১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, রবিবার, ৩:২৫

মোড়ে মোড়ে ঝুলছে টু- লেট তবু বাড়ছে বাসা ভাড়া

‘পাঁচ বছর ধরে আছি দুই রুমের এই সেমিপাকা ঘরে। ৮ হাজার টাকার ভাড়া বাড়তে বাড়তে এখন হয়েছে ১২ হাজার টাকা। এর পরও ভাড়া বৃদ্ধির নোটিশ দিয়েছেন বাড়ির মালিক। নতুন বছরে আরও ১ হাজার টাকা ভাড়া বাড়িয়ে দিয়েছেন তিনি। মাত্র পাঁচ বছরের ব্যবধানে প্রায় ৮০ শতাংশ বেড়ে ৮ হাজার টাকার ভাড়া এখন ১৩ হাজার টাকা। বর্ধিত ভাড়া দিতে না পারলে বাসা ছাড়তে হবে– বলে গেছেন মালিক।’ মুহুরীপাড়া মসজিদ কলোনির বাসিন্দা হাফিজুর রহমান বাড়িভাড়া বৃদ্ধি নিয়ে এভাবেই বললেন তাঁর আক্ষেপের কথা।

শুধু হাফিজুর রহমান নন; নতুন বছর শুরু হতে না হতে বাড়িভাড়া বাড়ার এমন বার্তা পাচ্ছেন চট্টগ্রামের লাখো ভাড়াটিয়া। আইনের কোনো তোয়াক্কা না করে ৫০০ থেকে ৩ হাজার টাকা পর্যন্ত ভাড়া বাড়িয়ে দিয়েছেন বাড়ির মালিকরা। অথচ দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, পরিবহন খরচ বৃদ্ধি ও গ্যাস, পানি-বিদ্যুতের দাম বাড়ায় জীবনযাত্রার ব্যয় মেটাতে এমনিতেই হিমশিম খাচ্ছেন সাধারণ মানুষ। আইনের তোয়াক্কা না করে বাড়ির মালিকদের এমন তৎপরতায় জীবন আরও দুর্বিষহ হয়ে উঠছে ভাড়াটিয়াদের। অথচ রাস্তার মোড়ে মোড়ে ঝুলছে টু-লেট, তবুও বাড়ছে বাড়িভাড়া।

তবে ভিন্ন কথা বলছেন বাড়ির মালিকরা। আগ্রাবাদ সিডিএ আবাসিক এলাকার স্থায়ী বাসিন্দা গাজী হাবিবুর রহমান বলেন, ‘বাড়িভাড়া বাড়ানোর পেছনে কারণ আছে অনেক। নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি পাচ্ছে ক্রমাগত। গৃহঋণের সুদ বাড়ছে। রক্ষণাবেক্ষণ খরচও বৃদ্ধি পেয়েছে দ্বিগুণ। আগে যে টাকা দিয়ে দারোয়ান পাওয়া যেত, এখন তার দ্বিগুণ টাকায়ও মিলছে না। এসব বাড়তি খরচ তো বাড়িভাড়া থেকেই সমন্বয় করতে হবে আমাদের।’

বাড়িভাড়া নিয়ে ভাড়াটিয়া ও মালিকপক্ষের এমন পাল্টাপাল্টি যুক্তি থাকলেও নিয়ম মেনে হচ্ছে না কিছুই। তবুও বাড়ির মালিকরা প্রতিবছর বাড়িয়ে দিচ্ছেন ভাড়া। এ ক্ষেত্রে ভাড়াটিয়ার সঙ্গে এ নিয়ে কোনো আলোচনাও করেন না বেশির ভাগ বাড়ির মালিক। অথচ যারা ভাড়া বাড়িতে থাকেন, তাদের আয়ের একটা বড় অংশ চলে যায় বাড়িভাড়ায়। করোনা মহামারির কারণে কিছু বাড়িওয়ালা বছর কয়েক বাড়িভাড়া বাড়াননি। তবে এবার জানুয়ারি শেষ হতে না হতে নোটিশ দিতে শুরু করেছেন বাড়িওয়ালারা।

কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জরিপ অনুযায়ী, চট্টগ্রাম মহানগরীর ৬০ লাখ বাসিন্দার ৯০ শতাংশই ভাড়াটিয়া। সংগঠনের সহসভাপতি এসএম নাজের হোসাইন বলেন, ‘মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়ছে অসহনীয়ভাবে। মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত কেউই এখন ভালো নেই। বাড়িওয়ালারা যদি একটু মানবিক হতেন, তাহলে ভাড়াটিয়ারা একটু স্বস্তি পেতেন। জীবনের সঙ্গে তাল মেলাতে না পারায় এখন অনেকে গ্রামে ফিরে যাচ্ছেন।’

