৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, শুক্রবার, ১১:৪৯

সাড়ে তিন মাসে কারাগারে বিএনপি জামায়াতের ১৪ নেতাকর্মীর মৃত্যু

কারা হেফাজতে বাড়ছে মৃত্যু। ‘সুচিকিৎসা’ না দেয়ার অভিযোগে এই মৃত্যু বাড়ছে বলে স্বজনদের অভিযোগ। কারা হেফাজতে মৃত্যুর পরিসংখ্যানে সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীর সংখ্যাও কম নয়। ফলে উদ্বেগ বাড়ছে স্বজনদের মাঝে। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি ও বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, গত অক্টোবর মাসের পর থেকে তাঁদের নেতাকর্মীদের মৃত্যুর সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। গত সাড়ে তিন মাসে কারাবন্দী অবস্থায় মারা গেছেন বিএনপির ১৩ নেতাকর্মী। আর বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর মারা গেছেন একজন। সব মিলে বিএনপি-জামায়াতের ১৪ জন নেতাকর্মী কারাগারে থাকাবস্থায় মারা গেছেন। কারাগারে যথাযথ চিকিৎসার ব্যবস্থা না করায় একের পর এক মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে বলে দাবি বিএনপি-জামায়াত ও নিহতদের পরিবারের। তবে যে কোনো বন্দী অসুস্থ হলে দ্রুত চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয় বলে জানিয়েছে কারা কর্তৃপক্ষ।

সর্বশেষ, গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে রংপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে মনোয়ারুল ইসলাম নামে এক বিএনপি নেতার মৃত্যু হয়েছে। জেল সুপার প্রশান্ত কুমার বণিক জানান, গতকাল সকালে অসুস্থ হয়ে তার মৃত্যু হয়।

জানা গেছে, সরকারের পদত্যাগ দাবিতে আন্দোলন কর্মসূচি পালন করতে গিয়ে দল ও অঙ্গ বা সহযোগী সংগঠনের যেসব নেতাকর্মী নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন,তাদের তালিকা করছে বিএনপি-জামায়াত। দলগুলোর অভিযোগ, মূলত ২০২৩ সালের ২৮ অক্টোবর ঢাকায় মহাসমাবেশ, হরতাল, অবরোধসহ একদফা আন্দোলনের কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে পুলিশ ও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের হামলায় অসংখ্য নেতাকর্মী হতাহত ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
কারাগারে বন্দী বিএনপি-জামায়াতের নেতাকর্মীদের স্বজনদের অভিযোগ, গ্রেফতারের পর অনেকের সঙ্গে চরম অমানবিক আচরণ করা হয়েছে। কারাগারে কেউ অসুস্থ হলে তাকে প্রয়োজনীয় চিকিৎসাও দেওয়া হয় না। বিনা চিকিৎসায় এবং অবহেলায় অনেকেই মারা গেছেন। কেউ কেউ গুরুতর অসুস্থ হয়ে কারাগারেই ধুঁকছেন। এসব কারণে কারাবন্দী অনেক নেতার পরিবারের সদস্যরা উদ্বিগ্ন বলে অভিযোগে প্রকাশ।

সাড়ে ৩ মাসে মারা গেছেন ১৪ জন: বিএনপির কেন্দ্রীয় দফতরের তথ্য অনুযায়ী গতকাল বৃহস্পতিবার পর্যন্ত কারাগারে তাদের ১৩ নেতাকর্মীর মৃত্যু হয়েছে। সর্বশেষ গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে রংপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে মনোয়ারুল ইসলাম নামে এক বিএনপি নেতার মৃত্যু হয়েছে। এর আগে ২৮ জানুয়ারি রাতে সাতক্ষীরার কলারোয়া উপজেলা বিএনপির সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক আব্দুস সাত্তার জেলা কারাগারে মারা গেছেন। বিএনপির দাবি, মিথ্যা মামলায় দীর্ঘদিন ধরে কারাগারের ভেতরে পুলিশি নির্যাতনে অসুস্থ হলে ওইদিন রাত ৮টা ২০ মিনিটে তিনি মারা যান।

