১৪ মে ২০১৭, রবিবার, ৮:৫৮

নজিরবিহীন সাইবার হামলা

বিশ্বের ৯৯টি দেশে বড় ধরনের সাইবার হামলা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা সংস্থা (এনএসএ) থেকে চুরি হওয়া প্রযুক্তি দিয়ে এসব হামলা চালানো হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এ খবর দিয়েছে বিবিসি ও বার্তা সংস্থা রয়টার্স। এই হামলায় ‘র্যানসমওয়্যার’ ছড়িয়ে কম্পিউটারে সংরক্ষিত ফাইল ও তথ্যাদির নিয়ন্ত্রণ নেয়া হয়েছে। ফাইলপত্রের নিয়ন্ত্রণ ফিরে পেতে দাবি করা হয়েছে ৩০০-৬০০ ডলার মুক্তিপণ। এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত কমপক্ষে ৯৯টি দেশে এই সাইবার হামলার খবর জানা গেছে। যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, চীন, রাশিয়া, স্পেন, ইতালি ও তাইওয়ানসহ অন্যান্য দেশের গুরুত্বপূর্ণ অনেক প্রতিষ্ঠান হামলার শিকার হয়েছে। সব থেকে বাজেভাবে আক্রান্ত হয়েছে ইংল্যান্ড ও স্কটল্যান্ডের জাতীয় স্বাস্থ্য সেবা, এনএইচএস। বিবিসি জানতে পেরেছে, এনএইচএস-এর আনুমানিক ৪০টি প্রতিষ্ঠান আক্রান্ত হয়েছে। চিকিৎসা কার্যক্রম ব্যাহত হয়েছে। এছাড়া আক্রান্ত হয়েছে বৈশ্বিক পণ্য পরিবহন সংস্থা ফেডএক্স। সাইবার নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠান অ্যাভাস্ট বলেছে, এই র্যানসমওয়্যার হামলার শিকার হওয়া ৭৫ হাজার কম্পিউটারের তথ্য তারা পেয়েছেন। এই র্যানসমওয়্যারটি ‘ওয়ানাক্রাই’ বা এই নামের বিভিন্ন পরিবর্তিত রূপে পরিচিত।
যেভাবে হামলার ঘটনা সামনে এলো: শুক্রবার দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে এই ম্যালওয়ার। যুক্তরাজ্যের স্বাস্থ্যকর্মীদের কাছ থেকে একের পর এক কম্পিউটার আক্রান্ত হওয়ার খবর আসতে থাকে। এনএইচএস কর্মীরা আক্রান্ত কম্পিউটারগুলোর যে স্ট্রিনশট শেয়ার করেছেন সেখানে প্রতিটি কম্পিউটারের ফাইলপত্র ফিরে পেতে ভার্চুয়াল মুদ্রা বিটকয়েনের মাধ্যমে ৩০০ ডলার মুক্তিপণ দাবি করা হয়। সারা দিন ধরে বিভিন্ন দেশে একইরকম সাইবার হামলার খবর আসতে থাকে। প্রধানত ইউরোপের দেশগুলোর নাম শোনা যাচ্ছিল। কয়েকটি রিপোর্টে বলা হয়, অন্য যে কোনো দেশের তুলনায় সব থেকে বেশিসংখ্যক কম্পিউটার আক্রান্ত হয়েছে রাশিয়ায়। স্থানীয় ব্যাংক, স্বরাষ্ট্র ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, রাষ্ট্র মালিকানাধীন রাশিয়ান রেলওয়ে প্রতিষ্ঠান ও দ্বিতীয় বৃহত্তম মোবাইল ফোন নেটওয়ার্ক আক্রান্ত হওয়ার খবর আসে।
রাশিয়ার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, তাদের একহাজার কম্পিউটার আক্রান্ত হয়েছিল। তবে দ্রুতই ওই ভাইরাসের ব্যবস্থা নেয়া হয়। আর সংবেদনশীল তথ্য খোয়া যায় নি।
স্পেনে টেলিকম জায়ান্ট টেলিফোনিকা, বিদ্যুৎ প্রতিষ্ঠান ইবেরদ্রোলা ও গ্যাস সেবা দাতা প্রতিষ্ঠান গ্যাস ন্যাচারাল-সহ কয়েকটি বড় প্রতিষ্ঠান আক্রান্ত হয়। জার্মানির একটি স্থানীয় রেলওয়ে টিকিট মেশিন ও ইতালির একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার ল্যাব আক্রান্ত হওয়ার ছবি আসে টুইটারে। এছাড়া আক্রান্ত হয়, ফ্রান্সের গাড়ি নির্মাতা প্রতিষ্ঠান রেনল্ট, পর্তুগালের পর্তুগাল টেলিকম, যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক পণ্য পরিবহন সংস্থা ফেডএক্স এবং সুইডেনের স্থানীয় একটি কর্তৃপক্ষ।
চীন আনুষ্ঠানিকভাবে হামলার শিকার হওয়ার কথা জানায় নি। তবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আসা পোস্ট থেকে জানা গেছে, একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার ল্যাব আক্রান্ত হয়েছে।
