১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, মঙ্গলবার, ১১:৪২

পালিয়ে আসা বিজিপি সদস্যরা নিরাপত্তার জন্য হুমকি’

গোলাগুলি কমলেও আতঙ্ক কাটছে না

বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে গোলাগুলির শব্দ কমলেও স্থানীয়দের মধ্যে আতঙ্ক এখনো কাটেনি। গত রোববার সকাল থেকে গতকাল সোমবার সকাল পর্যন্ত ঘুমধুম উখিয়া ও টেকনাফ সীমান্তে গোলাগুলির শব্দ তেমন শোনা যায়নি। তাই সীমান্ত এলাকার বাসিন্দারা নিশ্চিন্তে কাটিয়েছেন গত দু’দিন। ঘুমধুম উখিয়া ও টেকনাফ সীমান্ত এলাকার লোকজন জানিয়েছে গতকাল সকাল পর্যন্ত সীমান্তের ওপারে কোনো গোলাগুলির বিকট শব্দ শোনা যায়নি। সীমান্ত এলাকায় বিজিবির টহল জোরদার রয়েছে। নাফ নদীতেও কোস্টগার্ড এবং বিজিবি টহল জোরদার করেছে।

উখিয়া উপজেলার পালংখালী ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান গফুর উদ্দিন জানিয়েছেন তার ইউনিয়নের সীমান্ত আপাতত শান্ত রয়েছে। সকাল পর্যন্ত কোনো মর্টার শেল কিংবা গোলাগুলির বড় ধরনের শব্দ আসেনি। টেকনাফ উপজেলার হোয়াইকং ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নুর আহমেদ আনোয়ারী জানিয়েছেন তার ইউনিয়নের সীমান্ত এলাকা গতকাল থেকে আজ সকাল পর্যন্ত মোটামুটি শান্ত রয়েছে। তবে মানুষের মধ্যে আতঙ্ক এখনো কাটেনি। এই সীমান্তের ওপারে মিয়ানমারের অনেক ভেতরে সকালে কিছুক্ষণ পরপর গুলির শব্দ শুনেছে। তবে এই গুলির শব্দ তেমন আতঙ্কজনক নয়।

এ দিকে অস্ত্রসহ পালিয়ে আসা মিয়ানমারের ৩৩০ জন বিজিপি ও জান্তা সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মচারীদের মধ্যে সন্ত্রাসী দলের কোনো সদস্য থাকলে তা বাংলাদেশের নিরাপত্তার জন্য বড় হুমকি হবে মনে করছেন স্থানীয়রা। এদের মধ্যে মিয়ানমারের জান্তা বাহিনীর গুপ্তচর থাকতে পারে বলেও আশঙ্কা তাদের। এই জান্তা বাহিনীর নির্মম নির্যাতনের শিকার হয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে ১০ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা। সীমান্ত এলাকা পালংখালী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান গফুর উদ্দিন চৌধুরী বলেন, ২০১৭ সালে রোহিঙ্গা মুসলিম নিধনে যারা অংশ নিয়েছিল পালিয়ে আসাদের মধ্যে তারাও থাকতে পারে এবং রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অস্থিরতা সৃষ্টি কিংবা বাংলাদেশে গুপ্তচরবৃত্তি করছে কি না তা খতিয়ে দেখা দরকার বলে মনে করছেন তিনি। তিনি বলেন, তাদের এখনই ফেরত না পাঠিয়ে এখানে ডিটেনশনে রাখা উচিত। কারণ, এই বাহিনীটা মিয়ানমারে গণহত্যার জন্য দায়ী। রোহিঙ্গা গণহত্যা এবং জাতিগত নিধনে জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া গেলে তাদের বিচারে প্রয়োজনে আন্তর্জাতিক আদালতের সহায়তাও চাইতে পারে বাংলাদেশ। মিয়ানমার-বাংলাদেশ সীমান্তে গোলাগুলি থেকে রক্ষা পেতে এবার বাড়িঘরেই বাংকার তৈরি করে থাকছেন নাইক্ষ্যংছড়ির তুমব্রুবাসী। গত রোববারও মিয়ানমারের এক সৈনিকের লাশ ভেসে এসেছে পালংখালীতে।

