১৫ মে ২০১৭, সোমবার, ৮:২২

জিডিপির প্রবৃদ্ধি নিয়ে বিতর্কের শেষ কোথায়!

অর্থনীতির সুফল আর কুফল নিয়ে কোন তর্ক না থাকলেও বিতর্ক চলছে মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি নিয়ে। বিতর্ক চলছে এই প্রবৃদ্ধির আকার বা অঙ্ক নিয়েও। জিডিপি নিয়ে এই বিতর্ক নতুন নয়। গত কয়েক বছর ধরেই এই বিতর্ক চলছে। প্রতি বছরই কিছুটা হলেও প্রবৃদ্ধি ঘটছে। কিন্তু এতে জনগণ কোন সুফল পাচ্ছে না। সরকার বলছে প্রবৃদ্ধি হবে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি। আর বিশ^ ব্যাংকসহ উন্নয়ন সহযোগী বা দাতাগোষ্ঠীরা সরকারের বক্তব্যের সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করছে। তাহলে কার বক্তব্য সত্য। আর এতে জনগণের কি লাভ রয়েছে।
দাতারা বলছে, চলতি ২০১৬-১৭ অর্থবছরে বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি ৬ দশমিক ৮ থেকে ৬ দশমিক ৯ শতাংশ হবে। এবারের অর্থবছরের বাজেটে জিডিপির এই প্রবৃদ্ধির হার ধরা হয়েছে ৭ দশমিক ২ শতাংশ। গত দশ মাসে প্রক্কলনে বাংলাদেশ পরিসংখ্যার ব্যুারো (বিবিএস) বলছে চূড়ান্ত হিসাবে তা হবে ৭ দশমিক ২৪ শতাংশ। কিন্তু অর্থমন্ত্রী এখন বলছেন, প্রবৃদ্ধি আরও বেশি হবে। সাড়ে ৭ দশমিক শতাংশ হবে বলে আশাবাদী অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। তবে অর্থনীতিবিদেরা অর্থমন্ত্রীর এই আশাবাদের পেছনে কোনো বাড়তি কিছু দেখছেন না। কারণ ভরসার সূচকগুলো নিম্নমুখী।
উল্লেখ্য, প্রায় এক দশক প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশের বৃত্তে বন্দী থাকার পর ২০১৫-১৬ অর্থবছরে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিও ৭ শতাংশের ‘ঘর’ থেকে বেরিয়ে আসতে পারে। চূড়ান্ত হিসাবে সেটি হয় ৭ দশমিক ১১ শতাংশ।
এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) বলছে, ২০১৬-১৭ অর্থবছর বাংলাদেশে জিডিপি প্রবৃদ্ধি সর্বোচ্চ ৬ দশমিক ৮ শতাংশ হবে। সরকারের ৭ দশমিক ২ লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হবে না বলে জানিয়েছে আন্তর্জাতিক এই সংস্থাটি। কারণ, প্রবৃদ্ধি অর্জনের যেসব খাতের ওপর নির্ভর করছে, সেগুলোর অবস্থা আশানুরূপ নয়। যেমন রপ্তানি আয় ও প্রবাসী আয় নিম্নমুখী, বেসরকারি বিনিয়োগ ও কৃষিতে প্রবৃদ্ধি কমেছে। আর ২০১৭-১৮ অর্থবছরেও একই প্রবৃদ্ধি অপরিবর্তিত থাকবে। ২০১৫-১৬ অর্থবছর প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৭ দশমিক ১ শতাংশ। অতীতের ও চলতি পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে এই পূর্বাভাস দিয়েছে সংস্থাটি। তবে মধ্য আয়ের দেশ থেকে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হলে উৎপাদনশীলতা ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধি করাই বড় চ্যালেঞ্জ বাংলাদেশের জন্য বলে এডিবি জানায়।
তাদের বিশ্লেষণ, চলতি অর্থবছরে কৃষিক্ষেত্রে জিডিপি প্রবৃদ্ধি কমে দাঁড়াবে ২ দশমিক ৪ শতাংশ। আগামী অর্থবছরে এটি আরও কিছুটা কমে হবে ২ দশমিক ৩ শতাংশ হবে। শিল্প খাতে প্রবৃদ্ধি কমে হবে ১০ দশমিক ৬ শতাংশ। তবে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে কিছুটা বেড়ে হবে ১০ দশমিক ৭ শতাংশ। কৃষির প্রবৃদ্ধি ওইভাবে কমেনি। কিন্তু জিডিপিতে অবদান কমেছে। কারণ শিল্পসহ অন্যান্য খাত এগিয়ে গেছে। এটি উন্নয়নশীল অর্থনীতিতে হয়েই থাকে। দেশে রাজনৈতিক অবস্থা স্থিতিশীল রয়েছে। সুতরাং এটা আপাতত প্রবৃদ্ধিতে খুব বেশি চ্যালেঞ্জ মনে হচ্ছে না।
সেবা খাতে ২০১৭ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি হবে ৬ শতাংশ ২০১৮ সালে অপরিবর্তিত থাকবে। আমদানি প্রবৃদ্ধি প্রথম ছয় মাসে ৯ শতাংশ হয়েছে। আগামী অর্থবছর এই প্রবৃদ্ধি ১০ শতাংশে দাঁড়াবে।
