১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, বুধবার, ৭:২৬

ডলারের বিনিময় হার বাজারভিত্তিক করা দরকার

-এম এ খালেক

বর্তমানে দেশের অর্থনীতিতে বেশ কিছু জটিল সমস্যা জেঁকে বসেছে। এই সমস্যাগুলো একদিনে বা হঠাৎ করেই সৃষ্টি হয়নি। অনেক দিন ধরে তিলে তিলে এই সমস্যাগুলো সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু যথাযথ কর্তৃপক্ষ সময় মতো উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ না করায় সমস্যাগুলো এখন কার্যত নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবার উপক্রম হয়েছে। অর্থনীতির বিকাশের জন্য এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিয়েছে অস্বাভাবিক উচ্চ মাত্রার মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে এনে সাধারণ মানুষের জন্য একটি সহনীয় পরিবেশ তৈরি করা। দ্বিতীয়ত, বৈদেশিক মুদ্রা, বিশেষ করে মার্কিন ডলারের যোগান বাড়ানোর ব্যবস্থা করা। বর্তমানে বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ যে উচ্চতায় আছে তা যেকোনো সময় বিপদের কারণ হতে পারে। তাই এই মুহূর্তে মার্কিন ডলারের যোগান বাড়ানোর মাধ্যমে রিজার্ভের স্ফীতি উচ্চতর মাত্রায় নিয়ে যাওয়াটা একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দেখা দিয়েছে।

কয়েক বছর আগে বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের পরিমাণ এক পর্যায়ে ৪৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে উন্নীত হয়েছিল। তখন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এ নিয়ে তৃপ্তির ঢেকুর তুলেছিলেন। কারণ সেই সময় আমাদের বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের পরিমাণ ছিল সার্ক দেশগুলোর মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। একমাত্র ভারতের রিজার্ভ বাংলাদেশের চেয়ে বেশি ছিল। যদিও ভারতের রিজার্ভের পরিমাণ বাংলাদেশের তুলনায় অনেক বেশি ছিল। সেই সময় বাংলাদেশ ব্যাংক বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ থেকে রপ্তানি উন্নয়ন তহবিলসহ আরো কয়েকটি ফান্ডে রিজার্ভ থেকে অর্থেও যোগান দিয়েছিল। সেই সময় অর্থনীতিবিদদের কেউ কেউ উচ্চ রিজার্ভ সংরক্ষণের ক্ষেত্রে সতর্ক হবার জন্য পরামর্শ দিলেও তা গ্রহ্য করা হয়নি। ঠিক একই রকম ঘটনা ঘটেছিল প্রবাসী বাংলাদেশীদের প্রেরিত রেমিটেন্সের ক্ষেত্রে। বাংলাদেশ ব্যাংক প্রবাসী আয়ের উপর আড়াই শতাংশ নগদ আর্থিক প্রণোদনা দেবার পর কিছুদিন রেমিটেন্স আহরণের বেশ কিছুটা বৃদ্ধি পায়। তখন একটি বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের একজন গবেষক বলেছিলেন, রেমিটেন্স বৃদ্ধির এই ‘মধুচন্দ্রিমা’ বেশে দিন স্থায়ী হবে না। তখন তৎকালীন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মোস্তাফা কামাল সেই গবেষককে নানাভাবে সমালোচনা করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, সরকারের সাফল্য কিছু লোকের জন্য গাত্রদাহের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সাবেক অর্থমন্ত্রী তখন গবেষকের নিকট জানতে চাননি কেনো রেমিটেন্স প্রবাহের গতি রুদ্ধ হবে? বরং তিনি আত্মপ্রসাদ লাভ করেছিলেন। ভাবখানা ছিল এই রকম যে, রেমিটেন্স প্রবাহ আর কখনোই কমবে না। রেমিটেন্স প্রবাহের গতি কমে যাওয়া এবং রপ্তানি আয় ঠিক মতো দেশে না আসার কারণেই মূলত বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের এই দুরবস্থা সৃষ্টি হয়েছে।

