১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, সোমবার, ২:৫৭

অনিরাপদ সড়কে অসহায় পথচারী

 

৪ ফেব্রুয়ারি সকাল সাড়ে ১০টা। ঘটনাস্থল সিলেটের জালালাবাদের নতুন বাজার খেয়াঘাট এলাকা। সড়ক দিয়ে কয়েকজন শিক্ষার্থী দলবেঁধে যাচ্ছিল। ওই পথে দূর থেকে একটি ট্রাক আসতে দেখেন স্থানীয় বাসিন্দা তারেক আহমদ মোহন।

শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার কথা ভেবে ট্রাকের গতি কমাতে ইশারা করেন তিনি। গতি তো কমেইনি, উল্টো ট্রাকটি চাপা দেয় তাঁকে। এতে ঘটনাস্থলেই মোহনের মৃত্যু হয়।

৮ ফেব্রুয়ারি বিকেল পৌনে ৪টা।
কুড়িগ্রামের ভূরুঙ্গামারীর সোনাহাট এলাকা। বাড়ি থেকে বের হয়ে সড়ক পার হওয়ার সময় ভটভটি ধাক্কা দেয় ৮০ বছর বয়সী আলহাজ আইজুদ্দিনকে। এতে আইজুদ্দিনের সঙ্গে ভটভটি চালক রুবেল মিয়াও গুরুতর আহত হন। পরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় দুইজনই মারা যান।

শুধু এই তিনজনের মৃত্যুই নয়, দেশে সারা বছরই প্রায় প্রতিদিন সড়ক দুর্ঘটনার শিকার হয়ে প্রাণ হারাচ্ছে পথচারীরা। দুর্ঘটনাগুলোর মধ্যে দুই যানের মুখোমুখি সংঘর্ষ, একটি গাড়িকে পেছন থেকে এসে আরেকটি গাড়ির ধাক্কা দেওয়া, উল্টে খাদে পড়ে যাওয়া, গাড়ির নিয়ন্ত্রণ হারানোর মতো দুর্ঘটনার ঝুঁকি অনেকটা গতানুগতিক পর্যায়ে চলে গেছে।

অন্যদিকে পথচারীরা কোনো ধরনের যান ব্যবহার না করেও সড়ক দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছে, মারা যাচ্ছে। সাম্প্রতিক ঘটনাগুলো বিশ্লেষণ করে পথচারীর মৃত্যুর যে চিত্র পাওয়া গেছে, তা রীতিমতো ভয়ংকর আকার ধারণ করেছে। সড়ক দুর্ঘটনায় বছরে যত মানুষ নিহত হয়, তার চার ভাগের প্রায় এক ভাগই পথচারী।

সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে কাজ করা রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের তথ্য মতে, গেল বছর সারা দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় মোট ছয় হাজার ৫২৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে এক হাজার ৪৫২ জনই পথচারী। অর্থাৎ মোট মৃত্যুর ২২.২৫ শতাংশই পথচারী। তাদের মধ্যে সড়কে হাঁটার সময় নিহত হয়েছে ৬৮২ জন, যা মোট পথচারী মৃত্যুর ৪৬.৯৬ শতাংশ। আর সড়ক পারাপারের সময় মৃত্যু হয়েছে ৭৭০ জনের, যা মোট পথচারী মৃত্যুর ৫৩.০৪ শতাংশ।

দুর্ঘটনাগুলো মোটা দাগে দুই দিক থেকে ভাগ করা যায়। একপক্ষে দুর্ঘটনার জন্য যানবাহন দায়ী, অন্যপক্ষে পথচারী। সংগঠনটির তথ্য বলছে, যানবাহনের বেপরোয়া গতির কারণে ৮২৭টি দুর্ঘটনা ঘটেছে, যা ৫৬.৯৫ শতাংশ। বিপরীতে পথচারীর অসতর্কতার কারণে ৬২৫টি দুর্ঘটনা সংঘটিত হয়েছে, যা ৪৩.০৫ শতাংশ।

