১০ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, শনিবার, ৪:০৫

কিশোর গ্যাংয়ের অপতৎপরতা থামছে না!

-অ্যাডভোকেট তোফাজ্জল বিন আমীন

কিশোররাই বিশ্ব জয় করে। একটি সমাজ ও রাষ্ট্র তাঁদের কাঁধে ভর করে বহুদূর এগিয়ে যায়। সেজন্য বোধ হয় কিশোরদের নিয়ে সবাই স্বপ্ন দেখেন। যেমন আল্লাহমা ইকবাল তরুণদের নিয়ে লিখেছেন- আজকের সভ্যতার জমকালো এ জীবন তুমি খুঁজতে যেও না, বিশ্বাসের চূড়ান্ত সীমায় একই পরিতৃপ্তি তুমি পাবে। তরুণরা প্রজাপতির মতো ঘুরে বেড়াবে, অন্যায়-অবিচার ও জুলুমের বিরুদ্ধে সভ্যতার বিজয় নিশান উড়াবে, এমনটাই সবার প্রত্যাশা। কিন্তু সে আশা যেন গুড়ে বালি। কারণ স্মার্টযুগের কিছু কিশোর সুপথে না হেঁটে বিপথে পা বাড়িয়ে কিশোর গ্যাংয়ে জড়িয়ে পড়েছে, যা কারও জন্য সুখকর নয়। কারণ যে সমাজ ও রাষ্টের কিশোররা বিপদগামী হয়ে উঠে, সে সমাজ বা রাষ্ট্র বেশি দূর এগোতে পারে না। দুর্ভাগ্য আমাদের-ক্ষমতায় টিকে থাকা কিংবা ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য যে ধরনের অসুস্থ প্রতিযোগিতা আমরা লক্ষ্য করি তাঁর ছিটেফোঁটাও যদি কিশোরদের সুন্দর জীবন গঠনে করা হতো, তাহলে কিশোর গ্যাং সংস্কৃতি গড়ে উঠতো না। তরুণরা কতটা বিপথগামী তার দৃষ্টান্ত তো জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। সম্প্রতি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে এক দম্পতিকে ডেকে এনে স্বামীকে আবাসিক হলে আটকে রেখে স্ত্রীকে ধর্ষণের অভিযোগ উঠে বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী মোস্তাফিজুর রহমান ও বহিরাগত মামুনুর রশিদের বিরুদ্ধে। এ ঘটনায় ভিকটিমের স্বামী ছয়জনের নামে মামলা করে। তাদের চারজনই বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের নেতা। এ ঘটনা বিশ^বিদ্যালয় তো বটেই দেশের জন্যও লজ্জাকর।

আমরা বড্ড কঠিন সময় পার করছি। রাজনৈতিক সমস্যা, অর্থনৈতিক সমস্যা ও সামাজিক সমস্যা প্রকট হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে চোখের সামনে কলিজার টুকরা কিশোর তরুণ তরুণীরা হয় কিশোর গ্যাং, নতুবা কিশোর গ্যাং সৃষ্টিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে। অন্যায়-অবিচার কিংবা পাপে নিমজ্জিত হতেও কুন্ঠাবোধ করছে না। কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে কেউ কিছু বলার সাহস পাচ্ছে না। কারণ সেখানেও রাজনীতির জুজুর ভয় দেখানো হয়। রাজনৈতিক বিরোধ থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্ত দেশের স্বার্থে, জাতির স্বার্থে কিছু কিছু জায়গায় এক হওয়া প্রয়োজন। আমাদের ভাষা এক, মানচিত্র এক। এক মানচিত্রের নিচে বিভক্তি সুখকর নয়। কারণ তা দেশের জন্য কল্যাণকর হয় না। যারা কিশোর গ্যাংয়ে জড়িত, তারা কেউ পৃথিবীর অন্য কোন দেশের বাসিন্দা নন; তারা কেউ আমাদের সন্তান, কেউ আমাদের ভাই, কেউ আমাদের প্রতিবেশী, কেউ আমাদের ভ্রাতুষ্পুত্র। অথচ কিশোর গ্যাং আমাদের জনজীবনকে বিষিয়ে তুলছে। কিশোর গ্যাং এর নাম আমরা আগে শুনেননি। এখন প্রতিনিয়ত পত্রিকার পাতায় চোখ ভুলালে কিশোর গ্যাং বাহিনীর নানা অপকর্মের ঘটনা মুদ্রিত হচ্ছে।

