৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, বৃহস্পতিবার, ৩:৫৯

এডিবি বাস্তবায়ন

শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতের বেহাল অবস্থা

এমনিতেই জাতীয় বাজেটে জিডিপি অনুপাতে স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতে বরাদ্দ কম থাকে। অথচ যেটুকু বরাদ্দ দেয়া হয় তাও পুরোপুরি খরচ করতে পারে না এই দুই খাত। প্রতি অর্থবছরে বরাদ্দের বড় একটি অংশ ফিরিয়ে দেয়া যেন রেওয়াজে পরিণত হয়েছে। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দের মাত্র ১৬ দশমিক ৩১ শতাংশ অর্থ বাস্তবায়ন হয়েছে। অন্যদিকে শিক্ষা খাতে বাস্তবায়ন হয়েছে ১৭ দশমিক ৯৮ শতাংশ।

স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতের কর্মকর্তা ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দুর্বল ব্যবস্থাপনা, অদক্ষ জনশক্তি, ব্যয়ভীতির কারণে প্রতিবছর বরাদ্দের বড় অংশ ফেরত যাচ্ছে। অডিটের আশঙ্কায় ব্যয় কমিয়ে রাখা হয়। অডিটে অনিয়ম ধরা পড়লে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার পেনশন বন্ধ হওয়া এবং দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) মামলার মতো শাস্তিমূলক ব্যবস্থার নিয়ম রয়েছে। যাতে চাকরি হারানোরও ভয় রয়েছে। এ ছাড়া ঘনঘন প্রকল্প পরিচালক পরিবর্তনের কারণে প্রকল্পে ধীরগতি হয়। এসব কারণে গুরুত্বপূর্ণ এই দুই খাত শতভাগ এডিপি বাস্তবায়ন করতে পারছে না।

চলতি (২০২৩-২৪) অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) বরাদ্দের ২০ শতাংশও খরচ হয়নি স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতে।

যার কারণে বরাদ্দ বাস্তবায়নের হার সবচেয়ে খারাপ এমন মন্ত্রণালয়গুলোর মধ্যে রয়েছে স্বাস্থ্য ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়। আইএমইডি’র প্রতিবেদন বলছে, ৬ মাসে স্বাস্থ্য সেবা বিভাগ ১৪ দশমিক ৯৯ শতাংশ এবং স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও পরিবারকল্যাণ বিভাগ মাত্র ৮ দশমিক ৮২ শতাংশ অর্থ বাস্তবায়ন করতে পেরেছে। সবমিলিয়ে স্বাস্থ্য খাতের অগ্রগতি ১৬ দশমিক ৩১ শতাংশ। অন্যদিকে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ ১১ দশমিক ৬৪ শতাংশ, কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগ ২২ দশমিক ৬৪ শতাংশ এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় ১৯ দশমিক ৬৭ শতাংশ অর্থ বাস্তবায়ন করতে পেরেছে। সবমিলিয়ে শিক্ষা খাতের অগ্রগতি ১৭ দশমিক ৯৮ শতাংশ।