এদিকে এডিবির মতো বিশ্বব্যাংকও প্রবৃদ্ধি অর্জনের ব্যাপারে সরকারের প্রত্যাশার সঙ্গে পুরোপুরি একমত নয়। গতকাল বিশ্বব্যাংক তাদের প্রতিবেদনে ৬ দশমিক ৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস দেয়। অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জের কারণে বেসরকারি বিনিয়োগ কমে যাওয়াকে প্রবৃদ্ধি হ্রাসের প্রধান কারণ হিসেবে মনে করছে বিশ্বব্যাংক। তাদের পর্যবেক্ষণ, বেসরকারি বিনিয়োগ কমে যাওয়ায় প্রবৃদ্ধির ধারা অব্যাহত রাখতে সরকারি বিনিয়োগ বাড়ানো হয়েছে। মূলত অবকাঠামো খাত ও সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা বাড়িয়ে সরকার প্রবৃদ্ধির ধারা অব্যাহত রাখার চেষ্টা করছে। বিশ্বব্যাংক বলছে, এ অবস্থায় বেসরকারি ও বিদেশি বিনিয়োগ বাড়াতে হলে নিরাপত্তাব্যবস্থার উন্নতি করতে হবে।
বিশ্বব্যাংকের মুখ্য অর্থনীতিবিদের ব্যাখ্যা হলো, চলতি অর্থবছরে প্রবাসী আয় ও রপ্তানি আয়ের যে প্রবাহ রয়েছে, তাতে ৬ দশমিক ৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করাও সহজ হবে না।
প্রবাসী আয়ের নিম্নপ্রবাহ ও নিম্ন ভোক্তা চাহিদার কারণে আগামী অর্থবছরে (২০১৭-১৮) প্রবৃদ্ধি কিছুটা কমে সাড়ে ৬ শতাংশ হতে পারে। পরের অর্থবছরে তা কিছুটা বেড়ে ৬ দশমিক ৬ শতাংশ হতে পারে। এর পরের অর্থবছরে, অর্থাৎ ২০১৯-২০ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি ৭ শতাংশ স্পর্শ করবে। তবে দক্ষিণ এশিয়ার আটটি দেশের মধ্যে চলতি বছরে ভারত ও ভুটানের পরেই বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি বেশি হবে। সবচেয়ে বেশি ৭ দশমিক ৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হবে ভুটানে। যদিও দেশটির প্রবৃদ্ধি পঞ্জিকাবর্ষ ধরে পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে। চলতি অর্থবছরে (২০১৬-১৭) ভারতের প্রবৃদ্ধি হবে ৭ শতাংশ। নেপাল ও পাকিস্তানের প্রবৃদ্ধি হবে যথাক্রমে ৫ শতাংশ ও ৫ দশমিক ২ শতাংশ। এ ছাড়া শ্রীলঙ্কায় ৪ দশমিক ৮ শতাংশ, মালদ্বীপে সাড়ে ৩ শতাংশ ও আফগানিস্তানে ১ দশমিক ২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হবে।
অর্থমন্ত্রী এই প্রবৃদ্ধির হার সাড়ে ৭ শতাংশ হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন। পাশাপাশি তিনি বেসরকারি বিনিয়োগে স্থবিরতা না কাটা, প্রবাসী আয় কমে যাওয়ার কথাও স্বীকার করেছেন। তবে তিনি এখাতে আয় বাড়াতে রেমিট্যান্সের উপর মাশুল প্রত্যাহারের ঘোষনা দিয়েছেন। তাঁর ভাষায়, জিডিপির ২৬ থেকে ২৯ শতাংশ পর্যন্ত যে বিনিয়োগ হচ্ছে, তা মূলত সরকারি খাতে বিনিয়োগের কারণে। বেসরকারি খাতে তেমন বিনিয়োগ হয়নি। সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগও (এফডিআই) যা ছিল, সেখানেই আছে। তবে বেসরকারি বিনিয়োগে যে স্থবিরতা ছিল, তা এখনো রয়ে গেছে।
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) সম্প্রতি প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশের জিডিপি ও ডিএসই বাজার মূলধনের অনুপাত ১৬ শতাংশের নিচে, এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের বিভিন্ন দেশের মধ্যে যা সবচেয়ে কম। বাংলাদেশের চেয়ে ছোট বা কাছাকাছি অর্থনীতির তুলনায়ও এ অনুপাত অনেক কম। প্রতিবেদনে দেখা যায়, বর্তমানে ডিএসই বাজার মূলধন ৩৫ বিলিয়ন ডলার, যেখানে বাংলাদেশের জিডিপির আকার ২২১ বিলিয়ন ডলার, আনুপাতিক হারে যা ১৫ দশমিক ৯০ শতাংশ। জিডিপির অনুপাতিক হারে বাজার মূলধন হওয়ার কথা ছিল প্রায় ২ হাজার বিলিয়ন ডলার। এতে বলা হয়েছে যদি জিডিপির প্রবৃদ্ধি সঠিকই হয় তাহলে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ আরও বেশি হওয়ার কথা। কিন্তু কি কারনে জিডিপি বেশি হলেও বিনিয়োগ কম তার কোন উত্তর নেই। তাহলে জিডিপির প্রবৃদ্ধি কতটা সঠিক তা দেখা উচিৎ।
প্রতিবেদনে এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের বিভিন্ন দেশের মধ্যে জিডিপি-শেয়ারবাজার মূলধন অনুপাত তুলে ধরা হয়। এতে দেখা যায়, এ অঞ্চলে জিডিপি-শেয়ারবাজার মূলধন অনুপাত সবচেয়ে বেশি হংকংয়ে। দেশটির জিডিপির ১০ গুণের বেশি শেয়ারবাজারের মূলধনের পরিমাণ। বর্তমানে হংকংয়ের জিডিপির আকার প্রায় ৩১০ বিলিয়ন ডলার। আর দেশটির পুঁজিবাজার থেকে বিভিন্ন কোম্পানি মূলধন সংগ্রহ করেছে তিন হাজার ৩০১ বিলিয়ন ডলার। তারপরেও জিডিপির প্রবৃদ্ধি নিয়ে বিতর্ক চলছে ।

http://www.dailysangram.com/post/283746-