৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, বুধবার, ৭:২৮

মশার দখলে রাজধানী

মশার যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ নগরবাসী। রাজধানীতে প্রতি দিনই আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ মশাবাহিত রোগে। ভিড় বেড়েছে হাসপাতালগুলোতে। মশা নিধনের নামে শত শত কোটি টাকা খরচ করা হচ্ছে। কিন্তু মশা নির্মূলের বদলে বংশ বিস্তার করেই যাচ্ছে। বিকেল হলেই রাজধানীর ডোবা, নালা-নর্দমায় কোটি কোটি মশা দেখা যায়। মশার যন্ত্রণা এত বেশি যে, কোনো কোনো এলাকায় দিনেও মশারি টানিয়ে ঘুমাতে হচ্ছে। অসুসন্ধানে দেখা যায় দুই সিটি করপোরেশন গত ১১ বছরে মশা মারতে প্রায় এক হাজার ৮০ কোটি টাকার বাজেট করেছে। অর্থাৎ প্রতি বছর দুই সিটির মশা নিধনে একশ’ কোটি করে টাকা খরচ করা হচ্ছে। কিন্তু রাজধানী ঢাকায় মশার উৎপাত নির্মূল করা যায়নি। প্রশ্ন হচ্ছে মশা নিধনের টাকা যায় কার পকেটে?

জানতে চাইলে প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক প্রফেসর ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহ বলেন, মশা নিয়ন্ত্রণ খুবই চ্যালেঞ্জিং একটি কাজ। মশা নিধন করতে হলে সিটি করপোরেশনের পাশাপাশি রাজউক, এয়ারপোর্ট, গৃহায়ন কর্তৃপক্ষকে তাদের নিজ নিজ জায়গা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। ড্রেনে এবং ময়লায় ডেঙ্গু মশার প্রজনন আসলে কম হয়। মশা নির্মূলে পরিকল্পিত পদক্ষেপ নিতে হবে।

এ বছর এডিস মশাবাহিত ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হয়ে সবচেয়ে বেশি রোগী মৃত্যুবরণ করেছে। হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়ে বাসায় ফিরেছেন অনেকে। এছাড়া ঢাকাবাসীর রয়েছে কিউলেক্স মশার আক্রমণের ঝুঁকি। ময়লা-আবর্জনায় ভরা খালে মশার উৎকৃষ্ট প্রজনন কেন্দ্র। খালগুলোতে মশার ব্যাপক বংশ বিস্তারের কারণে রাজধানীতে ডেঙ্গু ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। ডেঙ্গু রোগের বাহক এডিস মশা সম্পর্কে আগে বলা হতো, এ মশা শুধু দিনে কামরায়, রাতে নয়। আর এডিস মশা শুধু স্বচ্ছ পরিষ্কার পানিতে বংশ বিস্তার করে। তবে এ ধারণা এখন পাল্টে গেছে। এডিস মশার চরিত্রে পরিবর্তন এসেছে। সে এখন দিনে- রাতে সব সময়ই কামড়ায়। স্বচ্ছ-ঘোলা যেকোনো ধরনের জমানো পানিতেই এডিস মশা জন্ম নেয়। মশা নিধনে প্রতি বছরই বিপুল পরিমাণ অর্থ খরচ করেও দৃশ্যমান কোনো উপকার পাওয়া যাচ্ছে না। শুধু অর্থেরই অপচয় হচ্ছে। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন মশা নিধনে কাজ করলেও নগরবাসী এই মশার কামড় থেকে মুক্তি পাচ্ছে না। ঢাকা শহরে যে মশা রয়েছে, তার ৯৯ শতাংশ কিউলেক্স আর ১ শতাংশ এডিস। ডেঙ্গু রোগের জন্য দায়ী এডিস মশা। এই এডিস মশা নির্মূলে গত অর্থবছরে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) খরচ করেছে ১২০ কোটি টাকা। আর চলতি অর্থবছর ১৯৯ কোটি টাকা খরচের বাজেট করেছে। অথচ কোটি কোটি টাকা খরচ করলেও ডেঙ্গু না কমে বরং ছড়িয়ে পড়ছে।