কিশোর গ্যাং কারা? কী তাদের পরিচয়? এ বিষয়গুলো পরিষ্কার করা দরকার। স্কুল-কলেজের গেটে কিংবা রাস্তার মধ্যে ১১-১৬ বছর বয়সী দলবদ্ধ কিছু কিশোর দেখা যায়। যাদের চাহনিতে একপ্রকার রুক্ষতা, অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি, মোটরসাইকেলের বিরক্তিকর হর্ন বাজিয়ে মানুষকে উত্ত্যক্ত করে তাদেরকে ‘‘কিশোর গ্যাং’ হিসেবে আমরা চিনি। কিশোর গ্যাং সমাজের মারাত্মক ব্যাধি। কারণ এমন কোনো অপকর্ম নেই, যা তারা করে না। ছিনতাই থেকে শুরু করে মাদক সেবন, ইভটিজিং ও জুনিয়র- সিনিয়র সংঘাতে খুনের ঘটনা ঘটছে। কিশোর গ্যাং গড়ে ওঠার পেছনে রাজনৈতিক মদদ রয়েছে। ফলে তারা পাড়া-মহল্লায় ক্ষমতার দাপটে পুরো সমাজকে অস্থির করে তুললেও কেউ কিছু বলার সাহস পায় না। কিশোর গ্যাং বিস্তারের অন্যতম কারণ হলো সামাজিকভাবে তাদের প্রতিহত করার জায়গাটি অনেক দুর্বল থাকার ফলে এর প্রভাব বেড়েই চলেছে। এ প্রবণতা বন্ধ করতে না পারলে আমরা কেউ নিরাপদ থাকবো না। সুতরাং কিশোর গ্যাং দমনে আইন প্রয়োগকারী বাহিনীকে আরো কঠোর হতে হবে। প্রসঙ্গক্রমে আমরা একটি ঘটনা মনে পড়ে গেল। গত রোজার ঈদে গ্রামের বাড়িতে গিয়েছিলাম। ঈদের নামায শেষ করে চাচাতো ভাইদের সাথে বাড়ি ফিরছিলাম। যথন আমাদের বাড়ির মোড়ে এসে পৌঁছলাম তখন দেখলাম ১৩ থেকে ১৪ বছরের ৪-৫ জন ছেলে রাস্তায় পটকা ফুটানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে। তা দেখে আমার এক বড় ভাই নিষেধ করলেন। কিন্তু তারা কেউ তার কথায় কর্ণপাত করল না। উল্টো পটকা ফাটিয়ে উল্লাস করা শুরু করল। আমার আরেক চাচাতো ভাই তখন কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করাতে তার ওপর তেড়ে আসে। অবস্থা খুব খারাপের দিকে গেল। আমরা মাথা নিচু করে চলে আসলাম। পরে খবর নিয়ে জানতে পারলাম তারা আমাদের পাশের গ্রামেরই ছেলে। অথচ আমরা যখন ছোট ছিলাম তখন মুরুব্বীদের দেখা মাত্রই রাস্তার একপাশে চলে যেতাম। সাইকেল চালিয়ে গেলেও মুরুব্বী দেখলে সাইকেল থেকে নেমে যেতাম। এখন এসবই স্মৃতি। এখন আর এরকম দৃশ্য দেখা যায় না।

