১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, বুধবার, ৭:৫৯

সুবিধার পাশাপাশি ভোগান্তিও বাড়ছে

দেশের অন্যতম প্রধান পর্যটনকেন্দ্র কক্সবাজার ভ্রমণে পর্যটকদের জন্য যতই সুযোগ-সুবিধা বাড়ছে, ততই পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ভোগান্তি। পর্যটক হেনস্তার ঘটনা বাড়ছে উদ্বেগজনক হারে। বাড়ছে চুরি, ছিনতাই, দস্যুতা, ধর্ষণসহ নানা অপরাধজনক ঘটনা।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, কক্সবাজার শহরে বেশ কিছু সিএনজিচালিত গাড়ি, ট্যাক্সি, ইজি বাইক (টমটম) ও রিকশা চালক (দালাল) বাসস্টপেজগুলোতে ঘুরঘুর করে।

পর্যটকবাহী কোনো গাড়ি থামানোর সঙ্গে সঙ্গেই হোটেলে কক্ষ ভাড়া করিয়ে দিয়ে কমিশন নিতে দালালরা শুরু করে টানাটানি। এভাবেই শুরু হয় হেনস্তা।

কক্সবাজার বাস টার্মিনাল, কলাতলীর মোড়, সুগন্ধা পয়েন্ট, হলিডে মোড়সহ পুরো কলাতলী জোনে পর্যটকদের টানাহেঁচড়ার চিত্র নিত্যদিনই দেখা যায়। দালালরা পর্যটকদের নানাভাবে প্রলোভন দেখানো শুরু করে।

এসব দালাল বিভিন্ন পয়েন্ট থেকে পর্যটকদের নানা কৌশলে কটেজগুলোর স্পা ম্যাসাজ ও ইয়াবার ডেরায় নিয়ে আসে। প্রতিটি কটেজে ২০ থেকে ৩০ জন করে নারী রাখে দালালরা, যাদের মধ্যে অনেকেই রোহিঙ্গা তরুণী। পর্যটকদের এসব ডেরায় এনে জোর করে আপত্তিকর ভিডিও ধারণ করার পর টাকা-পয়সা হাতিয়ে নেয় তারা।

এসব ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে গত সোমবার ট্যুরিস্ট পুলিশ কক্সবাজার জোনের পুলিশ সুপার আপেল মাহমুদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘কক্সবাজার পর্যটনের জন্য অশনিসংকেত হয়ে উঠেছে ইয়াবা ও স্পা ম্যাসাজের ডেরা।

লাইট হাউস এলাকার ডেরাটি ছাড়াও আরো ৩৫টি স্পা ম্যাসাজ সেন্টার পর্যটক হয়রানির স্থান। এসব ডেরা আমরা উচ্ছেদ করব।’
পুলিশ সুপার জানান, গত রবিবার দিবাগত রাত ২টার দিকে ট্যুরিস্ট পুলিশ এসব ডেরায় অভিযান চালিয়ে কেবল শিউলী কটেজ থেকে ম্যাসাজ গার্ল হিসেবে পরিচিত ২৫ জন নারীসহ ৩৫ জনকে আটক করেছে। এর আগে সৈকতের মোবাইল ফোনসেট চোর সিন্ডিকেট, প্রতারকচক্র, ছিনতাইকারী, দালালসহ শতাধিক অপরাধীকে ট্যুরিস্ট পুলিশ আটক করে।

গত বছরের ৪ সেপ্টেম্বর রাতে দুই পর্যটক তরুণীকে অপহরণের পর সন্ত্রাসীদল একটি কটেজে নিয়ে দলবদ্ধ ধর্ষণ করে।
পরের দিন ভুক্তভোগী এক তরুণীর করা মামলায় ধর্ষক সোলায়মান শামীম, মনিরুল ইসলাম হারবদল ও রশিদ ড্রাইভারকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে। আসামিরা কারাগারে আটক রয়েছে।

গত ১ ডিসেম্বর রাতে সাগরপারে ওশান প্যারাডাইস হোটেলের সামনে প্রধান সড়কে সৌদি আরব থেকে আসা পর্যটককে ছুরিকাঘাত করে তাঁর টাকা-পয়সা লুটে নেয় ছিনতাইকারীরা। এ ঘটনায় ট্যুরিস্ট পুলিশ চার ছিনতাইকারীকে গ্রেপ্তার করেছে।

গত বছর বেড়াতে আসা এক পরিবারের হোটেলকক্ষে ঢুকে স্বামী ও শিশুসন্তানকে বেঁধে রেখে স্ত্রীকে ধর্ষণের ঘটনায় তোলপাড় সৃষ্টি হয়। ওই মামলায় শহরের বাহারছড়া মহল্লার দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী আশিকুল ইসলামসহ সাতজনের বিরুদ্ধে পুলিশ অভিযোগপত্র দেয় আদালতে। কক্সবাজারের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে মামলাটি অভিযোগ গঠন শেষে সাক্ষ্যগ্রহণের জন্য রয়েছে।

