১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, রবিবার, ৩:২০

সড়ক দুর্ঘটনায় হতাহত সরকারি তথ্যে গরমিল

গত ২৮ জানুয়ারি চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের জরুরি বিভাগে সড়ক দুর্ঘটনায় আহত ৩৬ জন চিকিৎসা নেন। তিন দিন আগে এ সংখ্যা ছিল ৩৯। কিন্তু সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) পরিসংখ্যানে ২৮ জানুয়ারি চট্টগ্রাম জেলায় একজন থাকলেও ২৫ জানুয়ারি নেই কোনো আহত। বিআরটিএর পরিসংখ্যান অনুযায়ী, প্রতি মাসে সড়ক দুর্ঘটনায় গড়ে সাতশর কম মানুষ আহত হন। কিন্তু শুধু গত জানুয়ারিতে চমেকের জরুরি বিভাগে সড়ক দুর্ঘটনায় আহত ৭৭১ জন চিকিৎসা নিয়েছেন।

গত ১৬ জানুয়ারি প্রথমবারের মতো প্রকাশিত বিআরটিএর বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৩ সালে ৫ হাজার ৪৯৫ সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ৫ হাজার ২৪ ও আহত হয়েছেন ৭ হাজার ৪৯৫ জন। সড়কে হতাহত নিয়ে বেসরকারি সংগঠনের তথ্যের সঙ্গে বেজায় ফাঁরাক সরকারি পরিসংখ্যানের। যাত্রী কল্যাণ সমিতির হিসাবে, ২০২৩ সালে সড়কে ৬ হাজার ২৬১ দুর্ঘটনায় প্রাণহানি ৭ হাজার ৯০২ এবং আহত ১০ হাজার ৩৭২ জন। অবশ্য এ সংখ্যাকে অতিরঞ্জিত বলেছে বিআরটিএ।

জবাবে যাত্রী কল্যাণ সমিতি ২০২৩ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়ে সাতটি সরকারি হাসপাতালের জরুরি বিভাগে চিকিৎসা নেওয়ার তথ্য সংগ্রহ করে।

গত সোমবার চিঠির মাধ্যমে তা বিআরটিএকে জানিয়েছে।
সমিতির তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়ে ৫৩ হাজার ২০৭ জন ঢাকা, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা ও খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এবং ঢাকার পঙ্গু, নারায়ণগঞ্জের খানপুর ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন।

সবচেয়ে বেশি ১৪ হাজার ৫৩৭ জন চিকিৎসা নিয়েছেন রাজধানীর পঙ্গু হাসপাতালে। তবে তাদের মধ্যে কতজন ভর্তি হয়েছেন, সে হিসাব দেওয়া হয়নি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিয়েছেন ৩ হাজার ৫৬৩ জন।
বিআরটিএর পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত বছরের জুলাই মাসে সড়কে সর্বোচ্চ ৯৩৫ জন আহত হন। কিন্তু ওই মাসে দুর্ঘটনায় আহত ১ হাজার ২৬৪ জন চিকিৎসা নিয়েছেন বলে জানিয়েছে পঙ্গু হাসপাতাল।

দেশে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে সরকারি-বেসরকারি ৯ হাজারের বেশি হাসপাতাল রয়েছে। যাত্রী কল্যাণ সমিতি বড় সাতটি হাসপাতালের তথ্য দিয়েছে। সংগঠনটির চিঠিতে জেলা সদরের ৬৪ হাসপাতালে দিনে গড়ে সড়ক দুর্ঘটনায় আহত ছয়জন চিকিৎসা নেন বলা হয়েছে। এই হিসাবে বছরে ১ লাখ ৪০ হাজার রোগী শুধু জেলা হাসপাতালেই চিকিৎসা নেন। আট বিভাগীয় হাসপাতালে সড়ক দুর্ঘটনায় আহত আরও ১ লাখ ৫ হাজার রোগী চিকিৎসা নেন। উপজেলা পর্যায়ের সরকারি এবং ৮ হাজার বেসরকারি হাসপাতাল হিসাবে ধরলে, বছরে ৩ লাখের বেশি মানুষ সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়ে চিকিৎসা নেন।

যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী সমকালকে বলেছেন, সব হাসপাতালের তথ্য সংগ্রহের সামর্থ্য নেই আমাদের। তাই শুধু সাতটি হাসপাতালের জরুরি বিভাগের তথ্য বিশ্লেষণ করা হয়েছে। জরুরি বিভাগের তথ্য নেওয়ায় একই রোগীর তথ্য দু’বার আসার সুযোগ নেই। উদাহরণ, একজন খুলনা মেডিকেলের জরুরি বিভাগে গেলে চিকিৎসকরা প্রয়োজন হলে তাঁকে ভর্তি করেন। উন্নত চিকিৎসার দরকার পড়লে ঢাকায় পাঠান। ভর্তি দুই হাসপাতালে হলেও ঢাকায় জরুরি বিভাগে ওই রোগীর তথ্য থাকে না। ফলে আহতকে একবারই গণনা করা হয়েছে।

মোজাম্মেল হক বলেছেন, জরুরি বিভাগে আসা সব রোগী গুরুতর আহত থাকেন না। তাদের মধ্যে গড়ে ৫ শতাংশ ভর্তি হন। বাকিরা প্রাথমিক চিকিৎসা নেন। ৩ লাখের ৫ শতাংশকে গুরুতর ধরলে ১৫ হাজার মানুষ দুর্ঘটনায় আহত হন। কিন্তু সরকারি হিসাবে এসেছে মাত্র ৭ হাজার ৪৯৫।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ড. হাদীউজ্জামান সমকালকে বলেছেন, সরকারি হিসাবে প্রাণহানি ৫ হাজার ২৪ জন। দুর্ঘটনায় নিহতের তিন গুণ আহত ধরা হয়। এ তত্ত্বের কারণে আহত ৭ হাজার ৪৯৫ জন গ্রহণযোগ্য নয়।

সাত হাসপাতালের বরাতে যাত্রী কল্যাণ সমিতি যে তথ্য দিয়েছে, তা অগ্রহণযোগ্য বলেছেন বিআরটিএর চেয়ারম্যান নুর মোহাম্মদ মজুমদার। তিনি সমকালকে বলেছেন, প্রকৃত তথ্যের জন্য তিনটি সরকারি সংস্থা একযোগে কাজ করছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকেও যুক্ত করা হচ্ছে। একটি ডেটাবেজ করা হচ্ছে। সরকারের উদ্দেশ্য, হতাহতের প্রকৃত সংখ্যা জেনে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া। হতাহত কম দেখানোর প্রশ্নই আসে না। হাসপাতাল থেকে তথ্য সংগ্রহে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সঙ্গে কাজ করছে বিআরটিএ। সাতটি হাসপাতালে ৫৩ হাজার, না কত রোগী চিকিৎসা নিয়েছেন, তা স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে জানা যাবে।

গত বছরের জানুয়ারি থেকে দুর্ঘটনার পরিসংখ্যান রাখছে বিআরটিএ। সংস্থাটির সহকারী পরিচালকরা দৈনিক জেলা পর্যায় থেকে পাওয়া দুর্ঘটনার তথ্য রাখেন। তা দৈনিক ও মাসিক হিসাবে ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়। বিআরটিএর একাধিক কর্মকর্তা সমকালকে বলেছেন, তারা যে তথ্য দেন, তা পূর্ণাঙ্গ নয়। মাঠ পর্যায়ের সব তথ্য পাওয়া যায় না। সব দুর্ঘটনার খবর পুলিশের কাছেও থাকে না।

