১০ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, শনিবার, ৪:২৩

কোনো উদ্যোগে ‘সফলতা’ নেই

রাজধানীর বাজারগুলোতে প্রতিটি নিত্যপণ্য ও সবজির সরবরাহ প্রচুর। কাঁচা বাজারগুলোতে এ সব পণ্য বিক্রির জন্য ডালায়, বস্তায়, খাচায় টইটুম্বুর করে সাজিয়ে রাখা হয়েছে। বাজার অর্থনীতির হিসেব ‘পণ্যের সরবরাহ বেশি হলে দাম কমে’। কিন্তু উল্টো পথে হাটছে রাজধানীর পণ্যের বাজার। চাহিদার চেয়ে সরবরাহ বেশি হলেও দাম কমছে না বরং বাড়ছে। এমনকি ভরা মৌসুমে সবজির দাম আকাশ ছোঁয়া। বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী ঘোষণা দিয়েছেন ভারত থেকে পেঁয়াজ আসছে। দেশি পেঁয়াজের সরবরাহ ব্যাপক। তারপরও প্রতিদিনই বাড়ছে পেঁয়াজের দাম। গত তিন দিনের প্রতিদিনই কেজিতে ১০ টাকা থেকে ২০ টাকা করে বেড়ে এখন ১৩০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। অথচ গত সপ্তাহের ৮০ টাকা কেজি দরে পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে।

অন্যসব পণ্যের একই অবস্থা। ডিমের দাম বেড়েছে এক বছর আগে। এখনো সে দামি তেমন কমেনি। গরুর গোশতের দাম কসাইরা কমিয়ে ৫৯০ থেকে ৬১০ টাকা কেজিতে নামিয়ে এনেছিল। সরকারের দায়িত্বশীলরা সেই দাম ৫০ টাকা বাড়িয়ে দেয়ার ঘোষণা দেয়ায় প্রতি কেজিতে বেড়েছে একশ থেকে ১২০ টাকা।

কৃষিপণ্যের বাজারদর নিয়ন্ত্রণে রাখতে সরকার যে ব্যবস্থাটি আইনের রূপ দিয়েছিল, এখন পর্যন্ত তার বাস্তবায়ন হয়নি। ব্যবস্থাপনা এমন হওয়ার কথা ছিল, যেখানে পণ্যের উৎপাদন খরচ কত, পাইকারি ও খুচরা পর্যায়ে মুনাফার সর্বোচ্চ হার কত, সেই তথ্য ক্রেতাদের জন্য প্রকাশিত থাকবে। ফলে তাদের দরকষাকষির ভিত্তি তৈরি হত। কিন্তু সে পথে না গিয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে ব্যবসায়ীদের ডেকে ‘নসিহত’, অনুরোধ বা ‘হুঁশিয়ারি’ দিয়ে যেসব পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে, তা যে কাজ করছে না। ফলে ব্যবসায়ীরা সরকারের ছত্রছায়ায় থেকে সিন্ডিকেট তৈরি করে পণ্যের দাম ইচ্ছামতো বাড়িয়ে দিচ্ছে। সরকারি প্রতিষ্ঠান ভোক্তা অধিকার অধিদপ্তর রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন মার্কেটে অভিযান চালিয়ে খুচরা ব্যবসায়ীদের কিছু জরিমানা করলেও বাজারে কোনো প্রভাব ফেলতে পারছে না।

খোঁজ নিয়ে জানা যায় বগুড়ায় যে ফুলকফি ১৫ থেকে ২০ টাকা পিছ দরে বিক্রি হচ্ছে। সেই কফি ঢাকায় বিক্রি হচ্ছে ৫০ থেকে ৬০ টাকা। ৪০ টাকার বেগুন একশ টাকা, ৪০ টাকার সিম ৮০ থেকে ১০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। এমনকি রাজধানীর পাইকরি বাজার হিসেবে পরিচিত কারওয়ান বাজার ও যাত্রাবাড়ি বাজারে যে দরে পণ্য বিক্রি হচ্ছে খুচরা বাড়ারে তার দ্বিগুন দরে বিক্রি হচ্ছে বেশির ভাগ পণ্য। বাজারে পাইকারি ও খুচরা দরের মধ্যে দামের পার্থক্য বিস্তর। কিন্তু ক্রেতাদের ধারণা থাকে না পাইকারিতে আসলে দাম কত। জানতে চাইলে ভোক্তা অধিকার নিয়ে কাজ করা বেসরকারি সংগঠন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ বা ক্যাবের সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, যদি পাইকারি বাজারের দর ক্রেতার জানার সুযোগ থাকত, তাহলে খুব ভালো হত। সরকারের কর্তাব্যক্তিদের জিজ্ঞেস করুন, আইন বানিয়েছেন, কেন কার্যকর হচ্ছে না? বাজার ঠিক করতে হবে মুদ্রানীতি, ট্রেড পলিসিসহ নানা নীতির মাধ্যমে। মুক্ত বাজারকে জোর করে নিয়ন্ত্রণ করা যায় না।