এদিকে আইএমইডি’র তথ্য অনুযায়ী প্রতিবছরই বরাদ্দের একটি বড় অংশ খরচ করতে পারে না স্বাস্থ্য খাত। ২০২২-২৩ অর্থবছরে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ প্রায় ৩২ শতাংশ খরচ অব্যবহৃত থাকে। এই অর্থবছরে বরাদ্দ ছিল ৯ হাজার ৮০৩ কোটি টাকা, আর খরচ হয়েছিল ৬ হাজার ৬৮৫ কোটি টাকা। এ ছাড়া ২০২২-২৩ অর্থবছরে স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগে বরাদ্দ ছিল ২ হাজার ৩৯৫ কোটি টাকা, যার মধ্যে খরচ হয়েছিল ১ হাজার ৬৬৪ কোটি টাকা। অর্থাৎ এই অর্থবছরে ৩১ শতাংশ অর্থ খরচ করতে পারেনি এই বিভাগ। অন্যদিকে ২০২১-২২ অর্থবছরে স্বাস্থ্য বিভাগ বরাদ্দের ২৯ শতাংশ অর্থ অব্যবহৃত ছিল। এই অর্থবছরে এই খাতে বরাদ্দ ছিল ১৩ হাজার ১৭ কোটি টাকা, যার মধ্যে খরচ হয়েছিল ১০ হাজার ২৯২ কোটি টাকা। আর ২০২১-২২ অর্থবছরে স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও পরিবারকল্যাণ বিভাগে বরাদ্দ থাকা ২ হাজার ৮০ কোটি টাকার মধ্যে খরচ হয়েছিল ১ হাজার ৫৫৩ কোটি টাকা। অর্থাৎ এই অর্থবছরে ২৬ শতাংশ অর্থ ফেরত যায়। একইভাবে ২০২০-২১ অর্থবছরে বাজেটে বরাদ্দের প্রায় ৪২ শতাংশ ফেরত যায়। এ অর্থবছরে বরাদ্দ ছিল ১২ হাজার ৯৮৯ কোটি টাকা। সে সময় ৬ হাজার ৯৩৩ কোটি টাকা ব্যয় হয়। অন্যদিকে এই অর্থবছরে স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগে বরাদ্দ ছিল ১ হাজার ৮৮৫ কোটি টাকা, যার মধ্যে খরচ হয়েছিল ১ হাজার ৫৫০ কোটি টাকা। অর্থাৎ বরাদ্দের ১৭ দশমিক ৮০ শতাংশ টাকা অব্যবহৃত থাকে।
স্বাস্থ্য খাতে প্রকল্প বাস্তবায়নে এই করুণদশার কারণ জানতে চাইলে স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা মানবজমিনকে বলেন, থোক বরাদ্দের ক্ষেত্রে এখন অর্থ মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন লাগে। যেটি আগে ছিল না। অনেক সময় অনুমোদন পেতে সময় লাগে। এক্ষেত্রে প্রকল্প বাস্তবায়নেও ধীরগতি দেখা যায়। অর্থাৎ অর্থ বরাদ্দের একটি জটিলতা আছে। তিনি বলেন, ব্যয়ভীতির কারণেও এডিপি কম বাস্তবায়ন হচ্ছে। অনেক সময় অডিটের আশঙ্কায় ব্যয় কমিয়ে রাখা হয়। এছাড়া ঘন ঘন প্রকল্প পরিচালক পরিবর্তন করা হয়ে থাকে। এতে প্রকল্প সম্পর্কে বুঝতেই অনেক সময় লেগে যায়। আর প্রকিউরমেন্টে স্বচ্ছতা আনতে অনেক সময় দেরি হয়ে যায়। এসব কারণে এডিপি বাস্তবায়নে ধীরগতি হয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য ও অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক শারমিন মবিন ভূঁইয়া বলেন, বরাদ্দের অর্থব্যয় করার জন্য যেই সময় দেয়া হয় সেটি যথেষ্ট না। এ ছাড়া অনেক সময় টাকা ছাড় দিতেও দেরি হয়। চাকরির সমস্যা হবে ভেবে অনেকে আবার বেশি টাকা খরচ করতে চায় না। পুরো পদ্ধতিতেই সমস্যা আছে জানিয়ে তিনি ডিজিটাল পদ্ধতির উপর জোর দিতে বলেন।

ওদিকে এডিপি বাস্তবায়নে পিছিয়ে শিক্ষা খাতও। প্রতি বছরই এই খাতে বরাদ্দের একটি বড় অংশ ফিরিয়ে দেয়া হয়। আইএমইডি’র তথ্য অনুযায়ী, ২০২২-২৩ অর্থবছরে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ বরাদ্দের ২৮ দশমিক ৬০ শতাংশ, কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগ বরাদ্দের ২৯ দশমিক ৭০ শতাংশ এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় ১৭ দশমিক ৫৫ শতাংশ অব্যবহৃত থাকে। অন্যদিকে ২০২১-২২ অর্থবছরে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগ বরাদ্দের ২৮ দশমিক ৬৩ শতাংশ, কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগ বরাদ্দের ১১ দশমিক ১৩ শতাংশ এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় ২৩ দশমিক ৬১ শতাংশ অব্যবহৃত থাকে। এ ছাড়া ২০২০-২১ অর্থবছরে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগ বরাদ্দের ১৬ দশমিক ৫৬ শতাংশ, কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগ বরাদ্দের ১৮ দশমিক ৭৬ শতাংশ এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় ১৮ দশমিক ১৮ শতাংশ অব্যবহৃত থাকে।

https://mzamin.com/news.php?news=96797