১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, বুধবার, ৭:৫৭

সীমান্তে বিএসএফের হত্যা-নির্যাতন চলছেই

বারবার ভঙ্গ গুলি না ছোড়ার প্রতিশ্রুতি

সীমান্তে হত্যাকাণ্ড ঘটলেই পতাকা বৈঠক হয় দুই দেশের মধ্যে। প্রতিবারই বাংলাদেশ যথেষ্ট উদ্বেগ প্রকাশ করে। আর ভারত প্রতিশ্রুতি দেয় সীমান্তে হত্যার সংখ্যা শূন্যে নামিয়ে আনার। বিএসএফ রাবার বুলেট ব্যবহার করবে, প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করবে না। বাংলাদেশের মানুষ ভারতের থেকে এমন প্রতিশ্রুতিও শুনেছে অসংখ্যবার। ভারতের পক্ষ থেকে এমন প্রতিশ্রুতি বারবার দেয়া হলেও সীমান্তে বাংলাদেশী নাগরিকদের হত্যা ও নির্যাতনের ঘটনা বেড়েই চলেছে। এমনকি বাংলাদেশ সীমান্তের ভেতরে প্রবেশ করে সাধারন মানুষকে ধরে নিয়ে নির্যাতন ও বিভিন্ন মামলায় আটকে রাখার ঘটনাও কম নয় বিএসএফয়ের।

দিল্লি সফর শেষে গত সোমবার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ বলেছেনে, সীমান্ত হত্যা কমাতে নন-লিথাল ওয়েপন (প্রাণঘাতী নয় এমন) ব্যবহারের বিষয়ে সম্মত বাংলাদেশ-ভারত। নন-লিথাল ওয়েপন ব্যবহার অপারেশনাল করার বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ ও ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর। তবে গত রোববার কুড়িগ্রামের রৌমারী উপজেলার দাঁতভাঙ্গা ইউনিয়নের ধর্মপুর সীমান্তের আন্তর্জাতিক ১০৫৭ সীমানা পিলারের কাছে গরু পাচারের চেষ্টাকালে গ্রামবাসীর সঙ্গে চোরাকারবারিদের ধস্তাধস্তির ঘটনা ঘটেছে। এ সময় বিএসএফের গুলিতে দুই বাংলাদেশির আহত হন। আহতদের মধ্যে জব্বার মিয়া (৫২) উপজেলার ধর্মপুর গ্রামের বাসিন্দা। তবে অন্যজনের নাম-পরিচয় জানা যায়নি। গত ৫ ফেব্রুয়ারি রাতে ফেনীর পূর্ব ছাগলনাইয়া এলাকায় এক ব্যক্তিকে বিএসএফ ধরে নিয়ে গেছে-এমন গুঞ্জন শুনে স্থানীয়রা খবর নিতে সেখানে ছুটে যান। এ সময় বিএসএফ সদস্যরা তাদের ধাওয়া শুরু করে। ধাওয়ার মুখে অনেকেই পালিয়ে আসতে সক্ষম হলেও সেখান বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তের ৯৯ নম্বর পিলার সংলগ্ন পূর্ব ছাগলনাইয়া এলাকা থেকে ২৩ জনকে ধরে নিয়ে যায় বিএসএফ। পরে চোরাচালানকারী হিসেবে তাদের বিরুদ্ধে এফআইআর করে স্থানীয় মনু বাজার থানায় পুলিশের কাছে হস্তান্তর করে বিএসএফ। ওই ২৩ বাংলাদেশীর ভাগ্যে কি ঘটবে, কবে তারা দেশে ফিরতে পারবেন এ নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে গ্রেপ্তারকৃতদের স্বজনদের মাঝেও।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ইনকিলাবকে বলেন, অবাক করা বিষয় যে দুই সরকারই পারস্পরিক বৈঠকে বিষয়টি নিয়ে একাধিকবার আলোচনা করলেও সীমান্তে হত্যার ঘটনা চলছেই। এর মানে, ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনী তার সরকারের কাছ থেকে তেমন কোনো আদেশই পাচ্ছে না। আমার কাছে মনে হচ্ছে, ভারত সরকার সীমান্ত হত্যাকাণ্ডকে কোনোভাবেই গুরুত্ব দেয় না। পাশাপাশি আমরাও বিষয়টি নিয়ে সঠিকভাবে এগোতে পারছি না। ভারত-পাকিস্তান সীমান্তে এরকম হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটলে কী হতো ভাবুন! বাংলাদেশের উচিত এর বিরুদ্ধে শক্ত প্রতিবাদ জানানো এবং হত্যাকাণ্ড বন্ধে কার্যকর উদ্যোগ নেয়া।

