১৪ মে ২০১৭, রবিবার, ৯:০৬

বিতর্কিত ইভিএম ফের আলোচনায়

রাজনৈতিক দল ও সরকার চাইলে সংসদ নির্বাচনে ইভিএম : সিইসি ; ইভিএম আবার সামনে নিয়ে আসা দুরভিসন্ধিমূলক : বিএনপি ; ইভিএম থেকে সরে আসছে উন্নত দেশগুলো

চার বছর আগে নানা সীমাবদ্ধতার কারণে সমালোচিত ও বিতর্কিত হয়ে বিদায় হওয়ার পর আবারও আলোচনায় এসেছে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম)। ই-ভোটিংয়ে নতুন করে নড়েচড়ে বসেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। যদিও এর আগে গত ১৩ এপ্রিল কমিশন সচিব বলেছিলেন, বড় নির্বাচনে ইভিএম কিংবা ডিভিএম প্রযুক্তি ব্যবহার করার মতো উপযোগী পরিবেশ দেশে এখনো তৈরি হয়নি। নির্বাচনের রোডম্যাপ নিয়ে বৈঠকে এ বিষয়ে সিইসিসহ অন্যরা আপত্তি জানিয়েছিলেন।
এ দিকে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার নিয়ে পুরোপুরি বিপরীত মেরুতে রয়েছে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি। নির্বাচনে ইভিএম বিষয়ে সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, মানুষের ভোটাধিকার নিশ্চিত করতে সংসদ নির্বাচনে ই-ভোটিং বিবেচনায় নেয়া যেতে পারে। এই বক্তব্যের বিরোধিতা করে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, মতায় থাকা নিশ্চিত করতে নির্বাচনে সরকার ই-ভোটিং রাখতে চায়, যা দুরভিসন্ধিমূলক। সম্প্রতি এমপিদের এক প্রশিণ অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীতনয় সজীব ওয়াজেদ জয় বলেছেন, আগামী একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ইভিএমে করা যেতে পারে। তবে ইভিএম নিয়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির চলমান বিতর্কের মধ্যে কোনো পে অবস্থান না নিয়ে কৌশলী পথে এগোচ্ছে কমিশন। সিইসি বলেছেন, রাজনৈতিক দল ও সরকার চাইলে সংসদ নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার করা হবে।
২০১০ সালে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের একটি ওয়ার্ডে ভোট গ্রহণের মাধ্যমে বাংলাদেশে ইভিএমের যাত্রা শুরু হয়। ২০১৩ সালের ১৫ জুন অনুষ্ঠিত রাজশাহী সিটি করপোরেশনের টিচার্স ট্রেনিং কলেজ কেন্দ্রে ভোট গ্রহণের সময় ইভিএম বন্ধ হয়ে যায়। তার পরে এটি সারানো আর সম্ভব হয়নি। ফলে ওই কেন্দ্রে পুনরায় ভোট গ্রহণ করতে বাধ্য হয় নির্বাচন কমিশন। এসব সমস্যা চিহ্নিত করতে নির্মাতাপ্রতিষ্ঠান বুয়েটকে একাধিকবার অনুরোধ করা হলেও তারা সমস্যা চিহ্নিত করেনি, বরং ইসি চুক্তি লঙ্ঘন করেছে বলে অভিযোগ তোলে বুয়েট। পরে ইসি বুয়েটকে ইভিএম ফেরত দিতে বলে। এখন পর্যন্ত তারা ইভিএম ফেরত দেননি। এর পর আবারো আলোচনায় এসেছে ইভিএম।
ইভিএম নিয়ে সদ্যবিদায়ী কমিশনে মতবিরোধ তৈরি হয়। নির্বাচন কমিশনার আবদুল মোবারক সিইসির কাছে এক ইউও (আনঅফিশিয়াল) নোটে লেখেন, কমিশনে যে ইভিএম রয়েছে তাতে ভোট সংখ্যার কাগজ রেকর্ডের ব্যবস্থা নেই; ভোটারের পরিচিতি শনাক্তকরণেরও ব্যবস্থা নেই। ফলে এ যন্ত্র দিয়ে ভোটে কারচুপি রোধ করা সম্ভব নয়। এ নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার পর বিদায়ী কমিশন শেষ দিকে এসে ইভিএম নিয়ে নতুন করে তৎপরতা শুরু করে। যান্ত্রিক ত্রুটিমুক্ত অধিকতর নিরাপদ ইভিএম তৈরি করতে উচ্চপর্যায়ে টেকনিক্যাল কমিটি গঠন করা হয়।
রাজনৈতিক দল ও সরকার চাইলে সংসদ নির্বাচনে ইভিএম : সিইসি
রাজনৈতিক দল ও সরকার চাইলে একাদশ সংসদ নির্বাচনে ইভিএমে ভোট নেয়া সম্ভব বলে মনে করেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নুরুল হুদা। গত বৃহস্পতিবার নির্বাচন কমিশন ও রিপোর্টার্স ফোরাম ফর ইলেকশন অ্যান্ড ডেমোক্র্যাসির (আরএফইডি) পরিচিতি অনুষ্ঠানে তিনি এ কথা বলেন। তিনি বলেন, ইভিএম বা যে নামেই হোক না কেন, প্রযুক্তিটি সবার কাছে আগে গ্রহণযোগ্য হতে হবে। ইভিএম নিয়ে আমাদের ভাবনা এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে। পরীামূলকভাবে ব্যবহারের পর রাজনৈতিক দলসহ সবার কাছে বিশ্বাসযোগ্যতা পেলেই ইভিএম ব্যবহার করা যাবে।