পুলিশের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৩ সালে ৫ হাজার ৯৩ দুর্ঘটনায় ৪ হাজার ৪৭৫ জন মারা গেছেন, যা বিআরটিএর তথ্যের চেয়েও কম। নুর মোহাম্মদ মজুমদার বলেছেন, সব দুর্ঘটনার তথ্য একত্রীকরণের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কমপক্ষে যেন একটি সাধারণ ডায়েরি হয়।
সড়ক দুর্ঘটনা ও হতাহতের সংজ্ঞা নিয়ে বিভ্রান্তি রয়েছে বলে মনে বিআরটিএ। সংস্থার এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেছেন, সাইকেল থেকে পড়ে কারও পা মচকালে বা দু-একটা সেলাই লাগলে তা কি দুর্ঘটনায় আহত ধরা হবে? এভাবে হিসাব করলে দেশে প্রতিবছর লাখো মানুষ আহত হন।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবে, বাংলাদেশে বছরে ৩১ হাজার মানুষের মৃত্যু হয় দুর্ঘটনায়; আহত হন ৩ লাখের বেশি। এ সংখ্যাকেও অতিরঞ্জিত বলেছে বিআরটিএ। সংস্থাটিকে প্রতিদিনের তথ্য দেওয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছেন বিআরটিএ চেয়ারম্যান।

সড়ক দুঘর্টনায় হতাহতের প্রকৃত সংখ্যা যেন আসে, সে জন্য গত ২৮ জানুয়ারি সড়ক পরিবহন সচিবের সভাপতিত্বে মন্ত্রণালয়ে সভা হয়। সেখানে একাধিক কর্মকর্তা প্রকৃত তথ্য আসছে না বলে জানান।

দুর্ঘটনায় হতাহত ব্যক্তি ও তাদের পরিবারকে সরকার ক্ষতিপূরণ দিচ্ছে আর্থিক সহায়তা তহবিল থেকে। শিক্ষার্থীদের নজিরবিহীন আন্দোলনে ২০১৮ সালে পাস হওয়া সড়ক পরিবহন আইনের ৫৩(১) ধারা অনুযায়ী এ তহবিল গঠন করা হয়েছে। গত বছর তহবিলে জমা হয়েছে ১৩৭ কোটি ৫০ লাখ ৬৪ হাজার ৬৩৮ টাকা। ১৯৪ জনকে সরকার ক্ষতিপূরণ দিয়েছে ৮ কোটি ৫৬ লাখ টাকা। সড়ক দুর্ঘটনায় কেউ নিহত হলে তাঁর পরিবার অন্যূন ৫ লাখ টাকা, অঙ্গহানি ও পঙ্গুত্বের জন্য ৩ লাখ এবং চিকিৎসার মাধ্যমে স্বাভাবিক জীবনে ফেরার সম্ভাবনা থাকলে ১ লাখ টাকা পর্যন্ত সহায়তা পান তহবিল থেকে।

এ তহবিল পরিচালনা করা ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান নুর মোহাম্মদ মজুমদার বলেছেন, প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি যেন ক্ষতিপূরণ পান, সে জন্য সরকার দুর্ঘটনায় হতাহতের প্রকৃত তথ্য তুলে আনতে আগ্রহী। তদন্তসাপেক্ষে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে। কিন্তু এর জন্য দুর্ঘটনার পর তথ্য লিপিবদ্ধ করা জরুরি। তবে কিছু বেসরকারি সংগঠন অতিরঞ্জিত তথ্য দিয়ে পরিস্থিতি ঘোলাটে করে।

সড়কের নিরাপত্তায় বিশ্বব্যাংকের ঋণে ৪ হাজার ৯৮৮ কোটি টাকার প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে সরকার। এর অগ্রগতি না থাকায় সম্প্রতি অসন্তুোষ প্রকাশ করেছেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। সরকারি সংস্থাগুলো হতাহতের সংখ্যা কম বললেও তিনি বলেছেন, সড়ক দুর্ঘটনা এবং হতাহত নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হচ্ছে না কিছু সমন্বিত পদক্ষেপ ও সচেতনতার অভাবে।

https://samakal.com/bangladesh/article/222403