১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, রবিবার, ২:৩৩

জ্বালানি তেল আমদানিতে ঋণচাপ বাড়বে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে

-আশরাফুল ইসলাম

জ্বালানি তেল ও তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানিতে ১৬০ কোটি ডলার ঋণ দেয়া হচ্ছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে। এতে কমতির দিকে থাকা দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ আরো চাপের মুখে পড়ে যাবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। তাদের মতে, দেশে এমনিতেই ডলার সঙ্কট। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল আইএমএফের শর্ত মোতাবেক বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ রাখতে পারছে না। প্রতি মাসেই কমে যাচ্ছে। এমনি পরিস্থিতিতে রিজার্ভ থেকে ১৬০ কোটি ডলার খরচ করলে প্রকৃত রিজার্ভ আরো কমে যাবে। এতে আপৎকালীন সঙ্কট মেটানোর জন্য বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ ঝুঁকির মুখে পড়ে যাবে।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. এ বি মির্জ্জা মো: আজিজুল ইসলাম এ বিষয়ে গতকাল নয়া দিগন্তকে জানিয়েছেন, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এমনিতেই কমতির মধ্যে আছে। রফতানি আয় ও রেমিট্যান্স-প্রবাহ তেমন আশাব্যঞ্জক নয়। এমনি অবস্থায় ৫০ কোটি ডলার পাওয়ার জন্য রিজার্ভ থেকে ১৬০ কোটি ডলার ব্যয় করা ঠিক হবে না। এতে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ আরো চাপে পড়ে যাবে বলে তিনি মনে করেন।

প্রসঙ্গত, গেল সপ্তাহে জ্বালানি তেল ও তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানিতে ইসলামিক ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের (আইডিবি) সহযোগী সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক ট্রেড ফাইন্যান্স করপোরেশনের (আইটিএফসি) সাথে ২১০ কোটি ডলারের একটি ঋণচুক্তি করেছে জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগ। ২১০ কোটি ডলার ঋণের মধ্যে ১৬০ কোটি ডলার সরবরাহ করা হবে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে। যা ঋণচুক্তির অর্থের ৭৬ শতাংশ। বাকি ২৪ শতাংশ বা ৫০ কোটি ডলার সরবরাহ করবে আইটিএফসি।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, বৈদেশিক মুদ্রার আন্তঃপ্রবাহের তুলনায় বহিঃপ্রবাহ বেশি। এর অন্যতম কারণ হলো বৈদেশিক মুদ্রার চাহিদা যে পরিমাণ রয়েছে সরবরাহ হচ্ছে তার চেয়ে অনেক কম। রফতানি আয় ও রেমিট্যান্স-প্রবাহের মাধ্যমে যে পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা দেশে আসছে, পণ্য আমদানি ও বৈদেশিক ঋণ পরিশোধে ব্যয় হচ্ছে তার চেয়ে অনেক বেশি। প্রতি মাসেই সরকারি অতি প্রয়োজনীয় পণ্য কেনাকাটার ব্যয় মেটাতে রিজার্ভ থেকে ডলার সরবরাহ করতে হচ্ছে। আর এ কারণে প্রতি মাসেই বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ কমে যাচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, ২০২১ সালের আগস্টে বাংলাদেশ ব্যাংকের গ্রস রিজার্ভ ছিল ৪৮ বিলিয়ন ডলার। এর পর থেকেই গ্রস রিজার্ভ কমতে শুরু করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান মতে, গত ৭ ফেব্রুয়ারি বৈদেশিক মুদ্রার গ্রস রিজার্ভ ২৫ বিলিয়ন ডলারে নেমে গেছে। যেখানে গত বছরের একই সময়ে তা ছিল ৩২.৬২ বিলিয়ন ডলার। তবে নিট রিজার্ভ আরো কম। আইএমএফের কাছ থেকে ঋণ পাওয়ার শর্ত হিসেবে রিজার্ভের হিসাব ব্যবস্থা আন্তর্জাতিক মানে দেখানোর শর্ত দেয়া হয়েছিল। আর চলতি বছরের শুরু থেকে রিজার্ভের আন্তর্জাতিক হিসাব ব্যবস্থা বিপিএম৬ অনুযায়ী করে আসছে বাংলাদেশ ব্যাংক। গত ৭ ফেব্রুয়ারি বিপিএম৬ অনুযায়ী বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে নেমেছে ১৯.৯৫ বিলিয়ন ডলার। তবে আন্তর্জাতিক আইএমএফ হিসাবে নিট রিজার্ভ রয়েছে ১৬ বিলিয়ন ডলারেরও কম। আইএমএফ থেকে ঋণ প্রাপ্তির শর্ত হিসেবে গত ৩১ ডিসেম্বর নিট রিজার্ভ ১৭ দশমিক ৭৮ বিলিয়ন ডলার থাকার কথা ছিল। এ শর্ত পূরণের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাজার থেকে এক বিলিয়নের বেশি ডলার কিনে নিয়েছিল; কিন্তু তারপরও আইএমএফের শর্ত পূরণ করা সম্ভব হয়নি।