কক্সবাজার নাগরিক ফোরামের সভাপতি আ ন ম হেলাল উদ্দিন এসব বিষয় নিয়ে বলেন, কক্সবাজার ভ্রমণে সর্বশেষ যোগ হয়েছে রেল যোগাযোগ। ঢাকার সঙ্গে বিমান যোগাযোগ ছাড়াও রয়েছে অত্যাধুনিক এবং আরামদায়ক যাত্রীবাহী বাস। রাতযাপনের জন্য রয়েছে পাঁচ শতাধিক হোটেল। এত সব সুযোগ-সুবিধা থাকা সত্ত্বেও এখানে আসা পর্যটকরা স্বস্তি পায় না—বিষয়টি খুবই দুঃখজনক।

কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রফিকুল ইসলাম বলেন, একের পর এক অপরাধমূলক ঘটনায় দেশের প্রধান পর্যটনকেন্দ্রটির ভাবমূর্তি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। লাখ লাখ পর্যটকের নিরাপত্তাবিধানে জেলা পুলিশসহ ট্যুরিস্ট পুলিশের লোকবল বাড়ানো জরুরি।

রাঙামাটিতে হোটেল ও গাড়িতে বাড়তি খরচ
পাহাড় প্রকৃতি হ্রদ দেখার জন্য রাঙামাটিতে বেড়াতে আসে পর্যটকরা। শহর ছাড়িয়ে দূর পাহাড়ের উপত্যকা সাজেকেও ছড়িয়ে পড়ে তারা। কিন্তু এখানে শহরেও সন্ধ্যা হলেই নেমে আসে ঘোর অন্ধকার, তাই সন্ধ্যাকালীন বিনোদনের ব্যবস্থা নেই। পর্যটনবান্ধব পরিবেশ বিনির্মাণেও নেই কোনো পদক্ষেপ।

রাঙামাটির হিল ট্যুরিজম সার্ভিসের নির্বাহী পরিচালক গালিব হাসান বলেন, এখানে পর্যটকদের সমস্যার শেষ নেই। রেস্টুরেন্টে খাবারের বাড়তি দাম, হ্রদে নৌভ্রমণ কিংবা সড়কের একমাত্র বাহন অটোরিকশার বাড়তি ভাড়ার কারণে তাদের আনন্দ মাটি হয়ে যায়।

কুষ্টিয়া থেকে বেড়াতে আসা মামুন মৃধা বলেন, রাঙামাটি দারুণ সুন্দর এক জেলা। তবে এখানে বিভিন্ন স্থানে ঘুরতে গাড়ি ও বোট ভাড়ায় বেশি টাকা খরচ হয়।

রাঙামাটি ট্যুরিস্ট পুলিশের দায়িত্বে থাকা অতিরিক্ত পুলিশ সুপার হাসান ইকবাল চৌধুরী বলেন, এখানে পর্যটনকেন্দ্রিক সামাজিক অপরাধ নেই বললেই চলে। তবে দর্শনার্থীদের সবচে বড় সমস্যা হলো পুরো শহরে পাবলিক টয়লেটের অভাব।

খাগড়াছড়িতে পরিবহনেই পকেট ফাঁকা
পর্যটক হয়রানি ও নিরাপত্তার হুমকি না থাকলেও খাগড়াছড়িতে পর্যটকদের জন্য অস্বস্তিকর বিষয় হলো এখানকার পরিবহন ও হোটেল-রেস্তোরাঁয় বাড়তি খরচ।

ঢাকা থেকে আসা পর্যটক আব্দুল গনি জানালেন, সাজেক-খাগড়াছড়িতে ঘুরতে যে পরিমাণ টাকা লাগে, তা দিয়ে ভারতের দার্জিলিং ঘুরে আসা যায়। পর্যটকদের অভিযোগ, পরিবহন মালিকরা সিন্ডিকেট করে এই সড়কে ভাড়া বাড়িয়েছেন লাগামহীন। এখান থেকে রাঙামাটির সাজেক পর্যন্ত প্রায় ৭০ কিলোমিটার সড়কে একটি পিক-আপ এক রাতের জন্য ভাড়া নিচ্ছে ১০ হাজার ৫০০ টাকা। খাগড়াছড়ি সদরের আলুটিলা, রিছাং ঝরনা ও জেলা পরিষদ পার্ক ঘুরতে লাগে বাড়তি আরো দুই হাজার টাকা।

জিপ মালিক সমিতির সভাপতি আব্দুল আজিম বলেন, তেলের মূল্যবৃদ্ধির কারণে ভাড়া বাড়াতে হয়েছে। কার-মাইক্রোবাস মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক শাহ আলম জানান, মালিক ও চালকরা বৈঠক করে ভাড়া বাড়িয়েছেন।

https://www.kalerkantho.com/print-edition/last-page/2024/02/14/1363478