১০ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, শনিবার, ৪:০৩

ক্যান্সার চিকিৎসায় সঙ্কট ও বাস্তবতা

-ইবনে নূরুল হুদা

ক্যান্সার বা কর্কটরোগ বাস্তবিক পক্ষেই একটি প্রাণঘাতি রোগ। এটি কোষবিভাজন সংক্রান্ত রোগগুলোর সমষ্টি। বিশ্বে এখন পর্যন্ত এই রোগে মৃত্যুর হার সবচেয়ে বেশি। কারণ, প্রাথমিক অবস্থায় ক্যান্সার সহজে ধরা পড়ে না, ফলে শেষ পর্যায়ে গিয়ে ভালো কোন চিকিৎসা দেয়াও সম্ভব হয় না। বাস্তবিক অর্থে এখনও পর্যন্ত ক্যান্সারের চিকিৎসায় পুরোপুরি কার্যকর কোনও ওষুধ আবিষ্কৃত হয়নি। তবে প্রাথমিক অবস্থায় ধরা পরলে এই রোগ সারানো সম্ভব বলে মনে করেন চিকিৎসা সংশ্লিষ্টরা। জানা গেছে, ২০০ প্রকারেরও বেশি ক্যান্সার রয়েছে। প্রত্যেক ক্যান্সারই আলাদা আলাদা এবং এদের চিকিৎসা পদ্ধতিও ভিন্নতর। কিন্তু আমাদের দেশ ক্যান্সার চিচিৎসার ক্ষেত্রে আহামরি কোন সাফল্য দেখাতে পারেনি। ফলে এতদবিষয়ক প্রাণহানিটা আমাদের দেশে অনেকটাই বেশি।

পরিসংখ্যান অনুযায়ী, আমাদের দেশে অসংক্রামক রোগে সর্বাধিক মৃত্যুর কারণ হচ্ছে ক্যান্সার। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দেশে প্রতিবছর দেড় লাখের বেশি মানুষ এই রোগে আক্রান্ত হন এবং এক লাখ ১০ হাজারের মতো মানুষ মৃত্যুবরণ করেন। দেশের ক্যান্সার চিকিৎসায় নেই প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা ও সময়োপযোগী দিকনির্দেশনা। কারণ, স্বাধীনতার অর্ধশতাব্দী অতিক্রান্ত হলেও এখনো ক্যান্সারের গতি-প্রকৃতি নির্ণয়ে হয়নি জাতীয় ক্যান্সার নিবন্ধন। অবশ্য ২০২২ সালের জানুয়ারিতে দেশের আটটি বিভাগীয় শহরে সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ক্যান্সার চিকিৎসা কেন্দ্র স্থাপন প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়েছে। আট বিভাগীয় শহরের মেডিকেল কলেজে পৃথক পূর্ণাঙ্গ ক্যান্সার চিকিৎসা কেন্দ্র নির্মাণের লক্ষ্যে প্রকল্পের কাজ শুরু হয় ২০১৯ সালের জুলাই থেকে। অথচ এখনও চিকিৎসার জন্য কেন্দ্রগুলো চালু করা সম্ভব হয়নি। এমন পরিস্থিতিতেই বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও পালিত হয়ে গেল বিশ্ব ক্যান্সার দিবস। দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্য ছিল ‘আসুন ক্যান্সার সেবায় বৈষম্য দূর করি’। কিন্তু এক্ষেত্রে আমাদের উল্লেখযোগ্য কোন অর্জন এখন পর্যন্ত নেই বরং শুধুই দিবস পালনের মধ্যেই সবকিছু সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কোন দেশের ক্যান্সার রোগ নিয়ন্ত্রণে প্রয়োজনীয় সঠিক তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহে রাখা দরকার; যা রোগ নির্ণয়ে, নিয়ন্ত্রণ এবং প্রয়োজনীয় চিকিৎসা নিশ্চিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে সহায়ক হয়। তাই জাতীয় ক্যান্সার নিবন্ধনের বিকল্প নেই। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ক্যান্সারের মতো জটিল রোগের চিকিৎসা, রোগ তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ, চিকিৎসা সংক্রান্ত প্রস্তুতি, প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা ইত্যাদি নিশ্চিত করতে জাতীয় ক্যান্সার নিবন্ধন জরুরি। ইতিপূর্বে এই কাজটি না হলেও কাজটি শুরু করা হয়েছে বলে জানা গেছে। ইতোমধ্যে কিশোরগঞ্জের হোসেনপুর উপজেলার চারটি ইউনিয়নের ৮৫ হাজার মানুষকে নিবন্ধনের আওতায় আনা হয়েছে। এই উপজেলার আড়াই লাখ মানুষকে নিবন্ধনের আওতায় আনা হবে বলে জানানো হয়েছে। পরবর্তীতে পার্শ্ববর্তী অন্য একটি উপজেলা এ ক্ষেত্রে সম্পৃক্ত করা হবে। তবে বিষয়টি একেবারেই প্রাথমিক পর্যায়েই রয়েছে। কিন্তু প্রাথমিক তথ্যে নারী-পুরুষ উভয়ের ক্ষেত্রে ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার হার প্রায় সমান বলে জানা গেছে। এ ছাড়া শিশুদের আক্রান্তের হার প্রায় ৭ শতাংশ।

বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) হিসাব অনুযায়ি, বাংলাদেশে বর্তমানে ১২ লাখ ক্যান্সারের রোগী রয়েছেন। প্রতিবছর আনুমানিক দুই লাখ মানুষ এই ব্যাধিতে আক্রান্ত হন এবং দেড় লাখ রুগী প্রাণ হারায়। সচেতনতা ও শিক্ষার অভাব এবং অর্থনৈতিক অবস্থা তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে ক্যান্সার রোগে মৃত্যুর হার বৃদ্ধির মূল কারণ বলে জানা যায়। ২০২০-এর সালের এক জরিপের ফলাফলে জানা গেছে, বাংলাদেশে অসংক্রামক রোগে মোট মৃত্যুর ১০ শতাংশের মৃত্যু হয় ক্যান্সারে। যা অসংক্রামক রোগ-সম্পর্কিত মৃত্যুর ষষ্ঠ প্রধান কারণ। এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রতিবছর বাংলাদেশে এক লাখ ৫৬ হাজার ৭৭৫ জন নতুন করে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়। একই সময়ে এক লাখ ৮ হাজার ৯৯০ জনের মৃত্যু হয়। এর মধ্যে ফুসফুসের ক্যান্সারে মৃত্যু হয় ১১ দশমিক ১ শতাংশ। জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তারা সাধারণত বিভিন্ন পরিসংখ্যান ও তথ্যের ওপর ভিত্তি করে বিভিন্ন পরিকল্পনা প্রণয়ন করেন। কারণ তারা জানানে না দেশের ক্যান্সারের প্রকৃত অবস্থা। ফলে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ এবং আক্রান্তদের পর্যাপ্ত চিকিৎসা দেওয়াও সম্ভব হয় না।

দ্য ইন্টারন্যাশনাল এজেন্সি ফর রিসার্চ অন ক্যান্সার (আইএআরসি)-এর হিসেব অনুযায়ী, ২০২২ সালে বিশ্বে ২ কোটি নতুন ক্যানসার রুগী শনাক্ত হয়েছে এবং ৯৭ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়েছে। যার মধ্যে ফুসফুস ক্যান্সারে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা ধূমপানকে ফুসফুস ক্যান্সারের প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। সংস্থাটির মতে, তামাক ব্যবহার পরিহারসহ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে ক্যান্সারে মৃত্যু ঝুঁকি ৩০ শতাংশ থেকে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত প্রতিরোধ করা সম্ভব।

আইএআরসি’র তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে ২০২২ সালে ক্যান্সারে এক লাখ ১৬ হাজার ৫৯৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। গ্লোবাল অ্যাডাল্ট টোব্যাকো সার্ভে, ২০১৭ অনুযায়ী বাংলাদেশে ৩ কোটি ৭৮ লাখ (৩৫ দশমিক ৩ শতাংশ) প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ তামাক ব্যবহার করেন। কর্মক্ষেত্রে পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হয় ৮১ লাখ মানুষ। গণপরিবহনে যাতায়াতের সময় পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হয় আড়াই কোটি প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষ। তামাক ব্যবহারজনিত রোগে দেশে বছরে ১ লাখ ৬১ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়। গবেষকরা বলছেন, ক্যান্সার সংক্রান্ত সব তথ্যের জন্য আমরা অন্যদের ওপর নির্ভরশীল। এসব তথ্য মূলত পরিসংখ্যান নির্ভর। আমাদের নিজেদের গবেষণা এবং আন্তর্জাতিক উপাত্তের মধ্যে কিছু পরিবর্তন লক্ষণীয়। তাই ক্যান্সার নিবন্ধন করতে পারলে এই সমস্যা থেকে বেরিয়ে আসা খুবই সম্ভব। কিন্তু এই অত্যাবশ্যকীয় কাজটি আমরা এখনো সঠিকভাবে করতে পারিনি। ফলে প্রাণঘাতি ক্যান্সার রোগ চিকিৎসায় আমাদের তেমন কোন সাফল্য নেই।