কিশোর গ্যাং কারও জন্য কল্যাণকর নয়। বিশেষ করে বাবা-মায়ের জন্য অভিশাপ। কারণ আধিপত্য বিস্তার, সিনিয়র-জুনিয়র দ্বন্দ্ব, প্রেমের বিরোধ নিয়ে কিশোররা খুনের শিকার হচ্ছে। স্কুল ছাত্র আদনান কবীর কিশোর গ্যাংয়ের প্রথম শিকার হন। ২০১৭ সালে তাঁকে হত্যা করা হয়। তারপর থেকে কিশোর গ্যাংয়ের বিষয়টি আলোচনায় আসে। সামাজিক অবক্ষয়ের মূল কারণ এই কিশোর গ্যাং। শুধু ঢাকার শিশু আদালতের বিচারিক কার্যক্রমের নথির ভাষ্য হতে জানা যায় যে, গত ১৫ বছরে রাজধানীতে কিশোর গ্যাংয়ে সিনিয়র-জুনিয়র দ্বন্দ্বে প্রায় ২০০টি খুনের ঘটনা ঘটেছে। কিশোর গ্যাং নিয়ন্ত্রণ করার জন্যে কিছু সামগ্রিক কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন। বিশেষ করে অর্থনৈতিক ও সামাজিক বৈষম্য দূর করা প্রয়োজন। প্রয়োজন সামাজিক দ্বন্দ্ব, মারামারি, কলহ, রাজনৈতিক বিভেদ ও পারিবারিক দ্বন্দ্বের অবসান ঘটানো। কারণ এ সমস্ত দ্বন্দ্ব দেখে আমাদের শিশুরা বড় হচ্ছে। ফলে তারাও নানাভাবে অপরাধে জড়িয়ে পড়েছে। আইনপ্রয়োগকারী বাহিনীর ভাষ্য অনুসারে রাজধানীর মিরপুর, তেজগাঁও, উত্তরা, গুলশান, ধানমন্ডি, ঝিগাতলা, আজিমপুর, লালবাগ, ওয়ারী, সায়েদাবাদ, খিলগাঁও, মতিঝিল, রমনা, মগবাজার, গাবতলী, মহাখালী, বাড্ডা, রামপুরা, হাতিরঝিল এলাকায় কিশোর গ্যাং রয়েছে। কিশোর গ্যাংয়ের হাতে নিহত হওয়া মানুষের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। গত ২৩ জানুয়ারি ২০২৪ নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে মসজিদের মাইকে ঘোষণা দিয়ে মিলন নামে এক কিশোর গ্যাং লিডারকে এলাকাবাসী পিটিয়ে হত্যা করেছে। এটি কারও কারও মতে ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ। কিন্তু আইনে এ ধরনের কর্মকা-কে উৎসাহ জোগায়নি; বরং নিরুসাহিত করা হয়েছে। কারণ যে কেউ অপরাধী হতে পারে। কিন্তু আইন হাতে তুলে নেয়ার লাইসেন্স রাষ্ট্র কাউকে দেয়নি। এটি অন্যায়, এটিও গুরুতর অপরাধ। কিশোর গ্যাং বন্ধে নৈতিক শিক্ষার প্রসার ও সামাজিক জনসচেতনতা বাড়ানো প্রয়োজন। শুধুমাত্র পুলিশ দিয়ে কিশোর গ্যাং বন্ধ করা সম্ভব নয়। নৈতিকতার অবক্ষয় ঠেকাতে না পারলে কিশোর গ্যাং সংস্কৃতি বন্ধ হবে না। সর্বোপরি সবার ঐকান্তিক প্রচেষ্টা, জনসচেতনতা ও আইনের শাসন নিশ্চিতকল্পে কিশোর গ্যাং বন্ধ করা সম্ভব। সরকার এ ব্যাপারে উদ্যোগী ভূমিকা পালন করবে, এমনটিই সবার প্রত্যাশা।

https://www.dailysangram.info/post/548439