বর্তমানে বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি প্রধান বিবেচ্য বিষয় হচ্ছে কী করে মার্কিন ডলারের বিনিময় হার স্থিতিশীল রাখা যায়। এজন্য নানাভাবে চেষ্টা চালানো হচ্ছে ঠিকই কিন্তু সাফল্য আসছে না কোনোক্রমেই। চলতি অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধের জন্য যে মুদ্রানীতি ঘোষণা করা হয়েছে সেখানেও বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার স্থিতিশীল রাখা এবং রিজার্ভ বাড়ানোর উপর বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। বর্তমানে বাজারে মার্কিন ডলারের একাধিক বিনিময় হার চালু আছে, যা মোটেও কাম্য ছিল না। বাংলাদেশ ব্যাংক অনেক দিন ধরেই কৃত্রিমভাবে মার্কিন ডলারের বিনিময় হার নিয়ন্ত্রণ করে এসেছিল। বাজারে মার্কিন ডলারের চাহিদা বেড়ে গেলে বাংলাদেশ ব্যাংক রিজার্ভ থেকে কিছু ডলার বাজারে ছেড়ে দিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করতো। আবার কোনো কারণে বাজারে মার্কিন ডলারের উপস্থিতি বেড়ে গেলে বাংলাদেশ ব্যাংক বাজার থেকে মার্কিন ডলার কিনে নিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেবার চেষ্টা করছিল। কিন্তু কোনো ক্ষেত্রেই কৃত্রিমতা ভালো নয়। বাজারকে বাজারের মতোই চলতে দেয়া উচিৎ। মুক্তবাজার অর্থনীতিতে সরকার বা অন্য কোনো কর্তৃপক্ষ বাজারের উপর সরাসরি বা পরোক্ষভাবে কোনো নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে পারে না। শুধু অস্বাভাবিক কোনো পরিস্থিতির সৃষ্টি হলেই সরকার বাজারের উপর হস্তক্ষেপ করতে পারে। কিন্তু শুরু থেকেই বাংলাদেশ ব্যাংক মার্কিন ডলারের বিনিময় হার পরোক্ষভাবে হলেও নিয়ন্ত্রণ করে আসছিল।

অর্থনীতিবিদ ও বাজার সংশ্লিষ্টগণ বারবার বলে আসছেন, মার্কিন ডলারের বিনিময় হারকে বাজারের উপর ছেড়ে দেবার জন্য। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক এখনো সেই পথে গমন করেনি। বাংলাদেশ ব্যাংক নানাভাবে স্থানীয় মুদ্রা টাকাকে অতিমূল্যায়িত করে রেখেছে। জাতিসঙ্ঘ সম্প্রতি প্রকাশিত তাদের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে, বাংলাদেশের স্থানীয় মুদ্রা টাকা অতিমূল্যায়িত করে রাখা হয়েছে। সংস্থাটি ১০ বছরের পরিসংখ্যান উল্লেখ করে বলেছে, বাংলাদেশ তার স্থানীয় মুদ্রাকে অতিমূল্যায়িত করে রেখেছে। এরমধ্যে স্থানীয় মুদ্রা টাকা সবচেয়ে বেশি অতিমূল্যায়িত হয়েছিল ২০২০ সালে। সেই বছর টাকার বিনিময় হার প্রকৃত মূল্যের চেয়ে ১৫৫ শতাংশ বেশি ছিল। অর্থাৎ যেখানে টাকার মূল্য হওয়া উচিৎ ছিল এক শত টাকা সেখানে তা দেখানো হয়েছিল ১৫৫ টাকা। ২০২৩ সালে টাকা অতিমূল্যায়িত ছিল ১২৬ শতাংশ। টাকার বিনিময় হার অতিমূল্যায়িত করে রাখার ফলে স্থানীয় মুদ্রার প্রকৃত বিনিময় হার অনুধাবন করা কঠিন ছিল। মার্কিন ডলারের বিপরীতে স্থানীয় মুদ্রা টাকার অতিমূল্যায়ন বা অবমূল্যায়ন কোনোটিই কাম্য নয়। বরং মার্কিন ডলারের বিপরীতে টাকার বিনিময় হার কত হওয়া উচিৎ সেটা বাজারই নির্ধারণ করবে এমন একটি ব্যবস্থা রাখা উচিৎ ছিল।