যেহেতু ক্যান্সার কোনো একক রোগ নয়, তাই এর লক্ষণও ক্যান্সারভেদে ভিন্নতর। তবে সামষ্টিকভাবে কিছু লক্ষণকে ক্যান্সারের সাধারণ বিপদসংকেত হিসেবে ধরে নেন চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা। সেগুলো হলো-কোনো ব্যাখ্যা ছাড়াই হঠাৎ শরীরের ওজন কমতে শুরু করা, রক্তস্বল্পতা ও ফ্যাকাশে হয়ে যাওয়া এবং অস্বাভাবিক দুর্বলতা। মলমূত্র ত্যাগের অভ্যাসে পরিবর্তন হওয়া। যেমনÑকিছুদিন ডায়রিয়া, আবার কিছুদিন কোষ্ঠকাঠিন্য। শরীরের কোথাও কোনো পি- বা চাকার উপস্থিতি। ভাঙা কণ্ঠস্বর, যা কোনো চিকিৎসায় ঠিক হচ্ছে না। শরীরের একাধিক স্থানে তিল বা আঁচিলের সুস্পষ্ট পরিবর্তন। শরীরের কোনো অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ থেকে অস্বাভাবিক রক্তক্ষরণ। উল্লিখিত লক্ষণগুলো দেখলে সতর্ক হয়ে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।

এছাড়া ক্যান্সার প্রতিরোধে কিছু অভ্যাস রপ্ত করা দরকার বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। এর মধ্যে নিয়মিত ব্যায়াম, শারীরিক পরিশ্রম ও পরিমিত স্বাস্থ্যকর খাবার গ্রহণ অত্যাবশ্যক। নিরাপদ ও নিয়ন্ত্রিত যৌন অভ্যাস নিশ্চিত করা দরকার। শাক-সবজি, ফলমূল ও বিভিন্ন ফাইবারসমৃদ্ধ খাবার পর্যাপ্ত পরিমাণে খাওয়া। অধিক ক্যালরি, ফ্যাটযুক্ত খাবার, ধূমপান, তামাক ও মদ্যপান পরিহার করতে হবে। একই সঙ্গে একটি নির্দিষ্ট বয়সের পর মানুষের বয়স অনুযায়ী বিভিন্ন স্ক্রিনিং পরীক্ষা ক্যান্সার প্রতিরোধে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি পদক্ষেপ। প্রাথমিক পর্যায়ে রোগ শনাক্ত করতে এই পরীক্ষাগুলো কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও নিয়ম অনুযায়ী ক্যান্সার স্ক্রিনিংয়ের পাশাপাশি হেপাটাইটিস, এইচপিভির মতো ভাইরাসের টিকা বা ভ্যাকসিন নিতে হবে। এর মাধ্যমে বেশ কিছু ক্যান্সার প্রতিরোধ করা সম্ভব। বিপদসংকেত দেখামাত্র দ্রুত চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে।

একথা অস্বীকার কারা যাবে না যে, ক্যান্সার চিকিৎসা, নিবন্ধন, প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহের ক্ষেত্রে আমরা যেমন পিছিয়ে রয়েছি, ঠিক তেমনিভাবে আমরা প্রয়োজনীয় গণসচেতনতাও সৃষ্টি করতে পারিনি। বিভিন্ন পরিসংখ্যান থেকে একথায় প্রমাণিত হয় যে, আমাদের দেশের সর্বাধিক সংখ্যক মৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ হলো ক্যান্সার। বাংলাদেশে সমস্ত মৃত্যুর ১০ শতাংশের মূলে ক্যান্সার, যা ২০১৮ সালে প্রায় ১০৮,০০০ মানুষের মৃত্যুর জন্য দায়ী। বর্তমানে বাংলাদেশে ১৩ থেকে ১৫ লাখ ক্যান্সার আক্রান্ত রুগী রয়েছে এবং প্রতিবছর আনুমানিক দেড় লক্ষ মানুষ নতুন করে আক্রান্ত হয়। নতুন ক্যান্সারে আক্রান্তের সংখ্যা যে হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে তাতে ২০৩৫ সালে এটি ২৫ লাখে পৌঁছাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। বাংলাদেশে ক্যান্সার রোগীদের জন্য বিশেষজ্ঞের অনুপাত মাত্র ১:১০,০০০, ভারতে যেখানে এখন ১:১৬০০।

