১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, সোমবার, ২:৪৯

এবার বিশ্ববিদ্যালয়ের তিন শিক্ষকের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগে তোলপাড়

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বামীকে আটকে রেখে গৃহবধূকে ধর্ষণের ঘটনার রেষ না কাটতেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয়ের তিন শিক্ষকের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগে তোলপাড় সৃষ্টি হয়। এসব ঘটনায় বিশ^বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে লিখিত অভিযোগ দেয়া হয়েছে। অভিযোগের ব্যাপারে তদন্ত কমিটি গঠন করেছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের সুষ্ঠু বিচারের দাবিতে গত কয়েকদিন ধরে শিক্ষার্থীরা আন্দোলন করছেন। এদিকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ^বিদ্যালয়ে ধর্ষণ মামলায় এখন পর্যন্ত দুই জন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিয়েছেন। এ মামলায় ছাত্রলীগ নেতাসহ মোট ছয়জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।

জানা গেছে, প্রাচ্যের অক্সফোর্ডখ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক মো. নুরুল ইসলামের বিরুদ্ধে তারই এক ছাত্রীর করা যৌন নিপীড়নের অভিযোগের সত্যতা পেয়েছে তথ্যানুসন্ধান কমিটি। বিষয়টিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌন নিপীড়ন সেলে পাঠানো হয়েছে। ওই সেলকে তিন মাসের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। গত ২ জানুয়ারি রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম সিন্ডিকেটের সভায় নেয়া সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, অধ্যাপক নুরুল ইসলামকে একাডেমিক ও প্রশাসনিক সব কার্যক্রম থেকে বিরত থাকতে বলা হয়েছে। অন্যদিকে স্নাতকোত্তর পর্বের থিসিস করতে গিয়ে শিক্ষক কর্তৃক যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন বলে অভিযোগ করেছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের এক ছাত্রী। রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক এবং থিসিসের সুপারভাইজার অধ্যাপক ড. মাহবুবুল মতিনের বিরুদ্ধে গত ২৮ জানুয়ারি উপাচার্যের কাছে অভিযোগপত্র দেন ওই ছাত্রী। এনিয়ে উত্তাল ক্যাম্পাস।

এ ঘটনার রেষ না কাটতেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক নাদির জুনায়েদের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানি ও দীর্ঘস্থায়ী মানসিক নিপীড়নের অভিযোগ করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের একই বিভাগের এক ছাত্রী। শনিবার (১০ ফেব্রুয়ারি) গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের ওই ছাত্রী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর মো. মাকসুদুর রহমানের কাছে লিখিত অভিযোগ করেন। প্রেমের প্রস্তাব গ্রহণ না করায় তাকে নানাভাবে হুমকি দেওয়া, সিসিটিভি ক্যামেরার মাধ্যমে তার ওপর নজরদারি করা, সময়ে-অসময়ে ফোন করা, যৌন ইঙ্গিত দেওয়াসহ নানা অভিযোগ আনেন ওই ছাত্রী।

লিখিত অভিযোগে ওই ছাত্রী বলেন, তিনি আমার শারীরিক গঠন নিয়ে অশ্লীল মন্তব্য করতেন এবং যৌন উত্তেজনা প্রকাশ করতেন। একইসঙ্গে তিনি আমাকে যৌন প্রকৃতির ফোনালাপে অংশ নিতে প্ররোচিত করতেন। ওই শিক্ষক অনুষদ বিভাগের অভ্যন্তরীণ প্রশাসনিক বিষয়ে বিভাগের কমিটির সিদ্ধান্ত, পরীক্ষার ফলাফল এমনকি শিক্ষকদের আচরণ সম্পর্কেও তার সঙ্গে কথা বলেছেন বলেও উল্লেখ করেন ওই ছাত্রী। ওই ছাত্রী আরও উল্লেখ করেছেন, তিনি তার রোমান্টিক আলাপ-আলোচনা এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু অধ্যাপক নাদির বিভাগে ব্যাপক ক্ষমতাধর হওয়ায় ভয়ে তিনি পুরোপুরি যোগাযোগ বন্ধ করতে পারেননি। এদিকে, অভিযুক্ত শিক্ষকের বিচার চেয়ে শনিবার সন্ধ্যায় টিএসসি এলাকায় মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সভা করেছে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্র ইউনিয়ন। মানববন্ধনে অধ্যাপক নাদির জুনাইদের বিরুদ্ধে ওঠা যৌন হয়রানির অভিযোগের সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে বিচারের দাবি জানান বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্র ইউনিয়নের নেতারা। এসময় তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌন নিপীড়ন বিরোধী সেল সক্রিয় করার আহ্বান জানান।

