১০ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, শনিবার, ৪:২৪

দুই বছরে ১৫০০ নারী পাচার

‘প্রায় সাত মাস আগে আমার ভাতিজি ভারতে পাচার হয়। এখনো তাকে দেশে ফিরিয়ে আনা যায়নি। তাকে দেশে ফেরাতে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর দ্বারে দ্বারে ঘুরছি। অপেক্ষায় আছি, কখন মেয়েটি আমাদের কাছে ফেরে!’
গতকাল শুক্রবার এভাবে বলছিলেন পাচার হওয়া ওই তরুণীর চাচা রানা।

শুধু এই তরুণী নন, গত দুই বছরে (২০২২ ও ২০২৩ সাল) দেশ থেকে প্রায় দেড় হাজার নারী ও শিশু পাচার হয়েছে। তাদের বেশির ভাগ এখনো উদ্ধার হয়নি। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র এ তথ্য দিয়েছে।

সর্বশেষ রাজধানীর হাজারীবাগ এলাকা থেকে নিখোঁজ দুই কিশোরী ভারতে পাচার হয়েছে বলে জানা গেছে।
ঘটনার তদন্তে নেমে কবির হোসেন নামের একজনকে গ্রেপ্তার করে ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা শাখা (ডিবি)। তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদে নারী ও শিশু পাচারকারী একটি চক্রের সন্ধান পায় তারা। কবিরের তথ্য অনুযায়ী, চক্রটি ফেসবুকে বিদেশে চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে নারীদের পাচার করে আসছিল।

এ চক্রের বিষয়ে গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ বলেন, ‘সম্প্রতি রাজধানীর হাজারীবাগ এলাকা থেকে দুই কিশোরী নিখোঁজের ঘটনায় একটি মামলা হয়।

তদন্তে নেমে আমরা একটি মানব পাচার চক্রের সন্ধান পাই, যারা ফেসবুকে সহজে টাকা-পয়সা ছাড়াই চাকরি দেওয়ার নামে নারী ও শিশুদের পাচার করে আসছে। এই চক্রের ফাঁদে পা দিয়ে খুলনা থেকে এক নারী তাঁর সন্তানকে নিয়ে সাতক্ষীরার কলারোয়ার সীমান্ত এলাকায় চলে যান। চক্রের সদস্যরা তাদের পাচারের উদ্দেশ্যে নো-ম্যানস ল্যান্ড এলাকায় নিয়ে যায়। সেখান থেকে তাদের উদ্ধার করা হয়। তবে যে মামলার তদন্তে নেমে এই চক্রের সন্ধান পাওয়া গেছে, সেই দুই মেয়েকে আগেই পাচার করা হয়।

ডিবি বলছে, কলারোয়ায় ভারতীয় সীমান্তের জিরো পয়েন্ট লাগোয়া গ্রাম কেরাগাছি এলাকার আব্দুল হামিদের দুই ছেলের নেতৃত্বে চক্রটি দীর্ঘদিন ধরে কম বয়সী নারী ও শিশুদের বিভিন্ন প্রলোভন দেখিয়ে সীমান্ত দিয়ে পাচার করে আসছিল। তাঁর অন্যতম সহযোগী বড় ভাই কবির হোসেন। চক্রটি শতাধিক নারীকে পাচার করেছে বলে দাবি ডিবির।

র‌্যাব ও পুলিশের ভাষ্য, নারী ও শিশু পাচারের একাধিক মামলায় তদন্তে নেমে তারা জানতে পেরেছে, গত বছর টিকটক চক্রের মাধ্যমে ভারতে পাচার হওয়া বাংলাদেশি এক তরুণীকে হত্যা করা হয়। তাঁর লাশ উদ্ধারের পর গুজরাট পুলিশ ফোনে তরুণীর বাবাকে এ তথ্য জানায়। নিহত তরুণীর নাম টুম্পা আক্তার। ঢাকার কোনাপাড়া এলাকা থেকে নিখোঁজ হন ওই তরুণী। তাঁর বাবা রহিম সেখ কালের কণ্ঠকে বলেন, টুম্পাকে হত্যার খবর গুজরাট পুলিশ মোবাইল ফোনে তাঁকে জানিয়েছে।

তদন্তসংশ্লিষ্ট পুলিশের এক কর্মকর্তা বলেন, গত দুই বছরে দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে কয়েক হাজার নারী নিখোঁজের অভিযোগে বিভিন্ন থানায় সাধারণ ডায়েরি করা হয়েছে। এর মধ্যে দেড় হাজারের বেশি নারী পাচার হয়েছে বলে প্রাথমিক তথ্য পেয়ে তদন্ত চলছে।
আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর সূত্রগুলো বলছে, পাচার হওয়া বেশির ভাগই কিশোরী ও তরুণী। তাদের ভারত, শ্রীলঙ্কাসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে পাচার করা হচ্ছে। সিআইডিসহ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা সংশ্লিষ্ট দেশ থেকে তাদের ফেরানোর চেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন বলে জানা গেছে।

পাচার হওয়া নারীদের আইনি সহায়তা দিয়ে আসছে বাংলাদেশ মহিলা আইনজীবী সমিতি। সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক অ্যাডভোকেট সালমা আলী বলেন, ‘প্রতিবছর দেশ থেকে অনেক নারী পাচার হওয়ার অভিযোগ পাওয়া যায়। তাদের মধ্যে কিশোরী-তরুণী এমনকি শিশুও রয়েছে। এসব পরিবার ও ভুক্তভোগীদের আইনগত সেবা দিই আমরা। দেশ থেকে নারী পাচারের সঙ্গে একটি রাঘব বোয়াল চক্র জড়িত। তারা যশোর ও সাতক্ষীরার সীমান্তবর্তী এলাকায় বেশি তৎপর। এর বাইরে সারা দেশে চক্রের পাঁচ শতাধিক সদস্য রয়েছে।’
জানতে চাইলে বাংলাদেশ মহিলা আইনজীবী সমিতির যশোর জেলা (প্রগ্রাম অফিসার) রেখা বিশ্বাস কালের কণ্ঠকে বলেন, গত দুই বছরে পাচার হয়ে দেশ ফেরা ৯০০ নারীকে আইনি সহায়তা দিয়েছেন তাঁরা। এর মধ্যে কিশোরী ও তরুণী বেশি।

