জন্য জুন-জুলাইয়ে সরকারের কাছে অর্থ বরাদ্দের আবেদন করে। গত বছর সরকারের কাছে রাস্তা মেরামতের জন্য এলজিইডি ৩০ হাজার কোটি টাকার আবেদন করেছিল। বিপরীতে বরাদ্দ মেলে ৩ হাজার ২০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে ২ হাজার ১১৪ কোটি টাকা পেয়েছে এলজিইডি।
এলজিইডির গড় হিসাব অনুযায়ী, প্রতি কিলোমিটার রাস্তা মেরামতের জন্য প্রয়োজন হয় ৪০ লাখ টাকা। বরাদ্দের টাকায় ৫ হাজার ২৮৫ কিলোমিটার সড়কের মেরামতকাজ করছে সংস্থাটি। সেই কাজ এখনও শেষ হয়নি। এ সময়ে সম্পূর্ণ মেরামতের বাইরে রয়েছে প্রায় ৭১ হাজার কিলোমিটার সড়ক। গত আট-নয় মাসের ব্যবধানে এসব সড়কের অবস্থা আরও বেহাল হয়েছে।

অবশ্য এ ব্যাপারে এলজিইডির নিয়ন্ত্রণাধীন মন্ত্রণালয় স্থানীয় সরকার বিভাগের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা অতিরিক্ত সচিব ড. মো. আমিনুর রহমান সমকালের কাছে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।

তবে এলজিইডির সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল কর্মকর্তা তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী আবু হানিফ মৃধা সমকালকে বলেন, আর্থিক সংকটের কারণে আমরা প্রয়োজনীয় রাস্তার কাজ করতে পারিনি, এটা ঠিক। তবে বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমেও কিছু রাস্তা মেরামতের কাজ চলছে। বর্তমানে ৬০-৭০টি প্রকল্প চলমান, যার মধ্যে রাস্তা মেরামতের কাজও আছে।

ধুঁকছে গ্রামীণ সড়ক
কুমিল্লা থেকে কামাল উদ্দিন জানান, কুমিল্লার ১৭ উপজেলার অধিকাংশ গ্রামীণ সড়কের অবস্থা বেহাল। বিশেষ করে করোনার সময় থেকে বরাদ্দ স্বল্পতায় অনেক রাস্তা সময়মতো মেরামত না করায় ভোগান্তি বেড়েছে চালক ও যাত্রীদের। অভিযোগ রয়েছে, মাঝেমধ্যে কিছু রাস্তার মেরামত হলেও নিম্নমানের কাজের কারণে স্বল্প সময়ের মধ্যেই রাস্তা আগের চেহারায় ফিরে আসে। এতে প্রায়ই ঘটছে দুর্ঘটনা।

নাঙ্গলকোটের রায়কোট উত্তর ইউনিয়নের অলিপুর বাজার থেকে অলিপুর-মন্তলী সড়কটি দীর্ঘদিন ধরে তছনছ। স্থানীয়রা সড়কটি মেরামত করতে এলজিইডির কাছে আবেদন করলেও কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলার সিদলাই-গাগড়াকাটা-মীরপুর সড়কের প্রায় ১২ কিলোমিটার সড়ক দীর্ঘ তিন বছর ধরে যাতায়াতের অনুপযোগী। সড়কের মাঝখানে থাকা বড় বড় গর্তে পড়ে উল্টে যাচ্ছে অটোরিকশাসহ ছোট-বড় অসংখ্য যানবাহন। সড়ক দিয়ে প্রতিদিন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে চলাচল করছে হাজারো মানুষ। এদিকে চান্দিনা উপজেলার মোকামবাড়ী-বারেরা-বদরপুর সড়ক, চান্দিনা-শীমন্তপুর সড়ক, চান্দিনা-বরকইট এবং কুটুম্বপুর-গল্পাই সড়কের প্রায় ৩৫ কিলোমিটার অংশ দীর্ঘদিন ধরে মেরামত না করায় জনগণের ভোগান্তির শেষ নেই। কুমিল্লার অন্য উপজেলার গ্রামীণ সড়কেরও এমনই বেহাল অবস্থা।

এ ব্যাপারে এলজিইডি কুমিল্লার নির্বাহী প্রকৌশলী মীর্জা মো. ইফতেখার আলী বলেন, এ অর্থবছরে ৬৫০ কিলোমিটার সড়ক মেরামতে ৪৮০ কোটি টাকার এবং ৭২০ কিলোমিটার সড়ক উন্নয়নে ৬৫০ কোটি টাকার কাজ চলমান। বাকি সড়ক অর্থ পাওয়া সাপেক্ষে মেরামত ও উন্নয়ন করা হবে।

