৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, বুধবার, ৬:৪৬

ফারাক্কায় পানি আসছে না ॥ পদ্মার গভীরতা ও প্রশস্ততা কমছে

উজানে ব্যাপক মাত্রায় প্রত্যাহার করে নেয়ার ফলে গঙ্গার ফারাক্কা পয়েন্টে পর্যাপ্ত পরিমাণ পানি জমছে না। এ কারণে বাংলাদেশ পাচ্ছে না তার ন্যায্য হিস্যা। গত বছরের তুলনায় একবছরেই পানির প্রবাহ কমেছে ১৫ হাজার কিউসেক। এই পানি না আসার প্রতিক্রিয়ায় পদ্মায় হ্রাস পেয়ে চলেছে পানিপ্রবাহ। ফলে একই সঙ্গে পদ্মার গভীরতা ও প্রশস্ততা হ্রাস পেয়ে চলেছে বলে প্রাপ্ত তথ্যে জানা গেছে।

চলতি বছরের জানুয়ারিতে শুষ্ক মওসুুমের শুরু ধরে ভারত-বাংলাদেশ পদ্মায় পানির প্রাপ্যতা যাঁচাই শুরু হয়। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) প্রাপ্ত হিসাবমতে, হার্ডিঞ্জ ব্রিজের কাছে পানি প্রবাহ পর্যবেক্ষণ ও পরিমাপ করে ১ জানুয়ারি পানি পাওয়া যায় ৭৫ হাজার ৪০৯ কিউসেক এবং ২ জানুয়ারিতে ছিল ৭২ হাজার ৯৬৯ কিউসেক। আগামী ৩১ মে পর্যন্ত পানিপ্রবাহ পর্যবেক্ষ কার্যক্রম চলমান থাকবে। পাউবো’র হিসাব অনুযায়ী ২০২৩ সালের ১ জানুয়ারি পদ্মায় পানিপ্রবাহের পরিমাণ ছিল ৯০ হাজার ৭৩০ কিউসেক। আর ২০২৪ সালের ১ জানুয়ারি পানি প্রবাহের পরিমাণ ছিল ৭৫ হাজার ৪০৯ কিউসেক। মাত্র এক বছরের ব্যবধানে পদ্মায় পানি প্রবাহ কমেছে ১৫ হাজার ৩২১ কিউসেক। শুকনো মওসুমে হার্ডিঞ্জ ব্রিজ ও ফারাক্কা পয়েন্টের প্রবাহ অনুযায়ী দু’দেশের মধ্যে পানি বণ্টন করা হয়ে থাকে। তবে পানির ন্যায্য হিস্যা পাওয়া নিয়ে বরাবরই শঙ্কা প্রকাশ করা হয়ে আসলেও এর কোনো প্রতিবিধান করা হয় না।