বিপিএম৬ মূলনীতি অনুযায়ী, যেকোনো দেশের রিজার্ভের হিসাবায়নের ক্ষেত্রে ঋণ ও বিনিয়োগকে বাদ দেয়া হয়। বাংলাদেশ ব্যাংক এর আগে রিজার্ভের অর্থে রফতানি উন্নয়ন তহবিল (ইডিএফ) গঠন করেছে। কভিড-১৯-এর সময় এ তহবিলের আকার সাত বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করা হয়েছিল। এ ছাড়া রিজার্ভ থেকে গ্রিন ট্রান্সফরমেশন ফান্ডে (জিটিএফ) ২০ কোটি ডলার, লং টার্ম ফাইন্যান্সিং ফ্যাসিলিটি (এলটিএফএফ) তহবিলে তিন কোটি ৮৫ লাখ, সোনালী ব্যাংকের মাধ্যমে পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষকে ৬৪ কোটি, বাংলাদেশ বিমানকে চার কোটি ৮০ লাখ ও শ্রীলঙ্কাকে ২০ কোটি ডলার দেয়া হয়েছিল। বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানান, ইডিএফ তহবিলের আকার এখন ২৯০ কোটি ডলারে নেমে এসেছে। শ্রীলঙ্কাকে দেয়া ২০ কোটি ডলার সমন্বয় হয়েছে। আর অন্যান্য খাতের বিনিয়োগও কিছুটা কমেছে। এ কারণে বাংলাদেশ ব্যাংকের নিজস্ব হিসাবায়ন পদ্ধতি এবং বিপিএম৬-এর মূলনীতির আলোকে রিজার্ভের ব্যবধান কমে এসেছে। এখন সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আইটিএফসিতে বিনিয়োগ বাড়ালে দেশের নিট রিজার্ভ থেকে সেটি বাদ যাবে। এতে নিট রিজার্ভের ওপর চাপ আরো বাড়বে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে (জুলাই-জানুয়ারি) রেমিট্যান্স প্রবাহের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৩ দশমিক ৬ শতাংশ। আর আলোচ্য সময়ে রফতানিতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ২ দশমিক ৫২ শতাংশ। রেমিট্যান্স ও রফতানি আয়ের মাধ্যমে যে পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা এসেছে আমদানি ব্যয় ও বৈদেশিক ঋণের সুদসহ ঋণ পরিশোধে তার চেয়ে বেশি ব্যয় হয়েছে। আর এ কারণে প্রতি মাসেই বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ কমে যাচ্ছে। তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, এখনো যেটুকু রিজার্ভ রয়েছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে আমদানি ব্যয় কমাতে উদ্যোগ না নিলে তাও থাকত না। কারণ প্রতি মাসে আমদানিতে ব্যয় হতো আট বিলিয়ন ডলারের কাছকাছি। সাথে বাকিতে পণ্য আমদানির দায়ও পরিশোধ করতে হতো। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কঠোর তদারকি ও উদ্যোগের কারণে সেই আমদানি ব্যয় ৫ বিলিয়নের ঘরে নেমে গেছে। অর্থাৎ প্রতি মাসেই আমদানিতে গড়ে প্রায় আড়াই বিলিয়ন ডলার কম হচ্ছে। প্রকৃত রিজার্ভ ১৯ বিলিয়ন ডলারের ঘরে নেমে গেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে উদ্যোগ না নিলে গত আট মাসেই তা শেষ হয়ে যেত। আমদানি ব্যয় কমাতে বাংলাদেশ ব্যাংকের উদ্যোগের মধ্যে প্রথমে ৫ মিলিয়ন ডলার পরে ৩ মিলিয়ন ডলার আমদানির ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংক তদারকির আওতায় আনে। অপর দিকে শতভাগ নগদে পণ্য আমদানির নির্দেশ দেয়া হয়। এক সময়ে আমদানির প্রবৃদ্ধি হতো ৫০ শতাংশের ওপরে, এখন তা কমে গত নভেম্বরে তা ঋণাত্মক সাড়ে ২২ শতাংশে নেমে এসেছে।

ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, দীর্ঘ দিন ধরে ডলার সঙ্কটের কারণে ব্যবসায়ীদের চাহিদা অনুযায়ী পণ্য আমদানি করা যাচ্ছে না। কাঁচামালের অভাবে অনেক শিল্প কারখানার উৎপাদন অর্ধেকে নেমে গেছে। আগে ডলার সঙ্কট হলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে সাপোর্ট পাওয়া যেত, এখন শুধু সরকারি বিশেষ প্রয়োজনীয় পণ্য কেনাকাটায় সরকারি ব্যাংকগুলোকে সাপোর্ট দেয়া হচ্ছে। তাও চাহিদার যৎসামান্য। রাষ্ট্রায়ত্ত একটি ব্যাংকের তহবিল ব্যবস্থাপক জানিয়েছেন, ৬০ কোটি ডলার চাহিদার বিপরীতে দেয়া হচ্ছে ২ কোটি থেকে সর্বোচ্চ তিন কোটি ডলার। সরকারি জরুরী পণ্য কেনাকাটায় এলসি খুলা হয়েছে। এখন ডলারের কারণে তা পরিশোধ করতে পারছে না। এতে বিদেশী ব্যাংকগুলোর কাছে জরিমানাও গুনতে হচ্ছে কিছু কিছু ক্ষেত্রে।

এমনি পরিস্থিতিতে রিজার্ভ থেকে জ্বালানি তেল আমদানিতে ঋণ দেয়া হলে প্রকৃত রিজার্ভ আরো কমে যাবে। এতে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী আপদকালীন সংকট মেটাতে যতটুকু বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থাকার কথা তাও থাকবে না।

প্রসঙ্গত, জ্বালানি তেল ও এলএনজি আমদানির জন্য গত সপ্তাহে আইটিএফসির সাথে যে ঋণ চুক্তি করা হয়েছে তার ৭৬ শতাংশই সরবরাহ করতে হবে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে। ২১০ কোটি ডলারের ঋণ চুক্তির মধ্যে ১৬০ কোটি ডলার সরবরাহ করা হবে দেশের রিজার্ভ থেকে আর ৫০ কোটি ডলার সরবরাহ করবে আইটিএফসি। ঋণ চুক্তির শর্ত অনুযায়ী, স্বল্পমেয়াদি এ ঋণের মেয়াদ ছয় মাস। এ ঋণের সুদহার হবে সিকিউরড ওভারনাইট ফাইন্যান্সিং রেটের (এসওএফআর) সঙ্গে ২ শতাংশ হারে। বর্তমানে এসওএফআর রেট ৫ দশমিক ৩১ শতাংশ। যে সময়ে ঋণ নেয়া হবে, তার ছয় মাস পর এটি শোধ করে দিতে হবে। পরে আরো ছয় মাস মেয়াদে এ ঋণ তহবিলের অর্থ জ্বালানি কেনার কাজে ব্যবহার করা যাবে। অর্থনীতিবিদ ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, এটি হলো অনেকটা নিজেদের রিজার্ভ থেকেই নিজেরা ঋণ নেয়া। এ চুক্তির আওতায় অতিরিক্ত হিসাবে আইটিএফসির কাছ থেকে প্রকৃতপক্ষে ঋণ সহায়তা পাওয়া যাবে কেবল ৫০ কোটি ডলার। যেখানে দেশের রিজার্ভ আটকা পড়বে ১৬০ কোটি ডলার। নতুন এ চুক্তির ফলে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার নিট রিজার্ভ আরো চাপে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।

https://www.dailynayadiganta.com/first-page/813218