সর্বশেষ মুদ্রানীতিতে মার্কিন ডলারের বিপরীতে স্থানীয় মুদ্রা টাকার বিনিময় হার নির্ধারণের ক্ষেত্রে ‘ক্রলিং পেগ’ নামে এক নতুন পদ্ধতি প্রয়োগের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ‘ক্রলিং পেগ’ পদ্ধতি বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে সম্পূর্ণ নতুন একটি ধারণা। যদিও পৃথিবীর কোনো কোনো দেশে এই পদ্ধতি চালু আছে। এবং তারা বেশ সফলতার সঙ্গে এই পদ্ধতি প্রয়োগ করতে সমর্থ হয়েছে বলে দাবি করা হয়। অনেকেই মনে করছেন, ‘ক্রলিং পেগ’ পদ্ধতির মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংক আসলে মুদ্রার বিনিময় হার বাজারের উপর ছেড়ে দেবার পথে একধাপ এগিয়ে যেতে চাচ্ছে। ‘ক্রলিং পেগ’ পদ্ধতি হচ্ছে এই রকম-এই ব্যবস্থায় মার্কিন ডলারের বিপরীতে স্থানীয় মুদ্রা টাকার বিনিময় হার নির্ধারণের ক্ষেত্রে একটি করিডোর সৃষ্টি করা হবে। সেই করিডোরের ভিতরে থেকে ব্যাংক ও মানি চেঞ্জার কোম্পানিগুলোকে মার্কিন ডলারের বিনিময় হার নির্ধারণ করতে হবে। যেমন, বাংলাদেশ ব্যাংক নির্ধারণ করে দিলো প্রতি মার্কিন ডলারের বিনিময় হার হবে ১১২ টাকা থেকে ১১৫ টাকা। ব্যাংকগুলো তাদের সুবিধা মতো ১১২ টাকা থেকে ১১৫ টাকার মধ্যে প্রতি মার্কিন ডলারের বিনিময় হার নির্ধারণ করতে পারবে। ব্যাংকগুলো মার্কিন ডলারের বিনিময় হার নির্ধারণের ক্ষেত্রে এর বাইরে যেতে পারবে না। প্রশিক্ষিত ‘উদ বিড়ালের গলায় রশি বেঁধে যেমন নদীতে মাছ ধরার জন্য যখন ছেড়ে দেয়া হয় সেই অবস্থায় উদ বিড়ালের পক্ষে মালিকের হাত থেকে ছুটে যাবার কোনো সুযোগ থাকে না। ‘ক্রলিং পেগ’ ব্যবস্থা ঠিক তেমনি। বাংলাদেশ ব্যাংক সিডিউল ব্যাংকের জন্য মার্কিন ডলারের বিনিময় হার প্রত্যক্ষভাবে নির্ধারণ করে দেব না। তার মানে এই নয় যে, ব্যাংকগুলো চাইলেও যেনোতেনোভাবে মার্কিন ডলারের বিনিময় হার নির্ধারণ করতে পারবে। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক যত চেষ্টাই করুক না কেনো বিদ্যমান অবস্থায় মার্কিন ডলারের বিনিময় হার বাজার ভিত্তিক না করলে কোনোভাবেই বাজারে মার্কিন ডলারের মূল্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে স্থিতিশীলতা সৃষ্টি করতে পারবে না।

বাংলাদেশ ব্যাংক মার্কিন ডলারের বিনিময় হার বাজার ভিত্তিক করতে চাচ্ছে না মূলত কয়েকটি কারণে। এরমধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কারণ হচ্ছে আমদানি পণ্যের মূল্য ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাবার আশঙ্কা। বাংলাদেশ ব্যাংক যদি এই মুহূর্তে মার্কিন ডলারের বিনিময় হার বাজার ভিত্তিক করে তাহলে মার্কিন ডলারের বিপরীতে স্থানীয় মুদ্রা টাকা যে অতিমূল্যায়িত হয়ে আছে তা কমে আসবে। বৈধ চ্যানেলে বর্তমানে প্রতি মার্কিন ডলার যে মূল্যে বিক্রি হচ্ছে মার্কিন ডলারের মূল্য বা বিনিময় হার তার চেয়ে অন্তত ১২ থেকে ১৪ টাকা বৃদ্ধি পাবে। মার্কিন ডলারের বিনিময় হার বাজার ভিত্তিক করা হলেও আমদানি ব্যয় অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পাবে এই ধারণা সর্বাংশে সত্যি নয়। কারণ বর্তমানে আমদানিকারকদের অনেকেই ব্যাংকিং চ্যানেল থেকে চাহিদা মতো মার্কিন ডলার ক্রয় করতে না পেরে কার্ব মার্কেট থেকে উচ্চ মূল্যে মার্কিন ডলার সংগ্রহ করে তাদের চাহিদা পূরণ করছেন। কাজেই মার্কিন ডলারের বিনিময় হার বাজার ভিত্তিক করা হলেই যে বাজারে পণ্য মূল্য অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পাবে তা নাও হতে পারে। প্রশ্ন উঠতে পারে, যদি মার্কিন ডলারের উচ্চ বিনিময় হারের কারণেই স্থানীয় বাজারে পণ্যমূল্য বৃদ্ধি পায় তাহলে স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত পণ্যের মূল্য কোনো বৃদ্ধি পাচ্ছে? স্থানীয় বাজারে বিভিন্ন পণ্যের মূল্য অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পাবার পেছনে আমদানি ব্যয় বৃদ্ধিই একমাত্র কারণ নয়। এ জন্য বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকারের ব্যর্থতাই বেশি দায়ি। বাংলাদেশের মানুষ প্রতিবছর যে পরিমাণ পণ্য ভোগ করে তার মাত্র ২৫ শতাংশ বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। অবশিষ্ট ৭৫ শতাংশ পণ্য স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত এবং বাজারজাত করা হয়। তাহলে এসব পণ্যের মূল্য যখন-তখন বাড়ে কেনো?