সরেজমিন দেবিদ্বারের চরবাকর-মোহাম্মদপুর-নবীয়াবাদ সড়কে গিয়ে দেখা যায়, ওই সড়কের প্রায় ১৫ কিলোমিটার অংশেরই নাজুক পরিস্থিতি। প্রতিদিন সড়কটি দিয়ে কয়েক হাজার লোক যাতায়াত করে। স্থানীয়দের অভিযোগ, তিন বছর আগে সড়কটি মেরামত করা হলেও নিম্নমানের কাজের কারণে এক বছরের মধ্যেই অধিকাংশ স্থানের কার্পেটিং উঠে যায়। সামান্য বৃষ্টি হলে রাস্তাটি আরও বিপজ্জনক হয়ে ওঠে। দেবিদ্বারের ফতেহাবাদ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান কামরুজ্জামান মাসুদ বলেন, এ ইউনিয়নের খলিলপুর বাজার-নুরপুর-সুলতানপুর এবং জয়পুর প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে বড়কান্দা পর্যন্ত ১৫-২০ কিলোমিটার সড়ক চলাচলের সম্পূর্ণ অনুপযোগী। দেবিদ্বার উপজেলা প্রকৌশলী সবুজ চন্দ্র সরকার বলেন, চরবাকর-নবীয়াবাদ সড়কটির উন্নয়ন করতে সংসদ নির্বাচনের আগে ১৭ কোটি টাকা ব্যয়ে দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে। শিগগিরই কাজ শুরু হবে। উপজেলার অন্য সড়কগুলো মেরামতেও শিগগির উদ্যোগ নেওয়া হবে।
খুলনা থেকে মামুন রেজা জানান, খুলনার ৯ উপজেলার প্রায় ১ হাজার ২৩০ কিলোমিটার পাকা, আধাপাকা ও কাঁচা সড়কের অবস্থা জীর্ণ। বিশেষ করে পাকা ও আধাপাকা সড়কগুলোতে ছোট-বড় গর্ত তৈরি হওয়ায় যানবাহন চলাচলের সময় যাত্রীদের ভোগান্তিতে পড়তে হয়।

খুলনা এলজিইডি সূত্রে জানা গেছে, ৯টি উপজেলায় তাদের আওতাধীন সড়ক রয়েছে ৬ হাজার ৩০২ কিলোমিটার। এর মধ্যে পাকা (পিচ) রাস্তা ১ হাজার ৬১১ কিলোমিটার, ইটের সলিং রাস্তা ২ হাজার ১৮২ কিলোমিটার, ঢালাই (সিসি/আরসিসি) রাস্তা ৬৫ কিলোমিটার। আর কাঁচা রাস্তা রয়েছে ২ হাজার ৪৪৪ কিলোমিটার। এ কাঁচা সড়ক বর্ষাকালে পরিণত হয় যেন চষা জমিতে। কাদার কারণে সড়কে সাইকেল, মোটরসাইকেল ও ভ্যান চলাচল তো দূরের কথা, হাঁটাও দায় হয়ে পড়ে।

পাকা সড়কের মধ্যে ৪০২ দশমিক ৭৫ কিলোমিটার সড়ক জরাজীর্ণ ছিল। এই অর্থবছরে ৩৪৫ দশমিক ৮০ কিলোমিটার সড়ক সংস্কার করা হলেও এখনও প্রায় ৫৬ দশমিক ৯০ কিলোমিটার সড়কের অবস্থা বেহাল।

এ ব্যাপারে খুলনা এলজিইডির নির্বাহী প্রকৌশলী এ কে এম আনিছুজ্জামান বলেন, অর্থ সংকটের কারণে জরাজীর্ণ সব সড়ক একবারে সংস্কার করা সম্ভব হয় না। তবে পর্যায়ক্রমে পাকা ও আধাপাকা সড়কগুলো সংস্কার করা হচ্ছে।

কয়রা থেকে শেখ হারুন অর রশীদ জানান, কয়রার উত্তর বেদকাশি ইউনিয়নের কাটকাটা থেকে হরিহরপুর পর্যন্ত প্রায় পাঁচ কিলোমিটার ইটের সলিং সড়কের কোথাও বালু ও মাটি বেরিয়ে পড়েছে। আবার কোথাও দু’পাশের মাটি ধসে সরু হয়ে গেছে। তিন বছর আগে এ সড়ক দিয়ে ছোট ও মাঝারি যানবাহন চললেও এখন হেঁটে চলা দায়। তবে দূরত্বের কারণে ঝুঁকি নিয়ে চলছে ভাড়ায় চালিত মোটরসাইকেল।

এ সড়ক দক্ষিণ বেদকাশি ইউনিয়নের ২৫ হাজার মানুষের উপজেলা সদরে যাতায়াতের একমাত্র পথ। সড়কটির উন্নয়নে একাধিকবার উদ্যোগ নেওয়া হলেও তা বাস্তবায়ন হয়নি। এ কারণে উত্তর বেদকাশি ইউনিয়নের একাংশ ও দক্ষিণ বেদকাশি ইউনিয়নের মানুষকে বর্ষাকালে নদীপথে যাতায়াত করতে হয়।