এ ছাড়া গত বছরের ১ নবেম্বর গ্রেপ্তারের সময় মারা যান কুমিল্লার বুড়িচং উপজেলার মোকাম ইউনিয়ন স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি মো. জাকির হোসেন। ২৬ অক্টোবর চট্টগ্রাম মহানগরের চাঁদগাঁও থানার ৫ নং মোহরা ওয়ার্ড বিএনপির সহসভাপতি গোলাপুর রহমানকে (গোলাপ কন্ডাক্টর) ঢাকায় বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরে ২৫ নবেম্বর তিনি কারাগারে মারা যান। ২৪ নবেম্বর ঢাকা মহানগর দক্ষিণের ৩৯ নং ওয়ার্ড বিএনপি নেতা ইমতিয়াজ আহমেদ বুলবুলকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে। ৩০ নবেম্বর তিনি অসুস্থ হয়ে পড়লে কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। এই নেতাকে অসুস্থ অবস্থায় গ্রেপ্তার করা হয়েছিল বলে দাবি তার পরিবারের।

গত বছরের ২৮ অক্টোবর ঢাকায় মহাসমাবেশ শেষে গাজীপুরের শ্রীপুর রেলস্টেশন এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয় কাওরাইদ ইউনিয়ন বিএনপি নেতা আসাদুজ্জামান খান হিরোকে। ১ ডিসেম্বর কাশিমপুর কারাগারে তার মৃত্যু হয়। ১১ ডিসেম্বর রাজশাহী কারাগারে অসুস্থ হয়ে মৃত্যুবরণ করেন রাজশাহী পৌরসভার ৬ নং ওয়ার্ড বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক মনিরুল ইসলাম (৫২)।

বিএনপি মিডিয়া সেলের ডিজিটাল বিভাগের মাহবুব মানিককে গত ৩০ অক্টোবর বিএনপি চেয়ারপারসনের গুলশান কার্যালয় থেকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। পরে গুরুতর অসুস্থ হলে ২০ নবেম্বর তিনি মুক্তি পান। এরপর গত ১৫ ডিসেম্বর তিনি মারা যান। নওগাঁর নজিরপুর পৌরসভার ২ নং ওয়ার্ড বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক মতিবুল ম-লকে গত ২৭ নবেম্বর গ্রেপ্তার করে পুলিশ। পরে অসুস্থ হয়ে ২০ ডিসেম্বর তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

এ ছাড়া গাজীপুরের কাপাসিয়ার দুর্গাপুর ইউনিয়নের ২ নং ওয়ার্ড বিএনপির সভাপতি মো. শফিউদ্দিন মাস্টারকে গত ২৬ অক্টোবর গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তিনি অসুস্থ হয়ে ২৫ ডিসেম্বর মারা যান। মুগদা থানা শ্রমিক দলের যুগ্ম আহ্বায়ক মো. ফজলুর রহমান কাজলকে গত ২৬ অক্টোবর গ্রেপ্তার করা হয়। গত ২৬ ডিসেম্বর কারাগারে অসুস্থ হয়ে পড়লে কাশিমপুর কারা কর্তৃপক্ষ কাজলকে হৃদরোগ হাসপাতালে ভর্তি করে। সেখানে তার মৃত্যু হয়। খুলনা মহানগর মুক্তিযোদ্ধা প্রজন্ম দলের সহ-সাধারণ সম্পাদক মো. কামাল হোসেন মিজান দীর্ঘদিন কারাগারে থাকা অবস্থায় চলতি বছরের ৩ জানুয়ারি বাগেরহাট জেলা কারাগারে মৃত্যুবরণ করেন। ঢাকার দোহার উপজেলার মাহমুদপুর ইউনিয়ন বিএনপির সহসভাপতি মো. হারুন মেম্বারকে গত ২০ নভেম্বর গ্রেপ্তার করে পুলিশ। অসুস্থ অবস্থায় তিনি ২৪ ডিসেম্বর জামিনে মুক্ত হন। এরপর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় গত ১৫ জানুয়ারি মারা যান হারুন।

জামায়াত নেতার মৃত্যু : রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর এক নেতা মারা গেছেন। ৩০ ডিসেম্বর শনিবার সকাল ৭টা ৪০ মিনিটের দিকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তিনি মারা যান। তাঁর নাম আবদুল লতিফ (৬৬)। তিনি পবা উপজেলার হরিপুর এলাকার বাহার আলীর ছেলে। তিনি রাজশাহী নগরের দামকুড়া থানা জামায়াতের আমীর ছিলেন।

রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগার সূত্রে জানানো হয়, নাশকতা ও বিস্ফোরক মামলায় ১৮ ডিসেম্বর থেকে আবদুল লতিফ কেন্দ্রীয় কারাগারে ছিলেন। সেখানে অসুস্থ হয়ে পড়লে ২৯ ডিসেম্বর তাঁকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পরে ৩০ ডিসেম্বর সকালে তিনি মারা যান।

কারাগারে একজন কর্মকর্তা নাম না প্রকাশ করার শর্তে তখন গণমাধ্যমকে জানান, ২৯ ডিসেম্বর শুক্রবার অসুস্থ হয়ে পড়লে আবদুল লতিফকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পরে শনিবার সকালে সেখানে তিনি চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। মৃত্যু সনদে উচ্চ রক্তচাপে মৃত্যুর কারণ উল্লেখ করা আছে।

এ মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করে মহানগর জামায়াতে ইসলামীর প্রচার সহকারী মো. আফজাল হোসেন গণমাধ্যমে বিজ্ঞপ্তি পাঠিয়েছেন। এতে অভিযোগ করা হয়, আবদুল লতিফকে পরোয়ানায় মসজিদে নামায আদায় শেষে বের হওয়ার সময় আটক করে পুলিশ। এরপর বিশেষ ক্ষমতা আইন ও বিস্ফোরক মামলায় দামকুড়া থানায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে ১৮ ডিসেম্বর কারাগারে পাঠানো হয়। কারাগারে যাওয়ার পর থেকে ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত হাজতি থাকায় তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। এতটা অসুস্থ হয়ে পড়েন যে বিছানায় প্রস্রাব-পায়খানা করতেন। এরপরও তাঁর সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়নি।

সর্বশেষ মৃত্যু, নির্যাতনের অভিযোগ স্বজনদের
রংপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে মনোয়ারুল ইসলাম নামে নাশকতা মামলার আসামী এক বিএনপি নেতার মৃত্যু হয়েছে। রংপুর কেন্দ্রীয় কারাগারের জেল সুপার প্রশান্ত কুমার বণিক জানান, গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে অসুস্থ হয়ে তার মৃত্যু হয়। তবে স্বজনদের অভিযোগ, গ্রেফতারের পর থানায় একদিন আটকে রেখে নির্যাতন করায় তার মৃত্যু হয়েছে। মনোয়ারুল ইসলাম রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলার লক্ষ্মিটারী ইউনিয়নের পশ্চিম চড়ইছলী গ্রামের ফজলে রহমানের ছেলে। তিনি ওই ইউনিয়ন বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক।

কারাগারের জেল সুপার জানান, চলতি বছরের ১৪ জানুয়ারি আসামী মনোয়ারুল ইসলামকে আদালতের নির্দেশে কারাগারে পাঠানো হয়। তখন থেকে তিনি কারাগারেই আটক ছিলেন। তার বিরুদ্ধে নাশকতাসহ বিভিন্ন অপরাধে তিনটি মামলা রয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে অসুস্থ হয়ে পড়ায় রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার পথেই তিনি মারা যান। তিনি আরও জানান, কারাগারে আটক থাকা অবস্থায় অসুস্থ হয়ে ২১ জানুয়ারি থেকে ২৩ জানুয়ারি তিন দিন কারাগারে অবস্থিত হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিল। সুস্থ হওয়ার পর তাকে আবারও কারাগারে নেওয়া হয়। তবে, কী কারণে মনোয়ারুল অসুস্থ হয়েছিলেন সে সম্পর্কে জেল সুপার কিছুই জানাতে পারেননি।
মনোয়ারুলের বাবা ফজলে রহমান, ছোট ভাই হারুনসহ স্বজনরা অভিযোগ করেছেন, ১৩ জানুয়ারি তাকে দিনের বেলায় বাসা থেকে পুলিশ গ্রেফতার করে থানায় নিয়ে যায়। এরপর সেইদিনই আদালতে চালান না দিয়ে পরের দিন রাত পর্যন্ত থানায় আটকে রেখে মারাত্মক নির্যাতন করা হয়। তার শরীরে পায়ে, পিঠে ও মাথায় আঘাতের চিহ্ন দেখা গেছে। এজন্য পুলিশি নির্যাতনেই মনোয়ারুল গুরুতর অসুস্থ হয়ে মারা গেছেন বলে মনে করছেন স্বজনরা। তারা এ ঘটনার নিরপেক্ষ তদন্ত ও বিচার দাবি করেন।