স্থানীয় মুদ্রা টাকার বিপরীতে মার্কিন ডলারের বিনিময় হার কমানোর জন্য সবার আগে প্রয়োজন বাজারে মার্কিন ডলারের যোগান বাড়ানোর ব্যবস্থা করা। বাংলাদেশ ব্যাংক বা সরকার কি চাইলেই বাজারে মার্কিন ডলারের যোগান বাড়াতে পারবে? বাজারে মার্কিন ডলারের যোগান বাড়নোর জন্য স্বল্প এবং দীর্ঘ মেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। এবার আলোচনা করা যেতে পারে কোন্ কোন্ খাত থেকে মার্কিন ডলারের যোগান বাড়ানো যেতে পারে। প্রথমেই আসা যাক রপ্তানি আয়ের প্রসঙ্গে। বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা একক বৃহত্তম খাত হচ্ছে পণ্য রপ্তানি। গত অর্থবছরে বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো ৫০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারেরও বেশি আয় করেছে পণ্য রপ্তানি খাত থেকে। এরমধ্যে তৈরি পোশাক সামগ্রি রপ্তানি করে অর্জিত হয়েছে ৪২ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের মতো। তৈরি পোশাক খাতটি আমদানি নির্ভর বিধায় জাতীয় অর্থনীতিতে এর মূল্য সংযোজনের হার তুলনামূলকভাবে কম। এই খাত থেকে যে অর্থ আয় হয় তার ৩৫ থেকে ৪০ শতাংশই কাঁচামাল, ক্যাপিটাল মেশিনারিজ এবং মধ্যবর্তী পণ্য আমদানিতে পুনরায় বিদেশে চলে যায়। এছাড়া বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্পে যেসব বিদেশি এক্সপার্ট কাজ করেন তারা প্রতি বছর ৬ বিলিয়ন থেকে ৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার নিয়ে যাচ্ছেন বেতনভাতা বাবদ। আমাদের দেশের একশ্রেণির উদ্যোক্তার মনে বদ্ধমূল ধারণার সৃষ্টি হয়েছে যে, স্থানীয় এক্সাপার্ট দিয়ে বিদেশিদের মতো কাজ করানো যাবে না। অথচ বাংলাদেশের প্রকৌশলী এবং অন্যান্য এক্সপার্ট কর্মীরা বিদেশে গিয়ে সুনামের সঙ্গে কাজ করছে। আমাদের দেশের উদ্যোক্তাদের মধ্যে দক্ষ লোকবল তৈরি চেয়ে দক্ষ জনশক্তি আমদানির প্রতি বেশি ঝোঁক লক্ষ্য করা যায়। গত বছর তৈরি পোশাক খাতে ৪২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় হলেও এর মধ্যে খুব বেশি হলে ২৫/২৬ বিলিয়ন ডলার জাতীয় অর্থনীতিতে মূল্য সংযোজন করেছে। স্থানীয়ভাবে প্রশিক্ষিত জনবল তৈরি করা গেলে এবং সম্ভাব্য ক্ষেত্রে কাঁচমাল স্থানীয়ভাবে উৎপাদন করা হলে এই খাতে অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রার প্রায় পুরোটাই জাতীয় অর্থনীতিতে মূল্য সংযোজন করতে পারতো। দীর্ঘ মেয়াদে এই সমস্যা সমাধানের জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করা যেতে পারে।