রাজধানীতে গত চার মাসে কিউলেক্স মশার ঘনত্ব বেড়েছে। জানুয়ারিতে প্রতিদিন গড়ে তিনশ’র বেশি পূর্ণবয়স্ক মশা ফাঁদে ধরা পড়েছে। এর আগে গত অক্টোবর ও নভেম্বরে এ সংখ্যা ছিল দুইশ’র কম। এ ধারা চলতে থাকলে আগামী মার্চ মাস পর্যন্ত তা বেড়ে চরমে পৌঁছতে পারে। মার্চে ঢাকায় মশার উপদ্রব চরমে পৌঁছার শঙ্কা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের এক গবেষণায় এসব তথ্য উঠে এসেছে। গবেষণাটি পরিচালনা করছেন বিশ্ববিদ্যালয়টির প্রাণিবিদ্যা বিভাগের শিক্ষক ড. কবিরুল বাশার। তিনি বলেন, ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে আলাদা ব্যবস্থাপনা থাকা দরকার। মশা দুই ধরনের হয়। যখন সাধারণ মশার সঙ্গে ডেঙ্গুবাহী এডিস মশাকে মেশানো হবে, ততদিন দেশ থেকে ডেঙ্গু যাবে না। ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের জন্য আলাদা ব্যবস্থাপনা করা দরকার। সিটি করপোরেশনকে মশক নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি ভাগ করে ফেলতে হবে। সেখানে থাকবে ডেঙ্গু ম্যানেজমেন্ট ও কিউলেক্স ম্যানেজমেন্ট। ৪৩ শতাংশ ডেঙ্গুর প্রজনন হয় মাল্টিস্টেরয়েড বিল্ডিয়ের বেজমেন্টে। ২৩ শতাংশ ডেঙ্গুর প্রজনন হয় নির্মাণাধীন ভবনের বেজমেন্টে। মশা নিয়ন্ত্রণকে দু’ভাগে ভাগ করতে হবে। একটি হচ্ছে সিটি করপোরেশনের পার্ট, আরেকটি হচ্ছে জনগণের পার্ট। সিটি করপোরেশন দায় চাপায় জনগণের ওপর, আবার জনগণ দায় চাপায় সিটি করপোরেশনের ওপর। এ মুহূর্তে ঢাকায় ৯৯ শতাংশ কিউলেক্স মশা আছে, আর ১ শতাংশ এডিস মশা আছে। এই ১ শতাংশ এডিস মশাই জনস্বাস্থ্যে সমস্যা সৃষ্টি করে। এক শতাংশ মশাকে নিয়ন্ত্রণ করার উপায় কী, এই মশা কোথায় থাকে? অর্থাৎ টার্গেট স্পেসিফিক কন্ট্রোল মেজর ফর ডেঙ্গু অ্যান্ড কিউলেক্স। কিউলেক্স মশা ও ডেঙ্গু মশার নিয়ন্ত্রণে পদক্ষেপের বিষয়টি সম্পূর্ণ আলাদা করে ফেলতে হবে। আর এখানে জনগণকে সম্পৃক্ত করার কাজ সিটি করপোরেশনের।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ঢাকার খাল ভরাট ও বেদখলের ফলে পানিবদ্ধতা এবং পরিবেশ দূষণ বাড়ছে। ওয়াসার কাছ থেকে বুঝে নেয়ার পর সিটি করপোরেশন নিজস্ব ফান্ড থেকে অনেক খাল পরিষ্কার করে। কিন্তু সেসব খাল আবারও ময়লা-আবর্জনার ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকার খালগুলো রক্ষণাবেক্ষণ ও সৌন্দর্য বর্ধনের জন্য বিভিন্ন প্রকল্প গ্রহণ করছে সরকার। রাজধানীর ৪৬টি খালের মধ্যে ২০টিই বিলীন হয়ে গেছে। কাগজে-কলমে ২৬ খালের অস্তিত্ব পাওয়া গেলেও দখল ও দূষণে এগুলোও হারিয়ে যেতে বসেছে। খালগুলো রক্ষণাবেক্ষণ করতে ২০২০ সালের ৩১ ডিসেম্বর ঢাকা ওয়াসার কাছ থেকে দুই সিটি করপোরেশনের কাছে হস্তান্তর করে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়।