আইন কার্যকর না, কমিশনও হয়নি
বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইনটি ১৯৯১ সালের। ভাড়াটিয়াদের স্বার্থ রক্ষায় অনেক কথাই উল্লেখ আছে এই আইনে। কিন্তু বাস্তবে তার প্রয়োগ নেই। বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইন-১৯৯১-এ বলা আছে, কোনো বাড়ির ভাড়া মানসম্মত ভাড়ার অধিক বৃদ্ধি করা হলে ওই অধিক ভাড়া কোনো চুক্তিতে ভিন্নরূপ কিছু থাকা সত্ত্বেও আদায়যোগ্য হবে না। বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইন ১৯৯১ কার্যকর করতে ২০১০ সালে হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ নামে একটি সংগঠন জনস্বার্থে হাইকোর্টে রিট আবেদন করে। রিট আবেদনটির পরিপ্রেক্ষিতে রুল ও চূড়ান্ত শুনানি শেষে ২০১৫ সালের ১ জুলাই আদালত রায় দেন। এতে বলা হয়, বিদ্যমান আইনটি কার্যকর না হওয়ায় ভাড়াটিয়াদের সুরক্ষা দেওয়া যাচ্ছে না। আইনটি কার্যকরে রাষ্ট্রকে যথাযথ উদ্যোগ নিতে হবে। অন্যথায় সাধারণ মানুষ এ থেকে পরিত্রাণ পাবেন না। রায়ে সারাদেশে এলাকাভেদে সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন বাড়িভাড়া নির্ধারণের জন্য সরকারকে একটি উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন কমিশন গঠনের নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। রায় ঘোষণার ছয় মাসের মধ্যে কমিশন গঠন করতে মন্ত্রিপরিষদ সচিবকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। রিট আবেদনকারী আইনজীবী মনজিল মোরসেদ জানান, রায় দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু রায় লেখার আগেই রায় প্রদানকারী বিচারপতি মারা যান। এ কারণে পরে নতুন করে শুনানির সিদ্ধান্ত হয়।

গৃহকরের কয়েক গুণ ভাড়া আদায়
এলাকাভেদে সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন বাড়িভাড়া নির্ধারণের জন্য সরকারকে একটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন কমিশন গঠনে হাইকোর্টের দেওয়া নির্দেশও মানা হচ্ছে না চট্টগ্রামে। এলাকাভিত্তিক প্রতি বর্গফুটের গৃহকর হিসাব করে এই ভাড়া নির্ধারণ করে দেওয়ার কথা সিটি করপোরেশনের। কিন্তু সেটা মানেনি করপোরেশন। তাই ইচ্ছামতো ভাড়া আদায় করছেন বাড়ির মালিকরা। চট্টগ্রামে বাড়িভাড়া গৃহকরের চেয়ে কয়েক গুণ বেশি। বাড়িভাড়া বিষয়টির ওপর সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই কোথাও।

সরেজমিন চিত্র
চট্টগ্রাম শহরের মোড়ে মোড়ে এখন ঝুলছে ‘টু-লেট’ নোটিশ। কেউ বাড়তি বাড়িভাড়া দিতে না পেরে কেউবা বাড়তি দোকান ভাড়া দিতে না পেরে পাল্টাচ্ছেন ঠিকানা। এজন্য চট্টগ্রামের মোড়ে মোড়ে কেউ বাড়িভাড়া দেওয়ার নোটিশ দিয়েছেন। কেউবা দোকানঘর ভাড়া দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। আগে এমন নোটিশ সংশ্লিষ্ট বাড়ি বা দোকানের ওপর ঝোলানো হতো। কিন্তু গ্রাহক না থাকায় এখন শহরের বিভিন্ন মোড়ে ঝোলানো হচ্ছে।

গ্রিনভিউ আবাসিক এলাকার শতাধিক বাড়ির মধ্যে এখন ৩০ শতাংশই খালি বলে জানিয়েছেন সমিতির নেতারা। শ্যামলী আবাসিক এলাকার প্রবেশমুখেও টু-লেট নোটিশ আছে অন্তত এক ডজন। সিডিএ আবাসিক এলাকার বিভিন্ন লেনে ঝুলতে দেখা গেছে শত শত টু-লেট।

https://samakal.com/whole-country/article/222392