জানা যায়, ২০১৮ সালে কৃষিপণ্য বিপণন আইন ও তিন বছর পর করা বিধিমালায় স্পষ্ট করেই বলা আছে উৎপাদন খরচ বিবেচনায় পাইকারি ও খুচরায় সর্বোচ্চ মূল্য কত হতে পারবে, সে বিষয়ে সরকার তালিকা প্রকাশ করবে। সেটি প্রকাশ্য স্থানে থাকবে। তাতে ক্রেতাদেরও এসব বিষয়ে তথ্য থাকবে। এই বিধিমালা অনুযায়ী উৎপাদন, পাইকারি ও খুচরা পর্যায়ে ইচ্ছামত মুনাফা ধরার সুযোগ নেই। পণ্যভেদে মুনাফার সর্বোচ্চ হার বেঁধে দেওয়া হয়েছে। তবে যৌক্তিক মুনাফা কত হবে, সেটি ঠিক করে দেওয়ার কথা প্রশাসনের।
প্রতিটি পর্যায়ে এই সর্বোচ্চ দরকে ‘যৌক্তিক মূল্য’ বলা হয়েছে আইন ও বিধিমালায়। কিন্তু এর কোনোটাই করা হয়নি। এ কাজ যেমন জেলা পর্যায়ে করার কথা, তেমনি উপজেলা পর্যায়েও করার কথা। বাজারভিত্তিক থাকার কথা আলাদা কমিটি। কিন্তু সে পথে না হেঁটে ব্যবসায়ীদের ডেকে মত বিনিময় বা সতর্ক করা, কেন্দ্রীয়ভাবে মন্ত্রণালয় থেকে দাম বেঁধে দিয়ে ভ্রাম্যমাণ আদালত দিয়ে অভিযান এবং পণ্যের আমদানির অনুমতি দিয়ে বাজার নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেছে সরকার।

গতকাল রাজধানীর যাত্রাবাড়ি, শনির আখড়া, গোবিন্দগঞ্জ, দয়াগঞ্জ বাজার ঘুরে দেখা গেছে, শীতকালীন সব ধরনের সবজি আগের দামেই বিক্রি হচ্ছে। বাজারে প্রতি কেজি মুলার দাম ৪০ টাকা, শিম ৭০ থেকে ৯০ টাকা, ফুলকপি ৪০ থেকে ৬০ টাকা, বাঁধাকপি ৪০ থেকে ৫০ টাকা, পাকা টমেটো প্রকারভেদে ৪০ থেকে ৬০ টাকা, কাঁচা টমেটো ৩০ টাকা, কচুরমুখী ১০০ টাকা এবং গাজর ৩০ থেকে ৪০ টাকা। এছাড়া বেগুনের কেজি ৬০ থেকে ১০০ টাকা, করলা ৮০ টাকা, ঢেঁড়স ১০০ টাকা, বরবটি ১২০ টাকায়, খিরা ৫০ থেকে ৬০ টাকা, শসা ৭০ টাকা। বাজারে প্রতিটি লাউ বিক্রি হচ্ছে ৮০ থেকে ১২০ টাকা দরে। পেঁপের কেজি ৪০ টাকা, লেবুর হালি ৩০ থেকে ৪০ টাকা, ধনে পাতার কেজি ১০০ থেকে ১২০ টাকা, কলার হালি ৩০ টাকা, জালি কুমড়া ৫০ টাকা, মিষ্টি কুমড়ার কেজি ৪০ থেকে ৫০ টাকা, পেঁয়াজের কলি ৬০ টাকা ও কাঁচা মরিচের কেজি ৮০ থেকে ১০০ টাকা, পেঁয়াজ ১২০ টাকা, রসুন ২৪০ টাকা, আদা ২৩০ টাকা ও আলু ৪০ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে। ডিমের হালি এখন ৪৫ টাকা।

