৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, বৃহস্পতিবার, ৩:৫২

৬ মাসে ঋণের সুদ মওকুফ ৭০০ কোটি টাকা

৪ রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকেরই ১৫৭ কোটি টাকা

ছয় মাসে চার রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকসহ বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর ঋণের সুদ মওকুফ করেছে প্রায় ৭০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে ১৫০ কোটি টাকাই চার রাষ্ট্রাত্ত ব্যাংকের। বাকি প্রায় ৫৫০ কোটি টাকা বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংক ও বিদেশী ব্যাংকের। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, ব্যাংকিং খাতে সুদ মওকুফের ঘটনা বেড়ে যাওয়ায় নিয়মিত ঋণ পরিশোধ করার প্রবণতা কমে যাচ্ছে। এতে বেড়ে যাচ্ছে খেলাপি ঋণের পরিমাণ। খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় কিছু ব্যাংকের আর্থিক ভিত্তি দুর্বল হয়ে পড়েছে। আর এ কারণেই কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে কিছু দুর্বল ব্যাংক সবল ব্যাংকের সাথে একীভূত করার উদ্যোগ নিয়েছে। এ জন্য একটি রোডম্যাপও হাতে নেয়া হয়েছে। কিভাবে একীভূত করা হবে তার নীতিমালাও তৈরি করা হচ্ছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছেন।

বিশ্লেষকদের মতে, রাজনৈতিক প্রভাবের কারণেই রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোতে হলমার্ক, বিসমিল্লাহ ও বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটেছে। আর নামে-বেনামে নানা প্রকার ঋণ নিচ্ছেন কিছু ব্যাংকের উদ্যোক্তারা। আর এর প্রভাবেই সুদ মওকুফ করা হচ্ছে, যা ব্যাংকিং শৃঙ্খলাপরিপন্থী। ব্যাংকের সুদ মওকুফ করায় এক দিকে যেমন ব্যাংকের আয় কমে যায়, পাশাপাশি নিয়মিত ঋণ পরিশোধ করেন এমন গ্রাহকদের ওপরও নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। এতে বেড়ে যায় ঋণ পরিশোধ না করার প্রবণতা। ঋণ পরিশোধের সংস্কৃতি থেকে বের হওয়া উচিত বলে তারা মনে করেন।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান মতে, ব্যাংক ভেদে সুদ মওকুফের দিক থেকে ছয় মাসে (এপ্রিল-সেপ্টেম্বর) ব্যাংকগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি সুদ মওকুফ রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোতে। ব্যাংকগুলো আলোচ্য ছয় মাসে ঋণের সুদ মওকুফ করেছে ১৫৭ কোটি টাকা। বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর সুদ মওকুফ করেছে ৪৮৫ কোটি টাকা। বিদেশী ব্যাংকগুলোতে সুদ মওকুফ হয়েছে প্রায় চার কোটি টাকা এবং বিশেষায়িত ব্যাংক সুদ মওকুফ করেছে ৪৬ কোটি টাকা।

জানা গেছে, সাধারণত দু’টি ক্ষেত্রে সুদ মওকুফ করা হয়। একটি হলো, দীর্ঘ দিন যাবত যেসব ঋণ পরিশোধ করা হয় না, এককালীন পরিশোধের শর্তে ওইসব ঋণের কিছু সুদ মওকুফ করা হয়। তবে, এ ক্ষেত্রে ব্যাংক যেন লোকসানের সম্মুখীন না হয়, অর্থাৎ মূল বিনিয়োগ ও ব্যয় যেন উঠে আসে সে দিকে খেয়াল রাখা হয়। অপর দিকে ঋণ পুনঃতফসিলের সময় কিছু সুদ মওকুফ করা হয়। এটা করার ফলে এক দিকে ব্যাংকের দীর্ঘ দিনের খেলাপি ঋণ আদায় হয়। এতে ওই ব্যাংকের বিনিয়োগ সক্ষমতা বেড়ে যায়। অপর দিকে আয়ও বাড়ে।

বিশ্লেষকরা জানিয়েছেন, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ঋণের সুদ মওকুফের ক্ষেত্রে যথাযথ নিয়ম অনুসরণ করা হয় না। বিশেষ করে সরকারি ব্যাংকগুলোতে রাজনৈতিক চাপ থাকে। রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে ব্যবসায়ীরা ঋণের সুদ মওকুফ করে নেন। যার প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় ব্যাংক। কেননা, ব্যাংক আমানতকারীদের সুদ ঠিকই পরিশোধ করতে হয়েছে। কিন্তু ঋণের সুদ আদায় না হওয়ায় বেড়ে গেছে ব্যয়। শুধু সুদ মওকুফের ক্ষেত্রেই রাজনৈতিক প্রভাব থাকে না, ঋণ বিতরণের ক্ষেত্রেও রাজনৈতিক চাপ থাকে। যেমন, ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে গ্রাহক ব্যাংকে যে জামানত দেয়, তা যথাযথ হয় না। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বন্ধকি জমি বা সম্পদ অতি মূল্যায়িত করা হয়।
চার ব্যাংকের কয়েকজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, বিভিন্ন মহল থেকে চাপ আশায় সরকারি মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোতে সুদ মওকুফ বেড়ে গেছে। এর ফলে ব্যাংকগুলোর আয়ও কমে যাচ্ছে।

রূপালী ব্যাংকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, অতীতের চেয়ে এখন ব্যবসায়ীদের রাজনৈতিক চাপ, স্বজনপ্রীতির ভিত্তিতে সরকারি এ চার ব্যাংকে সুদ মওকুফ বেড়ে গেছে। চাপও রয়েছে সুদ মওকুফ করার। এভাবে অনেকেই পার পেয়ে যাচ্ছেন। সুদ মওকুফ বেশি হওয়ায় ব্যাংকের আয়ও কমে যাচ্ছে।

একটি বেসরকারি ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী গতকাল নয়া দিগন্তকে জানিয়েছেন, সুদ মওকুফের চেয়ে ঋণের সুদ বা মুনাফা পরিশোধ করেন না এমন ব্যক্তির সংখ্যা অনেক বেশি। নানা ফাঁকফোকর দিয়ে তারা বছরের পর বছর পার পেয়ে যাচ্ছেন। প্রভাবশালী হওয়ায় আবার কেউ ব্যাংকের পরিচালক হওয়ায় ব্যাংকাররা এ ক্ষেত্রে অসহায় হয়ে পড়েছেন। কোনো ব্যবস্থাই গ্রহণ করতে পারছেন না। এতে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোর মূলধন কাঠামো দিন দিন দুর্বল হয়ে পড়ছে। এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অধিকতর তদারকি প্রয়োজন বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন।

https://www.dailynayadiganta.com/first-page/812486