কাকতালীয়ভাবে, এমন সময় এ সাইবার হামলা হলো যখন কিনা বৈশ্বিক আর্থিক ব্যবস্থায় সাইবার হামলার ঝুঁকি নিয়ে আলোচনা করতে ইতালিতে মিলিত হয়েছেন সবচেয়ে সম্পদশালী ৭টি দেশের অর্থমন্ত্রীরা।
কিভাবে কাজ করে এই ‘র্যানসমওয়্যার’? এর নেপথ্যেই বা কারা?
র্যানসমওয়্যার এমন একধরনের ভাইরাস বা ম্যালওয়্যার যা কম্পিউটারের বা এতে সংরক্ষিত ফাইলপত্রের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়। ফাইলগুলো এনক্রিপ্টেড করে ফেলা হয় যা ব্যবহারকারী দেখতে বা চালু করতে পারেন না। অনেক ক্ষেত্রে ফাইল বা ফোল্ডার পাসওয়ার্ড দিয়ে লক করে ফেলা হয়। এই প্রজাতির ভাইরাস প্রোগ্রামগুলো এক কম্পিউটার থেকে অন্য কম্পিউটারে নিজে নিজেই ছড়িয়ে পড়তে সক্ষম। বেশিরভাগ অন্যান্য ম্যালওয়্যারগুলো ছাড়ানোর জন্য কম্পিউটার ব্যবহারকারীকে ভাইরাস সংযুক্ত ফাইলে ক্লিক করতে হয়। কিন্তু, ওয়ানাক্রাই প্রোগামটি একবার একটি প্রতিষ্ঠানের কোনো কম্পিউটারে প্রবেশ করলে তা অন্যান্য ঝুঁকিপূর্ণ কম্পিউটারগুলোকে আক্রান্ত করতে সক্ষম।
কিছু বিশেষজ্ঞের অভিমত, এনএসএ শনাক্তকৃত মাইক্রোসফট সিস্টেমের একটি দুর্বলতার সুযোগ নেয়ার জন্য এই হামলা প্রক্রিয়া তৈরি করা হয়েছিল। এর নাম দেয়া হয়েছিল ইটারনালব্লু। এনএসএ’র এই প্রযুক্তি চুরি করেছিল দ্য শ্যাডো ব্রাদার্স নামে পরিচিত একদল হ্যাকার। এপ্রিলে তারা এটাকে ইন্টারনেটে বিনামূল্যে সহজলভ্য করে দেয়। এটা মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পকে নিয়ে প্রতিবাদ বলে উল্লেখ করেছিল হ্যকাররা।
মার্চ মাসে মাইক্রোসফট তাদের সিস্টেমের দুর্বলতাটি দূর করার জন্য একটি প্যাঁচ প্রকাশ করে। যেসব কম্পিউটারে উইন্ডোজ আপডেট চালু আছে সেগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে এই দুর্বলতা থেকে সুরক্ষিত করে দেয়। শুক্রবার মাইক্রোসফট জানিয়েছে, তাদের পুরনো অপারেটিং সিস্টেম ব্যবহারকারীদের জন্যও আপডেট ছাড়বে যেগুলো এখন আর ‘মেইনস্ট্রিপ সাপোর্ট পায় না’। এমন অপারেটিং সিস্টেমের মধ্যে রয়েছে উইন্ডোজ এক্সপি, উইন্ডোজ ৮ এবং উইন্ডোজ সার্ভার ২০০৩। উল্লেখ্য, এনএইচএস এখনো উইন্ডোজ এক্সপি ব্যবহার করে। এদিকে, রয়টার্সের খবরে বলা হয়, মার্কিন হোমল্যান্ড সিকিউরিটি জানিয়েছে যে, তারা স্থানীয় ও বিদেশি অংশীদারদের সঙ্গে তথ্য আদান-প্রদান করছে। একইসঙ্গে তারা কারিগরি সহায়তা দিতে প্রস্তুত।
সংবেদনশীল এক সময়ে হামলা: ওয়ানাক্রাই র্যানসমওয়্যার ছড়িয়ে পড়ার ঘটনা দিয়ে সাইবার ঝঞ্ঝাটে এক সপ্তাহ পূর্ণ হলো ইউরোপের। গত সপ্তাহে ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইম্যানুয়েল ম্যাক্রনের নির্বাচনী প্রচারণার নানা নথিপত্র ফাঁস করে দেয় হ্যাকাররা। ভোট শুরুর মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগে এই তথ্য ফাঁসের ঘটনা ঘটে।
বুধবার, হ্যাকাররা বিভিন্ন ফরাসি গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠান ও অ্যারোস্পেস জায়ান্ট এয়ারবাসের ওয়েবসাইটে হামলা চালায়। বৃটেনের নির্বাচনের মাত্র এক মাস আগ দিয়ে ইউরোপজুড়ে এসব হ্যাকিংয়ের ঘটনায় বৃটিশ কর্তৃপক্ষ আগাম প্রস্তুতি নিয়েছে। সাম্প্রতিক মার্কিন নির্বাচন ও ফরাসি নির্বাচনের প্রচারণাকালীন হ্যাকিংয়ের ঘটনা ঘটায় বৃটেনও তাদের আসন্ন নির্বাচনের আগ দিয়ে এমন শঙ্কা আমলে নিয়েছে। নির্বাচনের মাত্র এক মাস বাকি থাকতেই সাইবার হামলা মোকাবিলায় প্রস্তুতি নিয়েছে দেশটি। ওই দুই নির্বাচনে হ্যাকিংয়ের নেপথ্যে আঙ্গুল উঠেছিল রাশিয়ার দিকে। তবে দেশটি এমন অভিযোগ বারবার অস্বীকার করে আসছে।

http://www.mzamin.com/article.php?mzamin=65345