১৪ মে ২০১৭, রবিবার, ৮:৫৭

ফ্লাইওভার যেন বিষফোঁড়া

নিরাপত্তাহীন মালিবাগ-মগবাজার ফ্লাইওভার : কয়েক দফা সময় ও ব্যয় বেড়েছে : সীমাহীন দুর্ভোগে নগরবাসী : অসহায় এলজিইডি

প্রায় পাঁচ বছর ধরে ফ্রি স্টাইলে চলছে মালিবাগ-মগবাজার ফ্লাইওভারের নির্মাণ কাজ। দফায় দফায় সময় ও নির্মাণ ব্যয় বাড়ানোর পরও এর নির্মাণ কাজ শেষ হচ্ছে না। এতে করে নগরবাসীকে পোহাতে হচ্ছে চরম দুর্ভোগ। ধীরগতিতে কাজ চলার কারণে ফ্লাইওভারের নীচ দিয়ে চলাচলকারী, স্থানীয় এলাকাবাসী এবং ফ্লাইওভারের আশপাশের ব্যবসায়ীরা অতিষ্ঠ। একের পর এক দুর্ঘটনা ঘটলেও পথচারীদের চলাচলে কিংবা নির্মাণ কাজে নিয়োজিত কর্মীদের জন্য পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। অভিযোগ রয়েছে, অভিজ্ঞতা ছাড়াই দলীয় প্রভাব খাটিয়ে ফ্লাইওভারের একটা বড় অংশের কাজ বাগিয়ে নেয় তমা কনস্ট্রাকশন নামক ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান। তাদের গাফিলতিতে গত মার্চ মাসে গার্ডার পড়ে একজন নিহত হয়। পঙ্গু হয় আরও দুজন। অনেকের মতে, কাজ পাওয়ার জন্য তমার লবিংয়ের কাছে খোদ এলজিইডিও ছিল অসহায়।
তমার প্রভাবের কারণে প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা কয়েক দফা প্রকল্পের টাকা বাড়াতে বাধ্য হয়েছে। সর্বশেষ এই ফ্লাইওভারের মৌচাক অংশের (শান্তিনগর থেকে মালিবাগ, রাজারবাগ ও মৌচাক হয়ে রামপুরা পর্যন্ত) প্রায় ৩ দশমিক ৯৪ কিলোমিটার দীর্ঘ অংশের ব্যয় বেড়েছে ১০৮ কোটি ৪০ লাখ টাকা। গত মাসে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের সভাপতিত্বে সচিবালয়ে সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির সভায় ব্যয় বৃদ্ধির প্রস্তাব অনুমোদন দেওয়া হয়। সভা শেষে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব মোস্তাফিজুর রহমান সাংবাদিকদের ব্যয় বৃদ্ধির প্রস্তাব অনুমোদনের কথা জানিয়ে বলেন, মৌচাক অংশ নির্মাণে ভ্যাট-ট্যাক্সসহ মূল চুক্তিতে মোট ব্যয় ধরা হয়েছিল ৩৪৩ কোটি ৭০ লাখ টাকা। ভেরিয়েশন প্রস্তাব (ব্যয় বৃদ্ধি) অনুযায়ী ভ্যাট-ট্যাক্সসহ এর মোট নির্মাণ ব্যয় বেড়ে দাঁড়াচ্ছে ৪৫২ কোটি ১০ লাখ টাকা। এর আগে এ ফ্লাইওভারের ৪ দশমিক ৭৭ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে অপর দু’টি অংশের মোট নির্মাণ ব্যয় ২৭১ কোটি টাকা বাড়ানো হয়। সব মিলিয়ে মালিবাগ-মগবাজার ফ্লাইওভারের মোট নির্মাণ ব্যয় বাড়ল ৩৭৯ কোটি ৪০ লাখ টাকা। সংশ্লিষ্টদের মতে, ফ্লাইওভারের অর্থ জনগণের ট্যাক্সের টাকায় পরিশোধ করা হয়। এমনিতেই ঋণ ও করের বোঝায় জনজীবন অতিষ্ঠ। এভাবে ব্যয়বৃদ্ধি মূলত অপচয়ের শামিল। ভুক্তভোগিদের মতে, দীর্ঘদিন ধরে চলমান এ ফ্লাইওভারের কাজই শুধু নিরাপদহীন নয়, নিচের সড়কও যেন মৃত্যুফাঁদ। শান্তিনগর থেকে মালিবাগ চৌরাস্তা হয়ে রেলগেট ও মগবাজার পর্যন্ত সড়কে সৃষ্টি হয়েছে বড় বড় গর্ত। সামান্য বৃষ্টি হলে এসব গর্ত পানিতে ভরে যায়। তখন চলাচলকারী মানুষের দুর্ভোগের সীমা থাকে না। বর্ষার আগেই এমন দশা দেখে অনেকেই আতঙ্কিত। ভুক্তভোগিদের কয়েকজন বলেন, ভরা বর্ষায় না জানি কি হবে? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের প্রবীণ শিক্ষক প্রফেসর ড. এএসএম আমানউল্লাহ এ প্রসঙ্গে বলেন, মালিবাগ-মগবাজার ফ্লাইওভার দেখলে বোঝা যায় উন্নয়নের নামে বছরের পর বছর কাজ চললেও সেখানে কোনো মনিটরিং করা হয়নি। শুরু থেকেই এই প্রকল্পে বড় ধরনের দুর্নীতি ছিল বলেই ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান নিজেদের খেয়াল খুশি মতো বেপরোয়াভাবে কাজ করেছে। তিনি বলেন, মৌচাক-মালিবাগ-মগবাজারসহ আশপাশের ৩০ লাখ মানুষকে বছরের পর বছর ধরে ভোগান্তিতে রেখেছে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান তমা কন্সট্রাকশন। এজন্য তাদেরকে একদিন জবাবদিহি করতে হবে। - নগরবাসীর চলাচল সহজ ও যানজটমুক্ত করতে ২০১২ সালে শুরু হয় প্রায় ৯ কিলোমিটার দীর্ঘ মালিবাগ-মগবাজার ফ্লাইওভারের নির্মাণ কাজ। সরকারের সঙ্গে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের চুক্তি অনুযায়ী এ কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে। কিন্তু সময়মতো ওই কাজ তারা শেষ করতে পারেনি। গত বছর ৩০ জুন তেজগাঁও শিল্প এলাকার সাত রাস্তা থেকে রমনার হলিফ্যামিলি পর্যন্ত ফ্লাইওভারের ২ দশমিক ১১ কিলোমিটার অংশ চালু করা হয়। এরপর ১৫ সেপ্টেম্বর বাংলামটর থেকে মৌচাকমুখী অপর অংশও চালু করা হয়। নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রকল্প সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা জানান, ঠিকাদারের ঢিলেমির কারণে শান্তিনগর ও রাজারবাগ থেকে মালিবাগ- মৌচাক হয়ে রামপুরা ও বাংলামটরমুখী অংশ চালু করা যায়নি। বর্তমানে এ অংশে কাজ চলছে। এ কাজ শেষ করার সময় নির্ধারণ করা আছে চলতি বছরের জুন পর্যন্ত। এবারও নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ হবে না বলে অনেকেরই ধারনা। সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, শান্তিনগর, মালিবাগ চৌরাস্তা, মৌচাক, মালিবাগ রেলগেট, মগবাজার ও এফডিসি এলাকায় চলছে ফ্লাইওভারের নির্মাণ কাজ। কিন্তু কোথাও পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেই। মালিবাগ মোড়ে লোহার খুঁটি দিয়ে ফ্লাইওভারের ঢালাইয়ের আয়োজন করা হয়েছে। এতে করে নিচের সড়কটি সংকীর্ণ হয়ে পড়েছে। অরক্ষিত অবস্থায় এই সংকীর্ণ অংশ দিয়েই যানবাহন চলাচল করছে। মৌচাক থেকে মালিবাগ রেলগেট পর্যন্ত সড়কে ফ্লাইওভারের পিলার নির্মাণের পর ওই পিলারে গার্ডার স্থাপনের কাজ চলছে। পিলারের ওপরে বসানো