চলতি সপ্তাহে ২০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে ব্রয়লার মুরগি। গত সপ্তাহে একই দামে বিক্রি হয়েছিল। তবে সোনালি, সোনালি হাইব্রিড মুরগির দাম কমেছে। বাজারগুলোতে সোনালি ২৮০ টাকা, সোনালি হাইব্রিড ২৬০ টাকা, দেশি মুরগি ৫০০ থেকে ৫২০ টাকা, লেয়ার মুরগি ২৯০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। বাজারগুলোতে এক ডজন লাল ডিম ১৩০ টাকা, হাঁসের ডিম ২০০ টাকা, দেশি মুরগির ডিমের হালি ৮০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

মাছের বাজার ঘুরে দেখা গেছে, ৪০০ গ্রাম ওজনের ইলিশের কেজি প্রতি ৮০০ টাকা। চাষের শিং (আকারভেদে) মাছের কেজি ৩৫০ থেকে ৬০০ টাকা, প্রতি কেজি রুই মাছের দাম বেড়ে (আকারভেদে) ৪০০ থেকে ৫৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। প্রতি কেজি মাগুর ৭০০ থেকে এক হাজার টাকা, মৃগেল ৩০০ থেকে ৪৫০ টাকা, পাঙাশ ২০০ থেকে ২২০ টাকা, চিংড়ি ৮০০ থেকে এক হাজার ২০০ টাকা, বোয়াল ৫০০ থেকে ৯০০ টাকা, তেলাপিয়া ২২০ টাকা, কই ২২০ থেকে ২৪০ টাকা, মলা ৫০০ টাকা, কাচকি ৬০০ টাকা, শোল ৬০০ থেকে এক হাজার টাকা, আইড় ৬০০ থেকে দরে বিক্রি হচ্ছে।

আইন অনুযায়ী কৃষকের উৎপাদন খরচ হিসাব করে মুনাফার হার হবে সর্বোচ্চ ৪০ শতাংশ। কৃষক কোন পণ্য পাইকারিতে সর্বোচ্চ কী দামে বিক্রি করবে, সেটি প্রশাসনের তালিকা টানিয়ে দেওয়ার কথা। বিধিমালা অনুযায়ী উৎপাদন পর্যায়ে ফসল ও পণ্যভেদে সর্বোচ্চ ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ, পাইকারি পর্যায়ে ১৫ থেকে সর্বোচ্চ ২৫ শতাংশ, এবং খুচরা পর্যায়ে ২৫ থেকে সর্বোচ্চ ৩০ শতাংশ যৌক্তিক মুনাফা করার কথাও বলা আছে। অথচ কয়েকটি কর্পোরেট হাউজ সিণ্ডিকেট করে পণ্যের দাম বাড়িয়ে দিচ্ছে। আবার খুচরা পর্যায়ে বিক্রেতারা বাজারে থাকেন একজোট, তারা একটি নির্ধারিত দামের নিচে পণ্য বিক্রি করেন না, নষ্ট হলে ফেলে দেন, তাও কম দামে ছাড়েন না। ফলে বেশি দামে ভোক্তাদের পণ্য কিনতে হচ্ছে। মূলত এই মূল্য যৌক্তিক কি না, সেটি কখনো ক্রেতা জানে না, তার আসলে প্রশ্ন রাখার সুযোগও নেই। এই পণ্যের মধ্যে কোনটির দাম পাইকারিতে কত, সে বিষয়ে কারো মধ্যে কোনো ধারণা থাকে না। ফলে ক্রেতার পক্ষে দর কষাকষির সুযোগ থাকে না।

বাজার নিয়ন্ত্রণের সরকার আন্তরিক জানিয়ে গত সাপ্তাহে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, সরকারের মূল চ্যালেঞ্জ হচ্ছে বাজার নিয়ন্ত্রণ করা, পণ্যের মূল্য ক্রেতাদের নাগালের মধ্যে নিয়ে আসা। তবে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের বলেছেন, নিত্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে সরকার যে ব্যবস্থা নিচ্ছে তা কাজে আসছে না। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে সারা দেশে মানুষের মধ্যে ক্ষোভ বাড়ছে। দ্রব্যমূল্য লাগামহীনভাবে বাড়ছে এবং সরকার যে ব্যবস্থা নিচ্ছে তা কাজে আসছে না।

https://dailyinqilab.com/national/article/637630