১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, রবিবার, ৩:১৭

বেপরোয়া কিশোর গ্যাং

তুচ্ছ কারণে একের পর এক খুন

রাজধানীর যাত্রাবাড়ী এলাকার কুতুবখালী উচ্চ বিদ্যালয়ের পাশের গলি। গত বুধবার রাত ৮টার দিকে একদল কিশোর আড্ডা জমিয়েছিল সেখানে। একই সঙ্গে চলছিল মাদক সেবন। সেখান থেকে এক কিশোরকে পাশের গলিতে ডেকে নিয়ে যায় এক তরুণ।

দুজনের মধ্যে বাদানুবাদ চলে। এক পর্যায়ে তা হাতাহাতিতে রূপ নেয়। এ সময় পকেট থেকে চাকু বের করে কিশোরের পেটে আঘাত করে তরুণ। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার পর কর্তব্যরত চিকিৎসক আহত ওই কিশোর মো. জামালকে (১৮) মৃত ঘোষণা করেন।

গতকাল শনিবার সকালে ওই এলাকায় গিয়ে স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে ওই খুনের ঘটনা সম্পর্কে এসব তথ্য জানা যায়।
তাদের তথ্য মতে, এলাকায় কিশোর গ্যাংয়ের দৌরাত্ম্য বেড়েছে। তারা বিভিন্ন দলে বিভক্ত। দলগুলোর মধ্যে রেষারেষি আর মারামারি লেগেই আছে।

তারা তুচ্ছ কারণে একে অপরের ওপর হামলা চালায়। প্রকাশ্যে হৈচৈ করে, বেপরোয়া গতিতে মোটরসাইকেল চালিয়ে ভীতিকর পরিবেশ তৈরি করে। একই সঙ্গে বেশির ভাগ কিশোর গ্যাং মাদক কেনাবেচা ও সেবনে জড়িত।

এলাকার কিশোর গ্যাংয়ের মারামারির বিষয়ে জানতে চাইলে যাত্রাবাড়ী থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মো. আজাহারুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এদের নিয়ে চরম বিপাকে আছি। এরা তুচ্ছ কারণে প্রতিদিনই ঝগড়া-বিবাদে জড়াচ্ছে।

বিশেষ করে এলাকায় প্রভাব বিস্তারের ক্ষেত্রে। এর মধ্যে অনেক কিশোরকে আটক করে অপরাধমূলক কাজে না জড়ানোর মুচলেকা নিয়ে অভিভাবকদের জিম্মায় দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এতেও নিয়ন্ত্রণে আসছে না তারা।’

জামাল হত্যার ঘটনায় প্রাথমিক তদন্তের উদ্ধৃতি দিয়ে পরিদর্শক বলেন, এ ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে চারজনকে আটক করা হয়েছে। তাদের মধ্যে একজন জামালকে ছুরি মেরে হত্যার কথা স্বীকার করেছে। মূলত সিনিয়র-জুনিয়র বিরোধে তাকে হত্যা করা হয়।
এ ঘটনার প্রায় এক মাস আগে গত ৯ জানুয়ারি রাজধানীর হাতিরঝিল থানাধীন মধুবাগ এলাকায় একটি মাঠের পাশে আশিক মিয়া নামের এক কিশোরকে ছুরিকাঘাতে খুন করে সমবয়সী একদল কিশোর।

পুলিশ ও পারিবারিক সূত্র বলছে, এলাকায় ব্যাডমিন্টন খেলাকে কেন্দ্র করে বিরোধের জের ধরে এক দল কিশোর এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে বলে নিহত আশিক মিয়ার পরিবারের অভিযোগ। হত্যাকাণ্ডে এলাকার বখাটে মইনুদ্দিন, তানভির, জাহাঙ্গীর, বেলাল, রাসেলসহ অন্তত ১১ জন জড়িত বলে অভিযোগ উঠেছে। এলাকাবাসীর ভাষ্য, এসব কিশোর-তরুণ সন্ধ্যা থেকে গভীর রাত পর্যন্ত এলাকায় মোটরসাইকেল নিয়ে মহড়া দেয়। তুচ্ছ কারণে এলাকার মানুষকে মারধর করে।

এই দুটি হত্যাকাণ্ডের মধ্যেই গত ২ ফেব্রুয়ারি রাতে পুরান ঢাকার কদমতলীর দনিয়া এলাকায় বন্ধুদের সঙ্গে ঘুরতে গিয়ে নাজমুল সাকিব নিলয় (১৬) নামের এক এসএসসি পরীক্ষার্থীর রহস্যজনক মৃত্যু হয়। পরিবার বলছে, তাকে হত্যা করা হতে পারে।

পুলিশ ও পারিবারিক সূত্র বলছে, ২ ফেব্রুয়ারি রাত সাড়ে ১০টার দিকে অচেতন অবস্থায় তাকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নেওয়া হয়। কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

এভাবে গত এক বছরে ঢাকায় কিশোর অপরাধীদের হাতে অন্তত ২৭ জন খুন হয়েছে। এসব ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে অনেক কিশোর গ্যাং সদস্য আটক হয়েছে।

র‌্যাব সদর দপ্তর সূত্র বলছে, ২০২৩ সালে র‌্যাবের অভিযানে সারা দেশ থেকে কিশোর গ্যাংয়ের বিভিন্ন গ্রুপের ৩৪৯ জন সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়।

আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর তালিকা অনুযায়ী, দেশে অন্তত পাঁচ শতাধিক কিশোর গ্যাং রয়েছে। এর মধ্যে র‌্যাবের তালিকায় রাখা হয়েছে ৮২টি। ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) তালিকা অনুযায়ী, রাজধানীতে ৫২টি কিশোর গ্যাং রয়েছে। ডিএমপির আটটি অপরাধ বিভাগের অধীন ৩৫ থানা এলাকায় এসব চক্রের সদস্য সংখ্যা প্রায় ৬৯২ জন।

গত শুক্রবার মোহাম্মদপুরের হাউজিং সোসাইটিতে অভিযান চালিয়ে কিশোর গ্যাং চক্রের মূল হোতাসহ পাঁচজনকে দেশি-বিদেশি অস্ত্রসহ গ্রেপ্তার করেছে র‌্যাব।

গতকাল শনিবার দুপুরে এ বিষয়ে র‌্যাব-৩ পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল আরিফ মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, রাজধানীর মোহাম্মদপুর ও এর আশপাশের এলাকায় ‘ধাক্কা দে’ ও ‘ডায়মন্ড’ নামের দুটি কিশোর গ্যাংয়ের নানা অপরাধের সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছেন জুলফিকার আলী ও তার সহযোগীরা। কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের পেশায় কেউ রাজমিস্ত্রি, কেউ চা-বিক্রেতা কিংবা প্রাইভেট কার চালক। তারা দৃশ্যমান পেশার আড়ালে মূলত কিশোর গ্যাং পরিচালনা করত।

https://www.kalerkantho.com/online/national/2024/02/11/1362601