ক্যান্সার মানসিকভাবে ক্লান্তিকর এবং অনেকের জন্য এটি আর্থিকভাবে ধ্বংসাত্মক রূপ ধারণ করে। ব্যয়বহুল চিকিৎসা, চিকিৎসার সীমাবদ্ধতা, চিকিৎসক এবং রোগীর মধ্যে যোগাযোগের অভাব, দেশীয় চিকিৎসকদের প্রতি তুলনামূলক কম আস্থা, বিভিন্ন চিকিৎসার মতামত নিয়ে বিভ্রান্তি, প্রশিক্ষিত ক্যান্সার বিশেষজ্ঞের এবং চিকিৎসা সুবিধার অভাব এবং বিদেশে চিকিৎসার জন্য ক্রমবর্ধমান পর্যটন-এসব কারণে এখন বাংলাদেশে ক্যান্সার রোগীদের জন্য পরিপূরক সেবা সরবরাহ করা অনেক প্রয়োজন। অনেক ক্যান্সারের নমুনা বিশ্লেষণের জন্য বিদেশে পাঠানো হয় এবং এই স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার জন্য রোগীদের নিজস্ব পকেট থেকে উচ্চ অংকের টাকা প্রদান করতে হয়। যা সকল শ্রেণির মানুষের পক্ষে সম্ভব হয় না। তাই অনেকেই বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুবরণ করেন।

আমাদের দেশে ক্যান্সারের বৃদ্ধিমূলক প্রবণতা কেবল ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের স্বাস্থ্য, জীবনমান এবং সুস্বাস্থ্যের ক্ষতিই করে না বরং সামাজিক এবং সরকারি-উভয় স্তরের একটি গুরুত্বপূর্ণ আর্থিক বোঝা সৃষ্টি করে। প্রাথমিক পর্যায়ে ক্যান্সার সনাক্ত করা এবং সঠিক চিকিৎসার পরিকল্পনা করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কারণ এতে করে চিকিৎসার বিকল্পগুলো নির্ধারণ করা, মানসিক প্রভাব কমানো এবং আর্থিক বোঝা হ্রাস করা সম্ভব। নির্ভরযোগ্য ক্যান্সার সনাক্তকরণ প্রয্ুিক্ত বাংলাদেশে এখনো সীমাবদ্ধ এবং অনেক পরীক্ষা বিশ্লেষণের জন্য বিদেশে পাঠানো হয়ে থাকে।

বাংলাদেশে ক্যান্সার সনাক্তকরণ সরঞ্জামগুলো ব্যয়বহুল, কিছু ক্ষেত্রে আক্রমণাত্মক এবং প্রায় অসম্পূর্ণ ফলাফল প্রদান করে; তার উপর নির্ভরযোগ্য ডায়াগনস্টিকের ফলাফল পেতে প্রচুর সময় ব্যয় হয়ে যায়। উপরন্তু, কিছু ক্যান্সারের জন্য, যেমন ডিম্বাশয়ের (ওভারিয়ান), যকৃত বা অগ্ন্যাশয়ের ক্যান্সারের ভালো স্ক্রিনিংয়ের পদ্ধতিগুলো বিদ্যমান নেই। ফলে চিকিৎসার জন্য রুগীদের শারীরিক লক্ষণগুলো দৃশ্যমান হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়।

সফল ক্যান্সার চিকিৎসার জন্য রেডিয়েশনথেরাপি সুবিধা, প্রশিক্ষিত ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ, মেডিকেল রেডিয়েশন পদার্থবিদ এবং প্রযুক্তিবিদদের প্রাথমিক সনাক্তকরণ এবং চিকিৎসার উন্নত জ্ঞানের প্রয়োজন রয়েছে। এর পাশাপাশি গণস্বাস্থ্যের প্রচারণাগুলোতে বিভিন্ন ধরনের শারীরিক পরিশ্রম করার পাশাপাশি সঠিক জীবনযাপন এবং স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস মেনে চলার উপর গুরুত্ব দেয়ার আবশ্যকতা রয়েছে। ক্যান্সার সম্পর্কিত তথ্য, নির্দেশনা এবং চিকিৎসার পরামর্শ দেয়ার জন্য ডাক্তার এবং ক্যান্সার রোগীদের জন্য কোনো ওয়ান-স্টপ হাব নেই। রেডিওথেরাপি এবং কেমোথেরাপির অসুস্থতা যেমন ডায়রিয়া, বমি বমি ভাব, পেট ব্যথা এবং জ্বর দ্বারা চিহ্নিত করা সম্ভব।
ক্যান্সারের বিরুদ্ধে সফলভাবে লড়াই করার জন্য, বিজ্ঞানী, চিকিৎসক এবং রোগীকে প্রথমেই ক্যান্সারের কারণটি ঠিকমত বুঝতে হবে যাতে তারা সিদ্ধান্ত নিতে পারে যে কোন চিকিৎসার পদ্ধতি সবচেয়ে কার্যকর হবে। এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। কারণ, ক্যান্সার রোগের বিশাল বোঝা আমাদের জনজীবনে অনেক নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। বিশেষত আমাদের মতো সংবেদনশীল জনগোষ্ঠীর উপর। বাংলাদেশে রেডিওথেরাপি চিকিৎসার খরচের কোনও নিয়মকানুন নেই। জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল স্বল্প আয়ের ক্যান্সার রোগীদের রেডিওথেরাপির একটি সম্পূর্ণ কোর্সের জন্য ১৫ হাজার থেকে ২২ হাজার টাকা এবং বেসরকারি হাসপাতালগুলো চিকিৎসার জন্য ২ লাখ টাকা পর্যন্ত নিয়ে থাকে। এই মাত্রাতিরিক্ত খরচ সত্ত্বেও ৬০ শতাংশেরও বেশি পরিবার বেসরকারি হাসপাতালগুলো থেকে স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণ করে থাকে।