গঙ্গাচড়া উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক মাবু দাবি করেন, মৃত মনোয়ারুল ইসলাম বিএনপির একজন ডেডিকেটেড নেতা। বিএনপির প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামে সম্মুখ সারির সৈনিক ছিলেন তিনি। তাকে মিথ্যা মামলায় গ্রেফতার করা হয়েছিল। অন্যায়ভাবে তাকে থানায় আটকে রাখা হয়েছিল বলে স্বজনরা জানিয়েছেন।’

বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, ‘কারাগারের ভেতরে ও বাইরে বিরোধী দলের সক্রিয় নেতাকর্মীদের ওপর নানা অমানবিক আচরণ চলছে। কারাবন্দীদের নির্যাতন করা হচ্ছে অবর্ণনীয় ও পৈশাচিক কায়দায়। বন্দীদের চিকিৎসা না দিয়ে হত্যা করা হচ্ছে। অসুস্থ বন্দীকে হাত-পায়ে শিকল পরিয়ে কারা হাসপাতালে ফেলে রাখা হচ্ছে।’ তিনি বলেন, ‘দেশের ৬৮টি কারাগার একেকটি টর্চার সেল। গায়েবি মিথ্যা মামলায় সুস্থ সবল নেতাকর্মীদের ধরে নির্যাতন করে কারাগারে নিক্ষেপের পর লাশ বানিয়ে বের করা হচ্ছে। কারাগার থেকে বেরোচ্ছে লাশের সারি।’

তবে বিএনপির এই বক্তব্যকে রাজনৈতিক আখ্যা দিয়ে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার, কেরানীগঞ্জের সিনিয়র জেলসুপার সুভাষ কুমার ঘোষ বলেন, ‘বন্দীদের সঙ্গে কারাগারে সর্বোচ্চ মানবিক আচরণ করা হয়। কেউ অসুস্থ হলে ডাক্তারের পরামর্শে বিধি মোতাবেক কারাগারের ভেতরে ও বাইরে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়।’

সুচিকিৎসা না দেওয়ার অভিযোগ: বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল ও ঢাকা মহানগর উত্তরের সদস্য সচিব আমিনুল হকসহ কয়েকজন নেতা দীর্ঘদিন ধরে কাশিমপুর কারাগারে বন্দী আছেন। তাদের মধ্যে আলালের একটি কিডনি অকেজো। আরেকটির উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশ যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন চিকিৎসকরা। কিন্তু কারাগারে থাকায় সেই সুযোগ পাননি তিনি।
মোয়াজ্জেম হোসেন আলালের সহকারী জাহাঙ্গীর হোসেন গণমাধ্যমকে বলেন, ‘কিডনির গুরুতর সমস্যার কারণে তিনি (আলাল) প্রায়ই কারাগারে অসুস্থ হয়ে পড়েন। কিন্তু যথাযথ চিকিৎসা দেওয়া হয় না। শারীরিক অবস্থা বিবেচনায় তাকে মুক্ত করার জরুরি।’

জাতীয় ফুটবল দলের সাবেক অধিনায়ক বিএনপি নেতা আমিনুল হকেরও কিডনিতে পাথর ধরা পড়েছে। তার বড় ভাই মাইনুল হক গণমাধ্যমকে জানান, ‘সম্প্রতি হাতিরঝিল থানার মামলায় ডিবিতে রিমান্ডে থাকা অবস্থায় ব্যথা অনুভব করলে আমিনুলকে রাজারবাগে কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে শারীরিক বিভিন্ন পরীক্ষায় তার কিডনিতে পাথর ধরা পড়ে। প্রয়োজনীয় ওষুধ দিয়ে ব্যথা নিয়ন্ত্রণে রাখা হয়েছে। কিন্তু দ্রুত সময়ের মধ্যে সার্জারি না করালে বড় ধরনের স্বাস্থ্য ঝুঁকির আশঙ্কা রয়েছে।’ কারাগারে তাকে যথাযথ চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে না অভিযোগ তুলে অবিলম্বে আমিনুল হকের মুক্তি দাবি করেন তিনি।