আরাকান আর্মির সুদৃঢ় অবস্থান : ঘটনাস্থল বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম ইউনিয়নের তুমব্রু থেকেও আরো পাঁচ কিলোমিটার ভেতরে কাঁটাতারের বেড়াসংলগ্ন মিয়ানমার সীমান্তরক্ষীদের একটি নজরদারি চৌকি। সেখানে একটি টং ঘরের মধ্যে পাঁচজন বসে আছেন। মাঝেমধ্যে নিজেদের মধ্যে কথা বলছেন। যাদের মধ্যে আরাকান আর্মির ইউনিফর্ম পরা একজন আর অন্যরা সাধারণ পোশাকে। তাদের সবাই অস্ত্রধারী। এলাকাবাসী বলছেন, এরা সবাই আরাকান আর্মির সদস্য। সাত দিনেরও বেশি সঙ্ঘাতের পর, এখন রাখাইন রাজ্যটির নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে আরাকান আর্মি। তারাই পাহারা দিচ্ছে সীমান্তে। এপার থেকে তাদের স্পষ্ট দেখা যায়।
ঘুমধুম-তুমব্রু সীমান্তের বিভিন্ন সীমান্ত প্রাচীরে আরাকান আর্মির সদস্যদের সশস্ত্র অবস্থায় পাহারা দিতে দেখা গেছে। সেখানে মিয়ানমারের জান্তা সরকারের সেনাবাহিনীর কোনো উপস্থিতি চোখে পড়েনি। ২৪ ঘণ্টাতে তেমন কোন গোলাগুলির শব্দ শোনা না গেলেও স্থানীয়দের মধ্যে আতঙ্ক এখনো কাটেনি।

তুমব্রুর হেডম্যান পাড়ার সামনে মনিরুল ইসলামের একটি দোকান আছে। মিয়ানমার সীমান্তরক্ষীদের যে ক্যাম্প রয়েছে, ঠিক সেই পাহাড়ের নিচেই তার দোকান। জানালেন গুলি থেকে বাঁচতে রাস্তার নিচের পানি চলাচলের ব্র্যান্ডকে তিনি এখন বাঙ্কার হিসেবে ব্যবহার করছেন। এলাকার অনেক বাড়িতেই এখন এ রকম বাঙ্কারের মতো গর্ত খুঁড়ে নিজেদের নিরাপত্তা নিজেরাই নিশ্চিত করেছেন এলাকাবাসী। খুব প্রয়োজন ছাড়া মিয়ানমার সীমান্ত এলাকায় স্থানীয় বাসিন্দাদের সীমান্তের কাছাকাছি নিজের জমিতেও যাওয়া নিষেধ করেছেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা। ঘুমধুমের ইউপি চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর আজিজ বলেন, পরিস্থিতি অবনতির পর এখন স্বাভাবিকভাবে মানুষের মধ্যে কিছুটা স্বস্তি ফিরেছে। কিন্তু এখনো সীমান্তে বসবাসকারীদের মধ্যে পুরোপুরি আতঙ্ক কাটেনি।

সীমান্ত পরিদর্শনে বিভাগীয় কমিশনার ও ডিআইজি : সীমান্ত পরিস্থিতি বর্তমানে শান্ত এবং উদ্বেগের কোনো কারণ নেই বলে মন্তব্য করেছেন চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার মো: তোফায়েল ইসলাম ও পুলিশের চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি নুরে আলম মিনা। সীমান্ত এলাকা পরিদর্শনকালে দুই কর্মকর্তা এমন মন্তব্য করেন। এ সময় বিভাগীয় কমিশনার বলেন, সীমান্তের চলমান পরিস্থিতিতে ঘুমধুম উচ্চবিদ্যালয়ের এসএসসি পরীক্ষার কেন্দ্রটি পরিবর্তনের জন্য মন্ত্রণালয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। এর প্রেক্ষিতে উত্তর ঘুমধুমের দু’টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এ পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে। এ সংক্রান্ত প্রক্রিয়া প্রায় চূড়ান্ত। পালিয়ে আশ্রয় নেয়া ৩৩০ বিজিপিসহ অন্যান্যদের ফেরত পাঠানোর প্রক্রিয়া সম্পর্কে তোফায়েল বলেন, বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশ মিয়ানমারের মন্ত্রণালয়ের আলোচনা চলছে। ২-৩ দিনের মধ্যে এটা চূড়ান্ত হবে।

পুলিশের চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি নুরে আলম মিনা বলেন, সীমান্ত পরিস্থিতি বিজিবি দেখছেন। আমরা সহযোগিতা করছি। অস্ত্রধারী ২৩ জনকে আটক করে মামলা দিয়েছে। অন্য কোনোভাবে অপরাধী অনুপ্রবেশ হলে তাদের বিরুদ্ধেও আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।
ভেসে আসা লাশে মিলল বুলেট ও ম্যাগজিন : মিয়ানমার থেকে খালের পানিতে বাংলাদেশে ভেসে আসা লাশ থেকে উদ্ধার করা হয়েছে ৯৯টি বুলেট ও ২টি ম্যাগজিন। রোববার বিকেলে উখিয়া থানার পুলিশ উখিয়ার পালংখালী ইউনিয়নের ১ নং ওয়ার্ডের উখিয়ার ঘাট কাস্টমস এলাকার খাল থেকে লাশটি উদ্ধার করা হয়। লাশের সুরতহাল তৈরি করার পর উখিয়া থানার ওসি মো: শামীম হোসেন জানান, বালুখালী কাস্টমস এলাকা থেকে উদ্ধার হওয়া লাশের পরিচয় শনাক্ত করা যায়নি। তিনি আরো জানান, লাশের গায়ে একটি খাকি রঙের হেলমেট পরিহিত ছিল, কোমরে ব্যাল্ড ছিল। এ সময় লাশের শরীরের সাথে বাঁধা একটি ব্যাগ থেকে ৯৯টি বুলেট ও ২টি ম্যাগজিন পাওয়া যায়।