ফারাক্কা পয়েন্টে পানি থাকে না
বাংলাদেশের পদ্মায় পানি না আসার প্রধান কারণ ফারাক্কা পয়েন্টে পর্যাপ্ত পরিমাণ পানি জমা না হওয়া। এর মূলে রয়েছে উজানে গঙ্গার পানি ইচ্ছেমত প্রত্যাহার করা। অসংখ্য প্রতিবন্ধক সৃষ্টি করে পদ্মায় পানির প্রবাহে বাধা সৃষ্টির পাশাপাশি বিভিন্ন কৃত্রিম খাল-ক্যানেল দিয়ে পানি সরিয়ে নিয়ে উজানের বিভিন্ন প্রকল্পে সেই পানি কাজে লাগানো। ফারাক্কা বাঁধ ছাড়াও ফারাক্কার কাছাকাছি যে প্রকল্পগুলো নির্মাণ করেছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, ভাগীরথী নদীর উপর জঙ্গিপুরের কাছে ৩৯ কিলোমিটার দীর্ঘ ফিডার ক্যানেল। জঙ্গিপুর ব্যারাজ নামের এই প্রকল্পের লক্ষ্যই হলো ফারাক্কা পয়েন্টের ৪০ হাজার কিউসেক পানি হুগলি ও ভাগীরথী নদীতে সরিয়ে নেয়া। ভারত তার বহু সংখ্যক সেচ ও পানিবিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য মূল গঙ্গা এবং এর উপনদীগুলোর ৯০ ভাগ পানি সরিয়ে নিচ্ছে। ফলে নদীতে পানি প্রবাহিত হতে পারছে মাত্র ১০ ভাগ। এছাড়াও নদীসদৃশ বেশ কয়েকটি ক্যানেল প্রকল্প দিয়েও সারা বছর পানি প্রত্যাহার করা হয়ে থাকে। ভারত নদীসদৃশ ৭টি ক্যানেল বা কৃত্রিম খাল প্রকল্পের মাধ্যমে হাজার হাজার কিউসেক পানি গঙ্গা থেকে সরিয়ে নিয়ে কয়েক লাখ হেক্টর জমিতে সেচ প্রদান করছে। তারা অনেক আগে থেকেই গঙ্গায় বৃহদাকার তিনটি খাল (ক্যানেল) প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে। এর মধ্যে রয়েছে, ‘আপারগঙ্গা ক্যানেল প্রজেক্ট’, ‘মধ্যগঙ্গা ক্যানেল প্রজেক্ট’, ‘নি¤œগঙ্গা ক্যানেল প্রজেক্ট’, ‘পূর্ব গঙ্গা ক্যানেল প্রজেক্ট’, ‘মধ্যগঙ্গা ক্যানেল ২য় পর্যায়’ এবং ‘সমান্তরাল নি¤œ গঙ্গা ক্যানেল’। এ ধরনের প্রকল্পের হাজার হাজার কিলোমিটার খালের মাধ্যমে গঙ্গার পানি সরিয়ে নিয়ে সেচ দেবার ব্যাপক কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। ‘আপার গঙ্গা ক্যানেল প্রকল্পের’ মাধ্যমে উত্তর প্রদেশের ২৫ লাখ একর জমিতে সেচ দেয়ার লক্ষ্যে ৬ হাজার কিলোমিটারের বেশি খাল কেটে পদ্মার পানি সরিয়ে নেয়া হচ্ছে। ‘মধ্যগঙ্গা ক্যানেল প্রজেক্ট’ নামের প্রকল্পে মূল ও শাখাসহ খননকৃত খালের মোট দৈর্ঘ্য প্রায় ১,৬০০ কিলোমিটার। ‘নিম্নগঙ্গা সেচ প্রকল্পের’ জন্য ৬ হাজার কিলোমিটার খালের মাধ্যমে পানি সরিয়ে নেয়া হচ্ছে। এভাবে এসব উৎসের শতকরা ৯০ ভাগ পানি সরিয়ে নেয়া হচ্ছে। ফলে নদীতে মাত্র ১০ ভাগ পানি স্বাভাবিকভাবে প্রবাহিত হতে পারছে।

পদ্মার গভীরতা ও প্রশস্ততা কমছেই
৪০ বছরের ব্যবধানে পদ্মা নদীর আয়তন নেমেছে অর্ধেকে। এতে পানির গভীরতার পাশাপাশি কমেছে প্রবাহ। আন্তর্জাতিক একটি বিজ্ঞান সাময়িকী ‘বায়োডাইভারসিটি অ্যান্ড কনজারভেশন’ ২০২৩ সালের জানুয়ারি সংখ্যায় এ তথ্য উঠে এসেছে বলে জানিয়েছেন একদল গবেষক। এতে বলা হয়, ১৯৮৪ সালের তুলনায় শুকনো মৌসুমে পদ্মা নদীর আয়তন কমেছে প্রায় ৫০ শতাংশ। পানির গভীরতা কমেছে ১৭ দশমিক ৮ শতাংশ। প্রবাহ কমেছে ২৬ দশমিক ২ শতাংশ। আর মিঠা পানির সরবরাহ সর্বোচ্চ ৯০ শতাংশ পর্যন্ত কমেছে। এছাড়া পদ্মা অববাহিকায় বার্ষিক গড় বৃষ্টিপাত ১৯ দশমিক ২ শতাংশ কমেছে। ১৯৮১ সালে যেখানে তাপমাত্রা ছিল ২৫ দশমিক ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস, ২০১৯ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৬ দশমিক ২ ডিগ্রিতে। মূলত পদ্মার প্রকৃত অবস্থা বুঝতেই গবেষণার জন্য শুকনো মৌসুমকে বেছে নেয়া হয় বলে জানান গবেষকরা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পদ্মা নদীর চেহারা পাল্টাতে শুরু করে ১৯৭৫ সালের পর। ওই বছর পদ্মার ১৮ কিলোমিটার উজানে ফারাক্কা বাঁধ চালু করে ভারত। এ বাঁধ দিয়েই ভাগীরথী ও হুগলি নদীতে পানি প্রত্যাহার শুরু করে প্রতিবেশী দেশটি। এর প্রভাবে পানি কমতে শুরু করে পদ্মায়। গবেষকরা জানান, ফারাক্কা বাঁধ চালুর আগে ১৯৬৯ থেকে ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত পদ্মায় প্রতি সেকেন্ডে পানি প্রবাহিত হতো ৯ হাজার ৩২ ঘনমিটার। বাঁধ চালুর পর থেকে অর্থাৎ ১৯৭৫ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত প্রবাহ নেমেছে ৫ হাজার ১৪৬ ঘনমিটারে।