কারা হেফাজতে বাড়ছে মৃত্যু: ২০২৩ সালের ১০ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৯৩ জন বন্দীর মৃত্যু হয়েছে কারা হেফাজতে। এর মধ্যে গত আগস্ট থেকে ১০ ডিসেম্বর পর্যন্ত সাত বিএনপি নেতা রয়েছেন। শুধু তাই নয়, গত ২৫ নভেম্বর থেকে ১ ডিসেম্বরের মধ্যে এক সপ্তাহের মধ্যে কারাগারে অসুস্থ হয়ে বিএনপির স্থানীয় পর্যায়ের তিন নেতা মারা যান। মানবাধিকার সংগঠনের সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। এসব মৃত্যুর বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও কারা কর্তৃপক্ষের বক্তব্য অভিন্ন হলেও, পরিবার ও বিএনপির নেতারা নির্যাতনের অভিযোগ তুলছেন।

বিভিন্ন দৈনিকে প্রকাশিত প্রতিবেদনের ভিত্তিতে মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) কারা হেফাজতে মৃত্যুর তথ্য দেয়। সংস্থাটি গত ১১ মাসের যে তথ্য দিয়েছে তাতে দেখা যায়, এ সময়ে ৯৩ জন আসামি কারা হেফাজতে মারা গেছেন। এর মধ্যে বিচার শেষের আগে ৫৩ ও সাজাপ্রাপ্ত বন্দীর সংখ্যা ৪০ জন। সবচেয়ে বেশি কারা হেফাজতে মৃত্যু ঘটেছে ঢাকা বিভাগের বিভিন্ন কারাগারে। এ সংখ্যা ৬২ জন (বিচারের শেষের আগে ৩৫ ও সাজাপ্রাপ্ত ২৭ জন)। আসকের হিসাবে ২০২২-এর ১২ মাসে কারা হেফাজতে ৬৫ জনের মৃত্যু হয়েছিল অসুস্থতায়। এর আগে ২০২১ সালে এমন মৃত্যুর সংখ্যা ছিল ৮১ জন। পর্যালোচনায় দেখা যাচ্ছে, ২০২২ সালের চেয়ে চলতি বছরের প্রথম ১১ মাসেই কারা হেফাজতে ২৮ জনের বেশি মৃত্যু হয়েছে। বিগত কয়েক মাসে রাজনৈতিক বিরোধের জেরে বিএনপি-জামায়াতের নেতাকর্মীরা বিভিন্ন মামলায় গ্রেপ্তার হচ্ছেন নিয়মিত। অনেকের সাজা হচ্ছে। এমনিতেই কয়েক বছর ধরে কারাগারগুলোতে ধারণক্ষমতার দ্বিগুণ বন্দী অবস্থান করছে। ‘রাজনৈতিক’ মামলায় গ্রেপ্তারের পর সেখানে বন্দীর সংখ্যা আরও বাড়ছে।

মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের (এইচআরপিবি) সভাপতি অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, ‘বাংলাদেশের জেলখানাগুলোতে মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন হয়। সেখানে মানুষের জীবনের ঝুঁকি এমনিতেই বাড়ে। প্রশ্ন হচ্ছে, কারাগারে যারা দায়িত্বে আছেন সরকারের বাইরে যাওয়ার ক্ষমতা তো তাদের নেই। সরকার যদি বলে কাউকে রাজার হালে রাখো, তারা রাখবে। আর যদি বলে কাউকে অবহেলা করো, তারা তাই করবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘হেফাজতে থাকার অর্থ হলো যিনি হেফাজতকারী তাদের দায়িত্ব নিতে হবে। এখন সেটি যদি সঠিকভাবে না হয় তাহলে আরও মানুষ মরবে। তবে সময় সুযোগে এসব ঘটনায় যদি তদন্ত কমিশন হয়, সে ক্ষেত্রে অনেক কিছু বেরিয়ে আসতে পারে।’

আসকের নির্বাহী পরিচালক ফারুখ ফয়সল সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, ‘সম্প্রতি বেশ কয়েকজন রাজনৈতিক নেতার মৃত্যু হয়েছে। যাদের আসলে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণেই গ্রেপ্তার করা হয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘রিমান্ড বা জেলখানার ভেতরে কী হয় তা আমরা সরাসরি না দেখলেও অনুধাবন করতে পারি। কারাগারে যথেষ্ট জায়গা নেই। সুব্যবস্থাও নেই। এ ছাড়া আঘাত বা নির্যাতন করা এগুলো তো আছেই। সব মিলিয়ে কারাগারে অমানবিক পরিবেশে বাস করছে বন্দীরা। কিন্তু এমন পরিবেশে বন্দীরা নিয়মিত মারা গেলেও, কাউকে কখনো জবাবদিহি করতে হয় না।’

https://www.dailysangram.info/post/548374