সময় ও সড়কের ধরন বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, সবচেয়ে বেশি পথচারীর মৃত্যু হয়েছে আঞ্চলিক মহাসড়কে। আর মৃত্যু বেশি সকালে। গেল এক বছরে জাতীয় মহাসড়কে ২৬.০৩ শতাংশ, আঞ্চলিক সড়কে ৩২.৩০ শতাংশ, গ্রামীণ সড়কে ২৩.৯৬ শতাংশ, শহরের সড়কে ১৭.২৮ শতাংশ এবং অন্যান্য স্থানে ০.৪১ শতাংশ পথচারীর মৃত্যু হয়েছে। দুর্ঘটনায় পথচারী মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে ভোরে ২.৬১ শতাংশ, সকালে ৩৩.২৬ শতাংশ, দুপুরে ১৬.৯৪ শতাংশ, বিকেলে ২৩.৪৮ শতাংশ, সন্ধ্যায় ৯.০৯ শতাংশ এবং রাতে ১৪.৬০ শতাংশ।

জানতে চাইলে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব এ বি এম আমিন উল্লাহ নুরী কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘কোনো এক পক্ষের দোষে দুর্ঘটনা কম হয়। পরিবহন চালক, মালিক, পথচারী এবং সড়কে চলা অন্য যানবাহন; দুর্ঘটনার জন্য সবাই কমবেশি দায়ী। সবাই সচেতন হলে দুর্ঘটনা কমে আসবে। সরকার কাজ করে যাচ্ছে। আমরা বিভিন্ন উদ্যোগ নিচ্ছি। কিন্তু সচেতনতা তৈরি না হলে উদ্যোগ সফল হওয়া কঠিন।’

ঢাকায় সড়কে মোট মৃত্যুর ৪১ শতাংশ পথচারী
২০২৩ সালে রাজধানীতে ২৯৭টি সড়ক দুর্ঘটনায় ২৪৩ জনের মৃত্যু হয়েছে; আহত হয়েছে আরো ৩৩৬ জন। নিহতদের মধ্যে পুরুষের সংখ্যাই বেশি, ৮৩.১৬ শতাংশ। ঢাকায় মোট মৃত্যুর শীর্ষে পথচারী, ৪১.১৪ শতাংশ। যেখানে মোটরসাইকেলচালক ও আরোহী ৩৬.৩৬ শতাংশ এবং বাস, রিকশা, অটোরিকশাসহ অন্যান্য যানবাহনের চালক ও আরোহীর মৃত্যু হয়েছে ২২.৪৮ শতাংশ।

দুর্ঘটনাগুলো রাতে এবং সকালে বেশি ঘটেছে। বাইপাস রোড না থাকার কারণে রাত ১০টা থেকে ভোর পর্যন্ত রাজধানীতে মালবাহী ভারী যানবাহন বেপরোয়া গতিতে চলাচল করে। ফলে রাস্তা পারাপারে পথচারীরা বেশি নিহত হচ্ছে। এ ছাড়া দীর্ঘ সময় যানজটের কারণে যানবাহন চালকদের আচরণে অসহিষ্ণুতা ও ধৈর্যহানি ঘটছে, যা সড়ক দুর্ঘটনার কারণ হিসেবে কাজ করছে বলে বিশ্লেষকরা জানিয়েছেন।

সংশ্লিষ্ট বিশ্লেষকদের মতে, রাজধানীতে যানবাহনের তুলনায় অপ্রতুল সড়ক, একই সড়কে যান্ত্রিক-অযান্ত্রিক, স্বল্প ও দ্রুতগতির যানবাহনের চলাচল, ফুটপাত হকারের দখলে থাকা, ফুট ওভারব্রিজ যথাস্থানে নির্মাণ না হওয়া ও ব্যবহার উপযোগী না থাকা এবং সড়ক ব্যবহারকারীদের মধ্যে অসচেতনতার কারণে অতিমাত্রায় দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি ঘটছে।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক শামছুল হক কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘নগরকেন্দ্রিক সড়কে হাঁটার পথ কমে আসছে। আর এর বাইরের সড়কে হাঁটার পথ নেই বললেই চলে। এতে করে দুর্ঘটনায় পথচারীর মৃত্যু বেড়ে যাচ্ছে। লম্বা পথ হাঁটার মতো আমাদের সংযুক্ত ফুটপাত নেই। গাড়ি থেকে নেমেও সড়কের ওপর দিয়ে হাঁটতে হয়। পথচারীবান্ধব সড়ক গড়া না গেলে দুর্ঘটনা কমবে না।’