এক প্রশ্নের জবাবে সিইসি বলেন, স্বল্প সময়ের মধ্যে (ইমিডিয়েটলি) ইভিএম ব্যবহার করার সুযোগ নেই। ছোট ছোট নির্বাচনে পরীক্ষামূলক ব্যবহার করে বুঝতে হবে বড় নির্বাচনে ব্যবহার করা যাবে কি না। তার আগে রাজনৈতিক দলগুলো এটা চায় কি না জানতে হবে। আমরা কারো ওপর এটা চাপিয়ে দিতে চাই না।
ইভিএম আবার সামনে নিয়ে আসা দুরভিসন্ধিমূলক : বিএনপি
ইভিএম নিয়ে আগের দিন প্রধান নির্বাচন কমিশনারের বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় গত শুক্রবার সকালে এক সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, দুই দিন আগে প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা ও প্রধানমন্ত্রীতনয় বলেছেন, আগামী সংসদ নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার করা হবে। বৃহস্পতিবার প্রধান নির্বাচন কমিশনারের বক্তব্য সেটিরই প্রতিধ্বনি মনে হয়েছে। নির্বাচন কমিশনের বক্তব্য সরকারের ইচ্ছারই প্রতিফলন। আমরা মনে করি, ইভিএম বিষয়টি নির্বাচন কমিশন আবার সামনে নিয়ে আসা দুরভিসন্ধিমূলক।
ইভিএম পদ্ধতিকে ‘ত্রুটিপূর্ণ’ বর্ণনা করে রুহুল কবির রিজভী বলেন, সরকারের জনপ্রিয়তা এখন শূন্যের কোঠায় নেমে গেছে, সেজন্যই প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা ভোট কারচুপির জন্য বিষয়টি সামনে নিয়ে এসেছেন কি না, এটা এখন মানুষের মধ্যে বড় ধরনের প্রশ্ন হিসেবে দেখা দিয়েছে।
ইভিএম থেকে সরে আসছে উন্নত দেশগুলো
পৃথিবীর শতকরা ৯০ ভাগ দেশে ই-ভোটিং পদ্ধতি নেই। যে কয়েকটি দেশ এটি চালু করেছিল, তারাও এখন এটি নিষিদ্ধ করেছে। ২০০৬ সালে আয়ারল্যান্ড ই-ভোটিং পরিত্যাগ করে। ২০০৯ সালের মার্চ মাসে জার্মানির ফেডারেল ভোট ইভিএমকে অসাংবিধানিক ঘোষণা দেয়। ২০০৯ সালে ফিনল্যান্ডের সুপ্রিম কোর্ট ইভিএমে সম্পন্ন তিনটি মিউনিসিপ্যাল নির্বাচনের ফলাফল অগ্রহণযোগ্য বলে ঘোষণা করে। ড. অ্যালেক্স হালডারমেন নামে এক প্রযুক্তিবিশেষজ্ঞ ক্যালিফোর্নিয়া অঙ্গরাজ্যে ইভিএমের ওপর গবেষণা করে প্রমাণ পেয়েছিলেন, আমেরিকায় ইভিএম কারচুপির প্রতিরোধক (টেম্পার প্রুফ) নয়। ফলে ক্যালিফোর্নিয়া অঙ্গরাজ্যেও ইভিএম ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়। আমেরিকার ২২টির বেশি অঙ্গরাজ্যে এটিকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে এবং বাকিগুলোতেও তা নিষিদ্ধ হওয়ার পথে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, জালিয়াতির সুযোগ থাকায় এতে এক চাপে ৫০টি ভোট দেয়া সম্ভব। বিদেশের মাটিতে বসেও ইভিএম হ্যাকিং করা যায় এবং একটি ইভিএম হ্যাকিং করতে এক মিনিটের বেশি সময় লাগে না।
সুশাসনের জন্য নাগরিকÑ সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, কোনো প্রযুক্তি গ্রহণের আগে তার ভালো-মন্দ খতিয়ে দেখা উচিত। আর নির্বাচনের অন্যতম স্টেক হোল্ডার হচ্ছে রাজনৈতিক দলগুলো। যে প্রযুক্তিই গ্রহণ করা হোক না কেন তা রাজনৈতিক দলগুলোকে আস্থায় নিয়ে করা উচিত।
সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জে. (অব:) এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ছোট পরিসরের নির্বাচনে ইভিএম যৌক্তিক। সংসদ নির্বাচনের মতো মতা বদলের নির্বাচনে এই প্রযুক্তি ব্যবহারের সমতা এখনো অর্জন করতে পারেনি কমিশন নির্বাচন। কারণ স্বয়ং ইভিএম উদ্ভাবনকারী দেশগুলোও এই প্রযুক্তি থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে।

 

www.dailynayadiganta.com/detail/news/219807