হয়েছে বিশাল যন্ত্র। প্রকল্পের কর্মীদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, এই যন্ত্র ও ক্রেন দিয়ে ৬০-৭০ টন ওজনের গার্ডার তুলে পিলারে বসানো হয়। অথচ নিচের সড়ক দিয়ে এলোপাতাড়ি চলাচল করছে যানবাহন। একজন কর্মী বলেন, গার্ডার স্থাপনের সময় বিশাল যন্ত্রের একটি অংশও যদি খসে পড়ে, তাহলে বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে। স্থানীয় বাসিন্দারা এ নিয়ে সারাক্ষণ আতঙ্কে থাকেন। মার্চে গার্ডার পড়ে একজনের মৃত্যুর ঘটনা সে আতঙ্ক কয়েক গুণ বাড়িয়ে দিয়েছে বলে জানান, মালিবাগের কাপড় ব্যবসায়ী শাহাদত হোসেন। তিনি বলেন, ফ্লাইওভারের কারণে গত প্রায় ৫ বছর ধরে মালিবাগ- মৌচাক-মগবাজার এলাকার ব্যবসা মন্দা যাচ্ছে। ক্রেতা না আসায় অনেকেই ব্যবসা গুটিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছেন। অনেকেই ঋণের বোঝা টানছেন। রাজারবাগ, মালিবাগ মোড়, শান্তিনগর, মৌচাক, মালিবাগ রেলগেট, এফডিসি মোড় ঘুরে দেখা গেছে, তুলনামূলক কম সংখ্যক শ্রমিক দিয়ে কাজ করানো হচ্ছে। একদিকে চলছে ফ্লাইওভার নির্মাণ কাজ অন্যদিকে চলছে সিটি করপোরেশনের ড্রেন নির্মাণের কাজ। এতে করে রাস্তা দিয়ে মানুষ চলাচলের উপায় নেই। কোথাও চলছে ফ্লাইওভারের ¯েøাবের কাজ আবার কোথাও আই গ্রাডার, ভিম, ঢালাইয়ের কাজ। ফ্লাইওভারের নির্মাণ সামগ্রী সড়ক ও পার্শ্ববর্তী ফুটপাথে রাখার কারণে সরু হয়ে গেছে রাস্তা। রড, ভিম, ঢালাই বোর্ড, লোহার এঙ্গেল, খুঁটি রাখার কারণে রাস্তার একপাশ থেকে আরেক পাশে পথচারীরা চলাফেরা করতে পারে না। সরু রাস্তার কারণে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লেগে থাকে যানজট। ভুক্তভোগিরা জানান, কয়েকদিন আগে সামান্য বৃষ্টিতে রাজারবাগ থেকে মালিবাগ, মৌচাক থেকে মালিবাগ রেলগেট হয়ে রামপুরা পর্যন্ত রাস্তায় যেভাবে পানি জমেছে তাতে ভরা বর্ষায় যে কি হবে তা নিয়ে তারা শঙ্কিত। কোথাও কোথাও এতোটাই গভীর খাদের সৃষ্টি হয়েছে যে, প্রাইভেট কার ও সিএনজি অটোরিকশা ডুবে যাওয়ার উপক্রম। ইঞ্জিনে পানি ঢুকে বহু গাড়ি বিকল হয়ে রাস্তার উপর পড়ে থাকছে।
এসব বিষয়ে ফ্লাইওভারের নির্মাণ কাজের তত্ত¡াবধানকারী এলজিইডির নির্বাহী প্রকৌশলী এটিএম আমিরুজ্জামানের সাথে কথা বলার চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া সম্ভব হয়নি। তবে এলজিইডির একজন উর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান তমার কারনে ফ্লাইওভার প্রকল্পটি এলজিইডির জন্য ‘বিষফোঁড়া’ হয়ে গেছে। এটি নিয়ে পুরো এলজিইডিই বিব্রত। তমা কনস্ট্রাকশনের একজন কর্মকর্তা ফ্লাইওভার নিয়ে কথা বলতে রাজি হননি। তার কাছে তমার ব্যবস্থাপনা পরিচালকের নম্বর চাইলে তিনি বলেন, স্যারের নম্বর আমার কাছে নেই।

https://www.dailyinqilab.com/article/79311/