১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, মঙ্গলবার, ১১:৫৫

বাণিজ্যে মলিন হাতিরঝিল

ঢাকার প্রাণকেন্দ্র হাতিরঝিল। নির্মল পরিবেশে দু’দণ্ড সময় কাটাতে মানুষ সেখানে ঘুরতে যান। তবে দিন দিন হাতিরঝিলে পদচারণা কমছে মানুষের। হাতিরঝিলের নান্দনিক সৌন্দর্য ও নির্মলতাও কমছে। যত্রতত্র গড়ে উঠছে রেস্তরাঁ, কফিশপ কিংবা নানা কিসিমের দোকানপাট। এসবের বর্জ্য গিয়ে পড়ছে ঝিলে। অস্বচ্ছ দুর্গন্ধযুক্ত পানির কারণেও মানুষ উপভোগ করতে পারছে না মুক্ত বাতাস। দুর্গন্ধ বেশি হলে ওয়াটার বোটের যাত্রীরাও নাক চেপে গন্তব্যে পৌঁছান। ঢাকার কেন্দ্রের ফুসফুস খ্যাত এই উন্মুক্ত স্থানটি এখন ধুঁকছে বাণিজ্যের ঘেরাটোপে।

এক হাজার ৯৭১ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করা হয় হাতিরঝিল প্রকল্প। ঢাকার জন্য প্রকল্পটি সামগ্রিকভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
ঢাকার বৃষ্টির পানি নিষ্কাশনের অন্যতম মাধ্যমও হাতিরঝিল। পরিকল্পনা ছিল স্বচ্ছ জলাধার হবে সেখানে। মাছ চাষের পাশাপাশি থাকবে নগরবাসীর জন্য সাঁতার কাটার ব্যবস্থা। তবে মূল নকশার বাইরে হাতিরঝিলে গড়ে উঠেছে অবৈধ বাণিজ্যিক স্থাপনা। এসব সরানো না গেলে হাতিরঝিল তার বৈচিত্র্য হারাবে বলে মনে করেন পরিবেশবিদরা। সরজমিন দেখা যায়, হাতিরঝিল ঘিরে স্থায়ী ও অস্থায়ী শেডের বড় বড় রেস্তরাঁ গড়ে ওঠেছে। এসব রেস্তরাঁয় থাই, চাইনিজসহ বিভিন্ন খাবার বিক্রি হয়। এই বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলো রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) কাছ থেকে ইজারা নিয়ে ব্যবসা করছে। বিভিন্ন জায়গায় বিশাল ছাউনি নিয়ে গড়ে ওঠা স্থায়ী শেডের রেস্তরাঁগুলো হাতিরঝিলের অনেকটা জায়গা দখল করে আছে। আর যেগুলো অস্থায়ী শেডের তাও ফুটপাথে চেয়ার-টুল বিছিয়ে অনেকটা জায়গা দখল করে আছে। খোলা জায়গায় যারা খাওয়া-দাওয়া করছেন তারা বর্জ্যগুলোও অনেকক্ষেত্রে সড়কে কিংবা ফুটপাথের ওপর ফেলছেন। এসব বর্জ্য গিয়ে পড়ছে ঝিলের পানিতে। ওয়াটার বোট চলার সময় ঢেউয়ের সঙ্গে ভাসতে দেখা যায় ময়লা।

হাতিরঝিলে ঘুরতে আসা একাধিক ব্যক্তি বলছেন, ঢাকার মুক্ত বাতাসের আশায় তারা হাতিরঝিলে আসেন। তবে দিন দিন মুক্ত বাতাসের বিপরীতে দুর্গন্ধযুক্ত পানিতে পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে। এ ছাড়া হাতিরঝিলে গড়ে ওঠা অবৈধ স্থাপনাগুলো সৌন্দর্য নষ্ট করছে। মাঝে মধ্যেই বিকালে হাতিরঝিলে ঘুরতে আসেন আব্দুল্লাহ জুবায়ের। তিনি বলেন, হকার আর ময়লা-আবর্জনার জন্য জায়গাটির সৌন্দর্য নষ্ট হচ্ছে। এসব নিয়মিত তদারকিতে রাখা উচিত। শাকিল আহমেদ বলেন, হাতিরঝিলের পানি খুবই নোংরা। মাঝেমধ্যে বাতাসে দুর্গদ্ধ ভেসে আসে। তখন অস্বস্তি লাগে। বর্ষায় পানি একটু পরিষ্কার দেখা যায়।

বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবী সমিতির (বেলা) নির্বাহী প্রধান পরিবেশবিদ সৈয়দা রেজওয়ানা হাসান বলেন, সবচেয়ে বিষয় হচ্ছে ঢাকার যেকোনো উন্মুক্ত স্থানই আর উন্মুক্ত থাকে না। সেখানে গড়ে তোলা হয় বিভিন্ন বাণিজ্যিক স্থাপনা। হাতিরঝিলেও তা হয়েছে। সেখানে রেস্তরাঁ, কফি হাউজ ও বিভিন্ন টং দোকান গড়ে উঠেছে। পানিতে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। হতিরঝিলে যদি কেউ শুধুমাত্র প্রকৃতিকে উপভোগ করতে যায়; সে কি পারবে নির্মলভাবে প্রকৃতিকে উপভোগ করতে? সরকারের এই বিষয়গুলো দেখা উচিত। তিনি বলেন, আমরা কতো সংগ্রাম করে হাতিরঝিল থেকে বিজিএমইএ ভবন সরিয়েছি। এখন সেই হাতিরঝিলের কিছু অংশ ভরাট করে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের পিলার তৈরি করা হচ্ছে। এগুলো হচ্ছে সরকারের দর্শন। উন্মুক্ত দর্শনীয় স্থানগুলোতে রাজনৈতিক পরিচয়ে সুবিধাভোগীরা মুনাফা করার জন্য বাণিজ্যিক স্থাপনা গড়ে তোলে।