মানবাধিকার কর্মী নূর খান ইনকিলাবকে বলেন, ভারত সীমান্ত হত্যা বন্ধ করতে দেয়া প্রতিশ্রুতি রাখেনি। বাংলাদেশের মানবাধিকার সংগঠন, গণমাধ্যম বিভিন্নভাবে সরকারের কাছে বিষয়টি তুলে ধরেছে। দ্বিপাক্ষিক সর্বোচ্চ পর্যায়ের বৈঠকে ভারত বারবার প্রতিশ্রুতি দিয়েও সেটি রাখেনি। তারা (ভারত) বলেছিল, সীমান্তে মারণাস্ত্র ব্যবহার করবে না। কিন্তু আমরা দেখলাম, সেটি মুখের বুলি হলো। এখনও প্রতিনিয়ত সীমান্তে বাংলাদেশি নাগরিক নিহতের ঘটনা ঘটছে। তিনি আরও বলেন, ফালানী হত্যা ঘটনার পরেও বিএসএফ দায়মুক্তির সুযোগ পেয়েছে। বিচার এমনভাবে হয়েছে যে, দায়মুক্তি প্রতিষ্ঠিত করেছে। একদিকে ফালানীর মামলা নষ্ট হয়েছে, আরেকদিকে রিটটিও সুপ্রিম কোর্টে ঝুলে আছে। এধরনের হত্যা বন্ধের জন্য যে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া দরকার, তা নেয়া হচ্ছে না। ভারতের সঙ্গে নেপাল, চীন ও পাকিস্তানের সীমান্ত রয়েছে। ওইসব সীমান্তে মাসের পর মাস, দিনের পর দিন এধরনের হত্যার ঘটনা ঘটে না উল্লেখ করেন নূর খান।

সীমান্ত এলাকার স্থানীয়রা বলছেন, সীমান্ত এলাকায় প্রায়ই চোরাকারবারীরা সকলকে গোপনে ম্যানেজ করে অবৈধভাবে আসা-যাওয়া করে। তবে মাঝে-মধ্যে যখন সীমান্তে কড়াকড়ি আরোপ থাকে তখন কাউকে দেখা মাত্রই গুলি ছোড়ে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ। অনেক সময় গুলি করে মানুষ হত্যা করে লাশও নিয়ে যায় তারা। তবে প্রতিটি সীমান্ত এলাকাতেই রয়েছে কিছু দালালচক্র। তাদের নিয়ন্ত্রণে সীমান্তে চলে সকল অপকর্ম। ২০২০ সালের ২৩ জানুয়ারি নওগাঁর পোরশা সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে তিন বাংলাদেশি গরু ব্যবসায়ী নিহত হন। এর আগের দিন লালমনিরহাটের হাতীবান্ধা সীমান্তে দুইজন ও ৮ জানুয়ারি চাঁপাইনবাবগঞ্জের ওয়াহেদপুর সীমান্তে দুই যুবক বিএসএফ এর গুলিতে নিহত হয়।

২০১৫-২৩ সাল পর্যন্ত ৯ বছরে আসকের হিসাবে ২৪৫ জন বাংলাদেশি বিএসএফের হাতে প্রাণ হারিয়েছেন। এর মধ্যে ২০১৫ সালে ৪৬ জন, ২০১৬ সালে ২৫ জন, ২০১৭ সালে ২৪ জন, ২০১৮ সালে ১৪ জন, ২০১৯ সালে ৪৩ জন, ২০২০ সালে ৪৯ জন, ২০২১ সালে ১৭ জন, ২০২২ সালে ২৩ জন এবং ২০২৩ সালে ৩০ জন। আর সর্বশেষ চলতি বছরে প্রথম সীমান্ত হত্যার শিকার হলেন বাংলাদেশি সীমান্তরক্ষী বাহিনীরই একজন সদস্য।

https://dailyinqilab.com/national/article/638569