বিশেষজ্ঞ অভিমত
এবিষয়ে নদী, প্রকৃতি ও ইতিহাসের গবেষক ও লেখক মাহবুব সিদ্দিকী উল্লেখ করেন, গঙ্গার পানি একতরফাভাবে প্রত্যাহারের ফলে বাংলাদেশে গঙ্গা ও পদ্মা অববাহিকার প্রায় ৮ কোটি মানুষ সরাসরি এক বিরূপ বৈশ্বিক প্রভাবের শিকার হয়েছেন। বিগত ৪৫ বছরের মধ্যে এ অঞ্চলের বাস্তুতন্ত্রের (ইকোসিস্টেম) ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে গেছে। পূর্বের শ্যামল কাননময় একটি দেশ ক্রমেই ধূসর হয়ে মরুভূমির রূপ ধারণ করতে চলেছে। গঙ্গার শাখা মরিগঙ্গা, স্বরমঙ্গলা, চিনারকুপ, বারাহী, রাইচান, নারদ, বড়াল, চন্দনা, খলিশাডাঙ্গা, ইছামতি, কমলা, রতœাই প্রভৃতি নদী ইতোমধ্যেই হারিয়ে যেতে বসেছে। এছাড়াও গঙ্গার বেশ কয়েকটি প্রশাখা- দয়া, সন্ধ্যা, মুসাখান, হোজা, মির্জা মাহমুদ, হ্যালেঞ্চা প্রভৃতিও বিলুপ্তি ঘটে গেছে। উল্লিখিত নদী অববাহিকার জনজীবনে নেমে এসেছে এক মহাবিপর্যয়কর অবস্থা। ফারাক্কাসহ উজানের পানি প্রত্যাহারের প্রভাবে বাংলাদেশের গঙ্গা-পদ্মা অববাহিকার জীববৈচিত্র্য, পরিবেশ-প্রকৃতি, নৌ-যোগাযোগ, মানুষের পেশা ও সংস্কৃতিসহ সর্বোপরি অর্থনীতির যে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে এবং হয়ে চলেছে পৃথিবীর ইতিহাসে এর দ্বিতীয় নজির খুঁজে পাওয়া যাবে না। তিনি উল্লেখ করেন, গঙ্গার মূল ধারা থেকে এভাবে পানি ভারত নিজেদের দেশের অভ্যন্তরের হাজার হাজার কিলোমিটারব্যাপী খালের মাধ্যমে এক তরফাভাবে নিয়ে যাচ্ছে পানি বিষয়ক আন্তর্জাতিক সকল আইন-কানুন ও নিয়ম নীতিকে অবজ্ঞা করে। এদিকে গঙ্গার প্রয়োজনীয় পানি না পেয়ে ‘বন্ধু রাষ্ট্র’ বাংলাদেশের ৮ কোটি মানুষের আহাজারি এবং হাহাকার বিশ্বের তথাকথিত বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশটি শুধু তাচ্ছিল্যই দেখাচ্ছে না বরং প্রকারান্তরে ভয়াবহ এক উৎপীড়কের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে।

https://www.dailysangram.info/post/548240