এদিকে ডুমুরিয়া থেকে এম এ এরশাদ জানান, খর্ণিয়া ও শোভনা ইউনিয়নের নতুন রাস্তা থেকে কদমতলা পর্যন্ত সাত কিলোমিটার, শোভনা থেকে শিবপুর পর্যন্ত আড়াই কিলোমিটার, খর্ণিয়া থেকে বরাতিয়া পর্যন্ত তিন কিলোমিটার এবং কৈয়া থেকে শরাফপুর পর্যন্ত ১৩ কিলোমিটার পাকা সড়কের অবস্থা নাজুক।

খর্ণিয়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি নারায়ণ মল্লিক বলেন, ভদ্রাদিয়া-শোভনা সড়ক দিয়ে প্রতিদিন কোটি কোটি টাকার সবজি ও মাছ পরিবহন করা হয়। তবে সড়কটি দীর্ঘদিন ভাঙাচোরা থাকায় কৃষিপণ্যসহ মালপত্র পরিবহনে সমস্যা হচ্ছে।

নাটোর থেকে নবীউর রহমান পিপলু জানান, নাটোর-বাগাতিপাড়া সড়কে খানাখন্দ সৃষ্টি হওয়ায় জনসাধারণকে দুর্ভোগ নিয়ে যাতায়াত করতে হচ্ছে। ১৩ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের এ সড়কের চার কিলোমিটার অংশে কয়েক বছর আগে খানাখন্দ সৃষ্টি হয়। সড়কের দু’পাশের পাকা অংশসহ বিভিন্ন স্থানে এখন বড় বড় গর্ত।

জানা যায়, সড়কটিতে নাটোর সদর উপজেলার অংশ রয়েছে প্রায় চার কিলোমিটার। কয়েক বছর আগেই নাটোর অংশের চার কিলোমিটার সড়কের দু’পাশ ভেঙে যায়। ওই ভাঙা অংশের কার্পেটিং ধীরে ধীরে উঠে যেতে থাকে। কিছু স্থানে ভাঙন দেখা দেয়। যানবাহন চলাচলের কারণে ভাঙন বড় হতে হতে সড়কটি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। এ অবস্থায় সদর উপজেলার লোকজন বাগাতিপাড়া যাওয়ার জন্য তমালতলা হয়ে বিকল্প সড়ক ব্যবহার করছেন। তবে এ জন্য প্রায় তিন কিলোমিটার বেশি ঘুরতে হয়।

সদর উপজেলার রামনগর এলাকার বাসিন্দা রফিকুল ইসলাম এবং টেটনপাড়া গ্রামের মিনহাজ ও বুড়ির বটতলা এলাকার শাহিন জানান, পাঁচ বছর আগে সড়কটি ভেঙেছে। অথচ সড়কটি দিয়ে ৪০ গ্রামের মানুষ নাটোর জেলা সদর বা বাগাতিপাড়া উপজেলায় যাতায়াত করেন। নাটোরের তেবাড়িয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ওমর আলী বলেন, সড়কটি সংস্কারের জন্য এলজিইডির কাছে বেশ কয়েকবার আবেদন করা হয়েছে। গত বছর কিছু অংশ মেরামত করা হলেও তা ফের আগের অবস্থায় ফিরে এসেছে।

নাটোর এলজিইডির নির্বাহী প্রকৌশলী শহিদুল ইসলাম জানান, সড়কটি বিদেশি প্রকল্পের আওতায় পুনর্নির্মাণের জন্য কাগজপত্র ঊর্ধ্বতন দপ্তরে পাঠানো হয়েছে। প্রকল্পটি পাস হলে সড়কের ভাঙা অংশ পুনর্নির্মাণকাজ শুরু করা হবে।

সুনামগঞ্জ থেকে পঙ্কজ দে জানান, ২০২২ সালে হাওরে বন্যার সময় সুনামগঞ্জ সদরের কাঠইর-জামালগঞ্জ সড়কটি চুরমার হয়ে যায়। কিছু অংশ হয়ে যায় প্রায় নিশ্চিহ্ন। সড়কটি এখনও চলাচলের উপযোগী হয়নি। সম্প্রতি শুধু মাটির কাজ হয়েছে, পিচ ঢালাই হয়নি। পানি থেকে সড়কটি রক্ষার কাজও বাকি। এ রকম আরও বেশ কয়েকটি সড়ক রয়েছে জেলাজুড়ে, যেগুলো হাওরে বন্যার সময় তছনছ হয়ে গিয়েছিল। এসব সড়ক দিয়ে এখনও মানুষ স্বাচ্ছন্দ্যে যাতায়াত করতে পারছে না।

https://samakal.com/bangladesh/article/222905