অসুসন্ধান করে দেখা যায়, নাগরিক সেবা বৃদ্ধির লক্ষ্যে ২০১২ সালে ঢাকা সিটি করপোরেশনকে দুই ভাগ করা হয়। দুই করপোরেশন মশা মারার নামে বিপুল পরিমাণ টাকা খরচ করেছে। দুই সিটি করপোরেশন গত ১১ বছরে মশা মারতে প্রায় এক হাজার ৮০ কোটি টাকার বাজেট করেছে। কিন্তু রাজধানী ঢাকায় মশার উৎপাত নির্মূল করা যায়নি। পৃথক হিসেবে দেখা যায় এই সময়ে মশা মারতে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) খরচ করেছে ৫৮৬ কোটি ৫২ লাখ টাকা। আর ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) খরচ করেছে ৪৯৩ কোটি ২৪ লাখ টাকা।

এই ১১ বছরে দুই সিটি করপোরেশনের মশা মারতে কীটনাশক ক্রয়ের পাশাপাশি ড্রেনে তেলাপিয়া মাছ, গাপ্পি মাছ, হাঁস, ব্যাঙ অবমুক্ত করে মশক নিধনের এবং ড্রোনের মাধ্যমে মশার উৎসস্থল চিহ্নিত করার চেষ্টা করেছে। অথচ কীটতত্ত্ববিদদের মতে, মাছ-ব্যাঙ-হাঁস মশা নিধন করতে পারে এর কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। এর আগেও তেলাপিয়া মাছ, গাপ্পি মাছ, হাঁস, ব্যাঙ অবমুক্ত করে মশক নিধনের এবং ড্রোনের মাধ্যমে মশার উৎসস্থল চিহ্নিত করার ঘোষণা দেন মেয়ররা। চলতি বছর স্কুলশিক্ষক, মসজিদের ইমাম ও মশককর্মীদের নিয়ে সভা করেছে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন। তা ছাড়া লিফলেট বিতরণ, মাইকিং, ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনাসহ নানা কর্মসূচিও বাস্তবায়ন করছে। কীটতত্ত্ববিদরা বলছেন, দেশে প্রাকৃতিক কারণে যেভাবে মশা বৃদ্ধি ও ডেঙ্গু সংক্রমণ হচ্ছে তা প্রাকৃতিকভাবেই কমে আসছে। ঢাকা উত্তর ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন মশা নিধনে চরমভাবে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে।

জানা যায়, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে এবার বাজেটে মশা নিয়ন্ত্রণে মোট ১১৪ কোটি ৫০ লাখ বরাদ্দ রেখেছে। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) ২০২৩-২৪ অর্থবছরে মশা মারতে ব্যয় নির্ধারণ করেছে ৪৬ কোটি ৭৫ লাখ টাকা টাকা।