বাংলাদেশ ব্যাংক অপ্রয়োজনীয় ও বিলাসজাত পণ্য আমদানি নিযন্ত্রণের চেষ্টা করছে। যেহেতু বর্তমানে দেশের অর্থনীতিতে বৈদেশিক মুদ্রার ক্রাইসিস চলছে তাই বাংলাদেশ ব্যাংক বিলাসজাত ১২২ট পণ্যের একটি তালিকা প্রণয়ন করে এসব পণ্য আমদানি নিরুৎসাহিত করা হলো। এর উদ্দেশ্য ছিল লেনদেনের ভারসাম্যকে অনুকূল অবস্থায় নিয়ে আসা। দেখা গেলো আমদানি ব্যয় অনেকটাই কমে এসেছে। যেখানে মাসিক আমদানি ব্যয় ৮৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে চলে গিয়েছিল তা অনেকটাই কমে এসেছে। এসব ব্যবস্থা গ্রহণ করা সত্বেও উচ্চ মূল্যস্ফীতি কিন্তু তেমন একটা নিয়ন্ত্রণে আসেনি। ঢালাওভাবে পণ্য আমদানি কমানোর ফল উল্টোও হতে পারে। বাংলাদেশ এখনো শিল্পের কাঁচামাল,ক্যাপিটাল মেশিনারিজ আমদানির উপর নির্ভরশীল। এসব পণ্যের আমদানি কমে গেলে উৎপাদন হ্রাস পাবে। এতে কর্মসংস্থানের সুযোগ কমে যাবে। জুলাই-নবেম্বর সময়ে আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ঋণপত্র খোলার হার কমেছে ভোগ্যপণ্যে ২৭ দশমিক ৪৭ শতাংশ, মূলধনী যন্ত্রপাতিতে ১৬ দশমিক ৯৮ শতাংশ, কাঁচামাল ১১ দশমিক ৬২ শতাংশ। জ¦ালানি ১৬ দশমিক ৭৫ শতাংশ। আমাদের রপ্তানি বাণিজ্যকে পরিকল্পিতভাবে ঢেলে সাজানো দরকার। যাতে এই খাতের সম্ভাবনাকে পরিপূর্ণভাবে কাজে লাগানো যায়।

বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের সবচেয়ে সম্ভাবনাময় খাত হচ্ছে জনশক্তি রপ্তানি খাত। এই খাতে যে অর্থ আয় হয় তার প্রায় শতভাগই জাতীয় অর্থনীতিতে মূল্য সংযোজন করে। এছাড়া প্রায় দেড় কোটি মানুষের বিদেশে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করেছে এই খাত। কিন্তু এই খাতটি সম্পূর্ণ অপরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠছে। গত বছর ১৩ লাখ বাংলাদেশি বিদেশে গমন করেছে কর্মসংস্থান উপলক্ষে। কিন্তু গত বছর বাংলাদেশ জনশক্তি রপ্তানি খাতে আয় করেছে ২৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। তাহলে বাংলাদেশিরা কি পর্যাপ্ত পরিমাণে অর্থ দেশে প্রেরণ করেনি? তারা অবশ্যই দেশে অর্থ প্রেরণ করেছে। কিন্তু তা বৈধ চ্যানেলের পরিবর্তে হুন্ডির মাধ্যমে পাঠিয়েছে। ব্যাংকিং চ্যানেলের তুলনায় হুন্ডির মাধ্যমে অর্থ দেশে প্রেরণ করা হলে প্রতি মার্কিন ডলারে গড়ে ১২ /১৪ টাকা বেশি পাওয়া যায়। মুখের কথায় এই সমস্যার সমাধান হবে না। এ জন্য মার্কিন ডলারের বিনিময় হার বাজারের উপর ছেড়ে দেবার পাশাপাশি প্রবাসী আয়ের উপর দেয়া নগদ আর্থিক প্রণোদনা বহাল রাখা যেতে পারে। তাহলে প্রবাসী বাংলাদেশিরা বৈধ চ্যানেলে অর্থ দেশে প্রেরণে আগ্রহী হয়ে উঠতে পারে।

বাংলাদেশ থেকে চিকিৎসার জন্য অনেকেই ভারত অথবা অন্যান্য দূরবর্তী কোনো দেশে গমন করে থাকে। বাংলাদেশের চিকিৎসকদের দক্ষতা যে খুব একটা খারাপ তা নয়। কিন্তু তাদের ব্যবহার অনেক ক্ষেত্রেই প্রত্যাশিত মাত্রায় ভালো হয় না। তারা অতিমাত্রায় কমার্শিয়াল আচরণ করে থাকেন রোগির সঙ্গে। ফলে রোগিরা এসব চিকিৎসকের নিকট চিকিৎসার জন্য যেতে অনাগ্রহী হয়ে পড়েন। যারা রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বিভিন্ন হাসপাতাল বা চিকিৎসা কেন্দ্রে চাকরি করেন তাদের প্রাইভেট প্রেক্টিস সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করে দেয়া যেতে পারে। তারা হয় রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন হাসপাতালে চাকরি করবেন না হয় প্রাইভেট প্রেক্টিস করবেন। একই সঙ্গে গাছের আগারটা খাবো নিচেরটাও কুড়াবো এটা চলতে দেয়া যায় না।

বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের আরো যেসব খাত আছে তার পূর্ণ ব্যবহার করতে হবে। এ জন্য দীর্ঘ মেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে।

https://www.dailysangram.info/post/548798