বাংলাদেশে বর্তমানে ক্যান্সার নির্ণয়ের জন্য সক্ষমতা প্রতিষ্ঠা করার জন্য প্রয়োজনীয় জনবল নিয়োগ, প্রশিক্ষণ, স্থিতিশীল পরীক্ষাগারের ধারণক্ষমতা নিশ্চিত করা, প্রচলিত এবং আণবিক প্রযুক্তির প্রয়োগ এবং সমন্বয় করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, বাংলাদেশের বেশিরভাগ অঞ্চলে এই চাহিদাগুলো পূরণ করা সম্ভব হয়নি। এছাড়াও প্রয়োজনীয় স্থায়ী পরীক্ষাগার স্থাপনের জন্য রাজনৈতিক বা সামাজিক স্থিতিশীলতার অভাব এবং জটিল ক্যান্সার সনাক্তকরণ তথ্য বিশ্লেষণের এবং সমন্বয়ের ক্ষেত্রে অবকাঠামোগত অপ্রতুলতার জন্য বাংলাদেশ এখনো পিছিয়ে আছে। সামগ্রিকভাবে একটি স্মার্টফোন-ভিত্তিক অ্যাপ্লিকেশন, ওয়্যারলেস প্রযুক্তি নিয়মিত স্ক্রিনিং এবং সাশ্রয়ীমূল্যে দ্বিতীয় মতামতের বিকল্প সুবিধা সহজে নিশ্চিত করতে পারলে একই সাথে ক্যান্সার রুগীদের ক্লিনিকাল লক্ষণগুলোর এবং রেডিওথেরাপি পরিচালনার সূচক হিসেবে তাৎক্ষণিকভাবে ব্যবহার করা যাবে।

মূলত, ক্যান্সার চিকিৎসার ক্ষেত্রে এখন পর্যন্ত সরাসরি ও কার্যকর কোন প্রতিষেধক এখন পর্যন্ত আবিষ্কার হয়নি। তাই বিকল্প পন্থায় এই রোগের চিকিৎসা চালাতে হয়। আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞান ক্যান্সার চিকিৎসায় যতটুকু সাফল্য অর্জন করতে পেরেছে আমাদের দেশের আর্থ-সামাজিক পেক্ষাপটে তাও আমরা পুরোপুরি কাজে লাগাতে পারছি না। ক্যান্সার সনাক্তকরণ ও তা প্রতিরোধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য ‘জাতীয় ক্যান্সার নিবন্ধন’ জরুরি হলেও একাজে আমরা তেমন সাফল্য দেখাতে পারিনি। আমাদের দেশে ক্যান্সার রুগীর সংখ্যা উদ্বেগজনক পর্যায়ে পৌঁছলে বিপুল সংখ্যক রোগীর জন্য সুচিকিৎসার ব্যবস্থা নেই, নেই সর্বাধুনিক সনাক্তকরণ উপকরণ ও প্রযুক্তি। হাসপাতালে নেই পর্যপ্ত শয্যার ব্যবস্থা। এমতাবস্থায় দেশের বিপুল সংখ্যক ক্যান্সার রোগীর সুচিকিৎসা ও আগাম প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য সরকারকে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের জন্য পর্যাপ্ত বরাদ্দ দেয়া দরকার। একই সাথে দরকার প্রয়োজনীয় গণসচেতনাতও। অন্যথায় এই রোগের বিস্তার রোধ করা কোনভাবেই সম্ভব হবে না।

https://www.dailysangram.info/post/548438