দুর্ঘটনায় মোট শিশু মৃত্যুর ৪৭% পথচারী
গত বছর সড়ক দুর্ঘটনায় এক হাজার ১২৮ শিশুর মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে রাস্তা পারাপার ও রাস্তা ধরে হাঁটার সময় যানবাহনের চাপায় বা ধাক্কায় ৫৩২ শিশুর মৃত্যু হয়েছে; যা মোট দুর্ঘটনায় শিশু মৃত্যুর ৪৭.১৬ শতাংশ। মোটরসাইকেলচালক ও আরোহী হিসেবে নিহত শিশুর সংখ্যা ২৬৭ জন। শতকরা হিসেবে ২৩.৬৭ শতাংশ। এ ছাড়া অন্যান্য যানবাহনে যাত্রী ও চালক হিসেবে ৩২৯ শিশুর মৃত্যু হয়েছে; যা মোট দুর্ঘটনায় শিশু মৃত্যুর ২৯.১৬ শতাংশ।

শিশু পথচারীকে চাপা বা ধাক্কা দেওয়ার ঘটনা যানবাহনভিত্তিক বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, পণ্যবাহী যানবাহনের চাপায় ২২৬ শিশু; প্রাইভেট কার, মাইক্রোবাস ও অ্যাম্বুল্যান্সের চাপায় ৪৩ শিশু; তিন চাকার যানের ধাক্কায় ১৩৩ শিশু; মোটরসাইকেলের ধাক্কায় ৮৪ শিশু এবং স্থানীয়ভাবে তৈরি যানবাহনের ধাক্কায় ৪৬ শিশু নিহত হয়েছে।

দুর্ঘটনায় বেশি শিশু মারা গেছে আঞ্চলিক মহাসড়কে ৪১৬ জন। এ ছাড়া জাতীয় মহাসড়কে ৩৩৮ জন, গ্রামীণ সড়কে ৩২৪ জন এবং শহরের সড়কে ৫০ শিশু নিহত হয়েছে।

সড়ক দুর্ঘটনায় শিশু মৃত্যু প্রসঙ্গে রোড সেফটি ফাউন্ডেশন বলছে, দেশের সড়ক ও সড়ক পরিবহন শিশুবান্ধব না হওয়া; সড়ক ব্যবহার সম্পর্কে শিশুদের মধ্যে সচেতনতার অভাব; পরিবার এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সড়ক ব্যবহার সম্পর্কে পরামর্শ ও প্রশিক্ষণ না দেওয়া এবং দুর্ঘটনায় আহত শিশুদের উপযুক্ত চিকিৎসাব্যবস্থার সংকটের কারণে মৃত্যু বাড়ছে।

বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক মো. হাদিউজ্জামান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ঢাকায় আমরা বড় বড় প্রকল্প করছি কিন্তু হাঁটার পথ রাখছি না। উল্টো মেগাপ্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গিয়ে হাঁটার পথ নষ্ট করছি। এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে ও মেট্রো রেল ফুটপাত নষ্ট করার উদাহরণ। হাঁটার পথ তৈরি, মানুষের সচেতনতা বৃদ্ধি ও চালকের মানসিক উন্নতি; এই তিনটি একসঙ্গে হলেই পথচারী মৃত্যু কমবে।’

https://www.kalerkantho.com/online/national/2024/02/12/1362892