এর আগে গত ৭ ফেব্রুয়ারি গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের স্নাতকোত্তরের কয়েকজন শিক্ষার্থী অধ্যাপক নাদির জুনাইদের বিরুদ্ধে ইচ্ছাকৃতভাবে কম নম্বর দেওয়ার অভিযোগ করেন। এসব ঘটনায় প্রশাসনের কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার দাবিতে ক্লাস বর্জনের হুঁশিয়ারি দিয়েছেন বিভাগটির শিক্ষার্থীরা। তবে অধ্যাপক নাদির জুনাইদের দাবি, বিভাগের পরবর্তী চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পাওয়ার আগে ব্যক্তিগত আক্রমণের শিকার হচ্ছেন তিনি। এ বিষয়ে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, গত কয়েকদিন ধরেই শুনে আসছি এ ধরনের অভিযোগ উঠতে পারে, এই সময়ে এটি খুবই অদ্ভুত। যেহেতু বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এখন আমাকে আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু জানায়নি, তাই এ বিষয়ে আমি আর কোনো মন্তব্য করতে চাই না।

দেশের তিনটি সেরা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে এই চার ঘটনা পর পর ঘটেছে। তবে এবারই প্রথম নয়; যৌন হয়রানির মতো ন্যক্কারজনক ঘটনা বার বার কলঙ্কিত করেছে ক্যাম্পাস। ‘বাংলাদেশের উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পুরুষতান্ত্রিক ও লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা প্রতিরোধের কৌশল (স্ট্র্যাটেজিস ফর প্রিভেন্টিং মাসকুলিনিটি অ্যান্ড জেন্ডার বেজ্ড ভায়োলেন্স ইন হায়ার এডুকেশনাল ইনস্টিটিউশন ইন বাংলাদেশ : অ্যা স্টাডি অব রাজশাহী ইউনিভার্সিটি)’ শীর্ষক গবেষণায় বলা হয়, ৫৬ শতাংশ নিপীড়কই ছাত্রীদের সহপাঠী। ২৪ শতাংশ তাদের চেয়ে ছোট বা বড়। ১১ শতাংশ বহিরাগত ও ৯ শতাংশ শিক্ষক। গবেষণায় ১০ শতাংশ ছাত্রী জানান, নির্যাতনের ৩০ শতাংশ বাজে মন্তব্য ও ৬০ শতাংশ সাইবার হয়রানি। নিপীড়নের ঘটনায় মাত্র ১০ শতাংশ ছাত্রী অভিযোগ করেছিলেন। এর মধ্যে ৫ শতাংশ বিভাগের শিক্ষকদের কাছে এবং বাকি ৫ শতাংশ সেলে। ৯২ শতাংশ জানান, ন্যায়বিচার না পাওয়া ও চরিত্র হননের ভয়ে তারা সেলে অভিযোগ করেননি।
এরআগে গত ৩ ফেব্রুয়ারি রাতে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের মীর মশাররফ আবাসিক হলে ‘এ’ ব্লকের ৩১৭ নম্বর কক্ষে স্বামীকে আটকে রেখে স্ত্রীকে কৌশলে বোটানিক্যাল গার্ডেনে নিয়ে ধর্ষণের অভিযোগে গ্রেপ্তার হন- আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের ৪৫তম ব্যাচের শিক্ষার্থী এবং বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক মোস্তাফিজুর রহমান, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী সাব্বির হাসান সাগর, সাগর সিদ্দিক, হাসানুজ্জামান, মুরাদ ও মামুনুর রশীদ মামুন। মামলায় মুরাদকে ভুক্তভোগীর স্বামীকে আটকে মারধরের অভিযোগে আসামী করা হয়েছে। প্রতিবাদে বিক্ষোভে উত্তাল হয়ে ওঠে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস। এরপর আরো দু’জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। এ নিয়ে ছয় আসামীর সবাই ধরা পড়লেন। বুধবার তাদের একজনকে ঢাকা ও একজনকে নওগাঁ থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। এদের মধ্যে মামুনুর রশিদ ওরফে মামুনকে রাজধানীর ফার্মগেট এলাকা থেকে এবং মুরাদ হোসেনকে নওগাঁ থেকে ধরা হয়েছে। দু’জনই বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষার্থী। তাদের বাড়ি নওগাঁর পতœীতলা উপজেলার আমন্ত গ্রামে। এই দু’জনের মধ্যে মুরাদ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সহসম্পাদক। মামুনকে সেই ‘ধর্ষণের ঘটনায়’ মূল পরিকল্পনাকারী বলছে র‌্যাব। জানানো হয়েছে, মুরাদ ছিলেন তার সহায়তাকারী।

https://www.dailysangram.info/post/548679