২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন মশক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমে এবার ৮৪ কোটি ৫০ লাখ টাকা ব্যয় করবে। গত অর্থবছরে মশক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমে ব্যয় ছিল ৫২ কোটি ৬০ লাখ টাকা। অর্থাৎ এই অর্থবছরে এই খাতে বাড়ানো হয়েছে ৬১ শতাংশ। মশক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমে ২০২৩-২০২৪ বাজেটে ধরা হয়েছে ৮৪ কোটি ৫০ লাখ টাকা। মশক ওষুধ বাবদ ৪৫ কোটি টাকা, আগাছা পরিষ্কার ও পরিচর্যা ১ কোটি ৫০ লাখ টাকা, ফগার হুইল স্প্রে মেশিন পরিবহন ৫ কোটি টাকা, মশক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমে বিশেষ কর্মসূচি ১ কোটি টাকা, আউটসোর্সিং-এর মাধ্যমে মশক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম ৩০ কোটি টাকা, মশক নিয়ন্ত্রণে চিরুনি অভিযান পরিচালনার জন্য রাখা হয়েছে ২ কোটি টাকা। এছাড়া মশক নিয়ন্ত্রণ যন্ত্রপাতি ক্রয়ে ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন ব্যয় করবে ৩০ কোটি টাকা, যা গত অর্থবছরে ছিল ১৫ কোটি টাকা। অর্থাৎ এই অর্থবছরে এ খাতে খরচ বৃদ্ধির হার শতভাগ। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন মশক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমে ৮৪ কোটি ৫০ লাখ এবং মশক নিয়ন্ত্রণ যন্ত্রপাতি কিনতে ব্যয় করবে ৩০ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে মশার সঙ্গে যুদ্ধে এই অর্থবছরে ১১৪ কোটি টাকা খরচ করবে উত্তর সিটি করপোরেশন।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) ২০২৩-২৪ অর্থবছরে মশা মারতে ব্যয় নির্ধারণ করেছে ৪৬ কোটি ৭৫ লাখ টাকা টাকা। এর মধ্যে মশক নিয়ন্ত্রণ যন্ত্রপাতি ক্রয়ে ব্যয় হবে ৪ কোটি ৫০ লাখ টাকা। মশক নিধন কীটনাশক ক্রয়ে ব্যয় হবে ৩৮ কোটি ৫০ লাখ টাকা। এছাড়াও ফগার, হুইল, স্প্রে মেশিন পরিবহন বাবদ ব্যয় নির্ধারণ করা হয়েছে ৩ কোটি ৭৫ লাখ টাকা।

শুধু মশা নিধনে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন খরচ করেছে ১ হাজার ৮০ কোটি টাকা। এই সময়ে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) কীটনাশক কেনা ও প্রয়োগ, যন্ত্রপাতি আর বেতন-ভাতা বাবদ খরচ করেছে ৫৮৬ কোটি ৫২ লাখ। আর ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) খরচ করেছে ৪৯৩ কোটি ২৪ লাখ টাকা।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ভারপ্রাপ্ত প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. ফজলে শামসুল কবির বলেন, এবার মশার উপদ্রব কম। অন্যান্য বছর এই সময়ে মানুষ মশার উপদ্রবে অতিষ্ঠ হয়ে যেত। এবার এখনো কোনো এলাকা থেকে একটি অভিযোগও আসেনি। অর্থাৎ পরিস্থিতি সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে রেখেছি।

ডিএনসিসির প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ইমরুল কায়েস চৌধুরী বলেন, অপরিকল্পিত নগরায়ন, জনসচেতনতা ও জনসম্পৃক্ততার ঘাটতি, নির্মাণাধীন ভবনে কর্মরত শ্রমিক-কর্মচারীদের জ্ঞানের অভাব এবং অসহযোগিতা, পরিত্যক্ত অপরিকল্পিত ছাদবাগান, বেজমেন্ট পার্কিংয়ে জমা হওয়া পানি এবং ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যার তথ্যে অপ্রতুলতার কারণে এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে আমাদের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়। তাই এসব বিষয় নিয়ে জনগণের মধ্যে ব্যাপকভাবে সচেতনতা বৃদ্ধির পদক্ষেপ নেয়া হবে।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম বলেন, মশার উপদ্রব এই শহরের একটি সমস্যা। যারা মশক নিধনের সাথে জড়িত সবাইকে জবাবদিহিতার আওতায় আনা হবে। আমিসহ সব কাউন্সিলরকে জবাবদিহি করতে হবে। আমরা আত্মসমালোচনার মাধ্যমে নিজেদের কাজের মূল্যায়ন করতে চাই।

https://dailyinqilab.com/national/article/636979