অনুপ্রবেশকারী ২২ রোহিঙ্গার ৩ দিনের রিমান্ড : মিয়ানমারে চলমান সঙ্ঘাতের মধ্যে অস্ত্রসহ বাংলাদেশে অনুপ্রবেশকারী ২২ রোহিঙ্গার তিন দিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। গতকাল সোমবার দুপুরে কক্সবাজারের জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম শ্রীজ্ঞান তঞ্চঙ্গ্যা ২২ জনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। এর আগে উখিয়ার পালংখালী সীমান্ত থেকে অস্ত্রসহ আটকের পর বিজিবির করা মামলায় ২৩ জনের ১০ দিন করে রিমান্ড আবেদন করে পুলিশ। গ্রেফতারের পর কারাগারে থাকা মো: সাদেক নামের এক রোহিঙ্গা অসুস্থ হওয়ায় তার রিমান্ডের অনুমতি প্রদান করেননি বিচারক।

নাফ নদীতে সতর্ক বিজিবি, ১৩৭ জনকে প্রতিহত : সীমান্ত দিয়ে দুষ্কৃতকারী ও রোহিঙ্গা যাতে অনুপ্রবেশ করতে না পারে সেজন্য সর্বোচ্চ পাহারায় রয়েছে বিজিবি। ইতোমধ্যে ১৩৭ জনকে প্রতিহত করা হয়েছে বলে বিজিবি সূত্রে জানা গেছে। গতকাল সোমবার সকালে টেকনাফের দমদমিয়ায় নাফ নদী সীমান্তে স্পিডবোট দিয়ে জালিয়ার দ্বীপসহ নাফ নদীতে টহল বাড়িয়েছে বিজিবি। গত কয়েকদিন ধরে মিয়ানমারের রাখাইনে গোলাগুলি ও সংঘর্ষ বেড়ে যাওয়ার কারণে বাংলাদেশ সীমান্তের নাফ নদী ও স্থলে এ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। বাড়ানো হয়েছে অতিরিক্ত বিজিবি সদস্য। সকাল থেকে অন্তত তিনটি স্পিডবোট নাফ নদীতে টহলে রয়েছে।

মর্টার শেলে হতাহত পরিবারে সহায়তা : সীমান্তে মিয়ানমারের মর্টার শেলে নিহত পরিবারকে এক লাখ এবং আহত পরিবারের মাঝে ৫০ হাজার টাকার আর্থিক সহায়তা প্রদান করেছে বিজিবি। রোববার বিকেলে বিজিবি কক্সবাজার ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে কর্নেল আব্দুল্লাহ আল মাশরুকি বিজিবি মহাপরিচালকের পক্ষে এই আর্থিক সহায়তা প্রদান করেন। রোববার রাতে বিজিবির পক্ষ থেকে দেয়া বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, মিয়ানমারে অভ্যন্তরে চলমান সংঘর্ষের জেরে মিয়ানমার হতে আসা মর্টার শেল ও গ্রেনেড বিস্ফোরণে একজন বাংলাদেশী নাগরিক নিহত এবং কয়েকজন আহত হন। বিজিবি মহাপরিচালকের নির্দেশে রোববার বিকেলে কক্সবাজার ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল আবদুল্লাহ আল মাশরুকী আহত আনোয়ারুলকে দেখতে কক্সবাজার সদর হাসপাতালে যান, উন্নত চিকিৎসার জন্য বিজিবি মহাপরিচালকের পক্ষ থেকে ৫০ হাজার টাকা আর্থিক সহায়তা প্রদান করেন। পরে কক্সবাজার ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম ইউনিয়নের জলপাইতলী এলাকার নিহত হোসনে আরার আহত ২ নাতি-নাতনীকে দেখতে যান, তাদের খোঁজখবর নেন এবং বিজিবি মহাপরিচালকের পক্ষ থেকে এক লাখ টাকা আর্থিক সহায়তা প্রদান করেন।

https://www.dailynayadiganta.com/first-page/813725