সংশ্লিষ্ট অন্য একটি সংস্থার এক কর্মকর্তা বলেন, গত দুই বছরে কম করে হলেও দুই হাজার নারী পাচারের অভিযোগ পেয়েছেন তাঁরা।

পাচার হওয়া এক কিশোরীর পরিবারের ভাষ্য
সাত মাস আগে পাচার হওয়া ১৪ বছরের এক কিশোরী এখন গুজরাট রাজ্যের পুলিশের তত্ত্বাবধানে একটি চিলড্রেন হোমে রয়েছে। এর আগে প্রেমের ফাঁদে ফেলে আবির নামের এক যুবক তাকে এক নারীর সহায়তায় ভারতে পাচার করেন।

এ ঘটনায় নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা থানায় মানবপাচার প্রতিরোধ ও দমন আইনে পাঁচজনের নামে মামলা করা হয়েছে। এই মামলায় আবির ও রাশেদা নামে দুজনকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়। মামলার অন্য তিন আসামি হলেন মো. হাসান, জামাল ও সোনিয়া। মামলাটি তদন্ত করছেন ফতুল্লা থানার উপপরিদর্শক (এসআই) মো. রফিকুল ইসলাম।

এ ব্যাপারে ফতুল্লা থানার ওসি নুরে আজম মিয়া কালের কণ্ঠকে বলেন, ওই কিশোরীকে দেশে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চলছে।
কিশোরীর স্বজনদের ভাষ্য, মানব পাচার চক্রের সদস্যদের কাছ থেকে পালিয়ে প্রায় সাড়ে ছয় মাস ধরে সে গুজরাটের পুলিশের তত্ত্বাবধানে আছে। সেখান থেকে পুলিশের সহায়তায় মোবাইল ফোনে আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে যোগাযোগ করে কিশোরী। তার কাছ থেকে পুরো ঘটনা জানার পর স্বজনরা পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করে।

হাজারীবাগ থেকে ২ কিশোরী পাচার
গত ২৮ জানুয়ারি রাজধানীর হাজারীবাগ থেকে নিখোঁজ হওয়া দুই কিশোরী পাচার হয়ে বর্তমানে ভারতে রয়েছে বলে জানতে পেরেছে তার পরিবার। এ ঘটনায় নিখোঁজ এক কিশোরীর মা হাজারীবাগ থানায় একটি জিডি করেছেন।

একাধিক তদন্ত সূত্র বলছে, পাচার হওয়া দুই কিশোরীর সঙ্গে এক নারীসহ পাঁচ ব্যক্তির কথোপকথনের প্রমাণ পাওয়া গেছে। এর মধ্যে দুই জনের বাড়ি যশোর ও সাতক্ষীরায়। এদের সঙ্গে ভারতীয় কয়েকটি মোবাইল ফোন নম্বরের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রয়েছে।
হাজারীবাগ থানার ওসি নূর মোহাম্মদ বলেন, ‘সীমান্তবর্তী এলাকা সাতক্ষীরায়ও তাদের অবস্থান দেখা গেছে। আমাদের পাশাপাশি ডিবি এবং সিআইডির টিম কাজ করছে। তাদের উদ্ধারের চেষ্টা চলছে।’

ফিরে আসা তরুণীরা যা বলছেন
দেশে ফেরা এক তরুণী বলেন, ‘ভারতে পাচার হওয়ার পর বীভৎস নির্যাতনের শিকার হই। বেঙ্গালুরুর একটি ম্যাসাজ সেন্টার থেকে জানালা ভেঙে পালাতে সক্ষম হই। সেখান থেকে ট্রেনে কলকাতায় আসি। পরে দেশে ফিরি। পরে হাসপাতালে চিকিৎসা নিই।’ তিনি বলেন, ‘আমার বড় বোন ও ছোট খালাও পাচার হয়েছে। আমি তাঁদের সন্ধান চাই।’

এর আগে ভারতে পাচার হওয়া চার তরুণী দেশে ফিরে তাঁদের ওপর নির্যাতনের তথ্য দিয়েছেন। দেশে ফেরা তরুণীরা রাজধানীর হাতিরঝিল থানায় মানবপাচার ও পর্নোগ্রফি আইনে পাঁচটি মামলা করেন। এসব মামলায় ২০ জনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।

নারী পাচার চক্রের ২০ জনকে গ্রেপ্তারের পর পুলিশ জানতে পারে, এই পাচারচক্রে দেশ-বিদেশের কয়েক শ সদস্য যুক্ত। তারা শুধু ভারতে নয়, মালয়েশিয়া ও আরব আমিরাতেও নারী পাচার করেছে। মানবপাচারের সঙ্গে যশোরের শার্শা এলাকার একাধিক জনপ্রতিনিধির সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে।

জানতে চাইলে র‌্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, চক্রের অন্যতম সদস্য রাফি। তিনিসহ অন্যরা আন্তর্জাতিক নারী পাচার চক্রের মূল হোতা। সংক্ষিপ্ত ভিডিও শেয়ারিং প্ল্যাটফরম টিকটকে মডেল করার লোভ দেখিয়ে বিভিন্ন দেশে নারী পাচার করছে তারা।

https://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2024/02/10/1362277