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) আহ্বায়ক ও সহ-সভাপতি স্থপতি ইকবাল হাবিব নকশা করেছিলেন এই হাতিরঝিলের। তিনি বলেন, হাতিরঝিল ঘিরে যত স্থাপনা গড়ে উঠেছে তার সবগুলোই অবৈধ। আমি নিজেই হাতিরঝিলের মূল নকশা তৈরির সঙ্গে জড়িত ছিলাম। নকশায় কোথাও কোনো রকম বাণিজ্যিক স্থাপনার কথা উল্লেখ নেই। শুধুমাত্র প্রাকৃতিক পরিবেশ উপভোগ করার জন্যই হাতিরঝিল তৈরি করা হয়েছে। এখানে কোনো রকম হোটেল, রেস্টুরেন্ট বা বাণিজ্যিক স্থাপনা থাকতে পারবে না। পানি দূষিত হয় এমন কোনো যান্ত্রিক বাহন চলতে পারবে না। অথচ হাতিরঝিল ঘিরে যেসব বাণিজ্য চলছে তার পুরোটাই অনৈতিক। হাতিরঝিল রক্ষায় হাইকোর্টে আমরা মামলা করে জিতেছি। রাজউককে বার বার বলা হয়েছিল যেন এসব অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা হয়। সে সময় তারা আমাদের সহযোগিতা করেনি।

বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস পিস ফর বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট এডভোকেট মঞ্জিল মোরসেদ বলেন, হাতিরঝিল জনগণের সম্পত্তি। অথচ এটিকে ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে ব্যবহার হচ্ছে। ব্যবসায়ীরা যেহেতু প্রভাবশালী তাই রাজউকও ব্যবসায়ীদের পক্ষ নিয়েছে। হাতিরঝিল থেকে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে আপিল করেছে রাজউক। মামলাটি এখন আপিল বিভাগে বিচারাধীন রয়েছে। আমরা এখন আপিল বিভাগের রায়ের জন্য অপেক্ষা করছি। ঢাকার শহরে এত রেস্টুরেন্ট রয়েছে তাও কেন হাতিরঝিলে রেস্টুরেন্ট থাকতে হবে; এমন প্রশ্ন রেখে তিনি বলেন, হাতিরঝিলের রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় সেখানে রেস্টুরেন্ট চোখে পড়ে। অথচ এখানে শুধু প্রাকৃতিক পরিবেশ চোখে পড়ার কথা। হাতিরঝিল যেন শুধু বিনোদনের উদ্দেশ্যেই ব্যবহার করা হয়।

২০২২ সালের ২৪শে মে হাতিরঝিলকে ‘জনগণের সম্পত্তি’ ঘোষণা করে হোটেল ও রেস্টুরেন্টসহ সব ধরনের বাণিজ্যিক স্থাপনা অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেন হাইকোর্ট। রায়ের অনুলিপি পাওয়ার পরবর্তী ৬০ দিনের মধ্যে সব বাণিজ্যিক স্থাপনা উচ্ছেদের নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। ওই রায়ে বলা হয়, সংবিধান, পরিবেশ আইন, পানি আইন এবং তুরাগ নদ রায় মোতাবেক রাজধানী ঢাকার ফুসফুস বেগুনবাড়ী খালসহ হাতিরঝিল এলাকা যা ‘হাতিরঝিল’ নামে পরিচিত পাবলিক ট্রাস্ট প্রপার্টি তথা জনগণের জাতীয় সম্পত্তি।

হাতিরঝিলে ব্যবসায়িক স্থাপনা উচ্ছেদের জারি করা রুলের পূর্ণাঙ্গ রায়ে হাইকোর্ট বলেছেন, হাতিরঝিলে পানি এবং নজরকাড়া সৌন্দর্য অমূল্য সম্পদ। এই অমূল্য সম্পদকে কোনোভাবেই ধ্বংস বা ক্ষতি করা যাবে না। পানির প্রতিটি ফোঁটা অতি মূল্যবান। পানির চেয়ে তথা সুপেয় পানির চেয়ে মূল্যবান আর কোনো সম্পদ পৃথিবীতে নেই। সুতরাং প্রতি ফোঁটা পানির দূষণ প্রতিরোধ একান্ত আবশ্যক।

পরামর্শসমূহের মধ্যে হাতিরঝিল এলাকায় পায়ে চলার রাস্তা, বাইসাইকেল লেন, শারীরিক প্রতিবন্ধীদের জন্য পৃথক লেন তৈরির পাশাপাশি পানির জন্য ক্ষতিকর লেকে এরকম সব যান্ত্রিক যান তথা ওয়াটার ট্যাক্সি সার্ভিস নিষিদ্ধের কথা বলা হয়েছে।

উল্লেখ্য, নড়াই নামে বয়ে চলা নদীর অংশবিশেষ এই হাতিরঝিল। নগরায়নের ফলে নদীটির অস্তিত্ব এখন আর নেই।

https://mzamin.com/news.php?news=97560