৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, রবিবার, ১০:০৩

ট্রানজিটে চিড়েচ্যাপ্টা হবে বন্দর!

দেশের প্রধান সমুদ্র বন্দর চট্টগ্রাম ও দ্বিতীয় সমুদ্রবন্দর মোংলায় আমদানি-রফতানি পণ্যসামগ্রী পরিবহণের ক্রমাগত চাহিদা এবং চাপ দুইই বাড়ছে। বঙ্গোপসাগরের সুদীর্ঘ কোল ঘেঁষে বাংলাদেশের ভূ-প্রাকৃতিক সুবিধাজনক অবস্থান থাকলেও এখনো নির্মিত হয়নি গভীর সমুদ্রবন্দর। গভীর সমুদ্র বন্দরের আদলে মাতারবাড়ী বহুমুখী সমুদ্রবন্দর নির্মাণকাজ সম্পন্ন হতে আরও কয়েক বছর যাবে। চট্টগ্রাম বন্দরের সম্প্রসারণে অপরিহার্য পতেঙ্গা-হালিশহর বে-টার্মিনাল স্থাপন প্রকল্পও দীর্ঘ সময়সাপেক্ষ। যুগের চাহিদার তুলনায় উভয় বন্দরের বর্তমান অবকাঠামো সুবিধা অপর্যাপ্ত। সমুদ্রপথে দেশের শিল্প কারখানার কাঁচামাল-সংশ্লিষ্ট ও ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রায় ৯২ শতাংশই প্রধান সমুদ্রবন্দর চট্টগ্রামের মাধ্যমে পরিচালিত হয়। এর মধ্যে কন্টেইনার ভর্তি পণ্য পরিবহনই ৯৮ শতাংশ। ভারী শিল্প-অর্থনীতির দিকে ধাবিত হচ্ছে দেশ।

গেল ২০২৩ সালে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে কন্টেইনার হ্যান্ডলিং করা হয়েছে ৩০ লাখ ৫০ হাজার। দেশের বিনিয়োগ-শিল্পায়ন, উন্নয়ন মেগাপ্রকল্প ও প্রকল্পবহরের যন্ত্রপাতি, নির্মাণসামগ্রী আনয়ন, শিল্পের কাঁচামাল, আমদানি-রফতানি বৈদেশিক বাণিজ্যের ক্রমবর্ধমান চাপ, রাজস্ব আহরণ বৃদ্ধির টার্গেট পূরণ ইত্যাদি অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের ব্যাপকতা আছে প্রতিনিয়ত। যা ‘বাংলাদেশের হৃৎপিণ্ড ও লাইফ লাইন’ চট্টগ্রাম বন্দরের জন্য একেকটি চ্যালেঞ্জ। চট্টগ্রাম পোর্টের থিম শ্লোগান- ‘কান্ট্রি মুভস্ উইথ আস’ এবং ‘সমৃদ্ধির স্বর্ণদ্বার চট্টগ্রাম বন্দর।
এ অবস্থায় চট্টগ্রাম ও মোংলা সমুদ্রবন্দর ব্যবহার করে ভারতকে ট্রানজিট সুবিধা প্রদানের চুক্তিটি পূর্ণাঙ্গ অনুমোদন ও কার্যকর করেছে সরকার। চুক্তিতে উল্লেখ করা আছে, ‘এগ্রিমেন্ট অন দ্য ইউজ অব চট্টগ্রাম অ্যান্ড মোংলা পোর্ট ফর মুভমেন্ট অব গুডস টু অ্যান্ড ফ্রম ইন্ডিয়া’। অর্থাৎ ‘ভারতের পণ্য, ভারতীয় নাগরিকদের জন্যÑ যাবে ভারতেই’। ভারতের মালামাল পরিবহণে ট্রানজিটের বিশেষ সুবিধা দেয়া হয়েছে চট্টগ্রাম ও মোংলা সমুদ্রবন্দর অবকাঠামোর উপর। সেই সাথে চারটি স্থলবন্দর করিডোর রুট ব্যবহার করা হচ্ছে। অর্থনীতিবিদ, ট্রান্সশিপমেন্ট বিশেষজ্ঞগণ বলছেন, সীমিত অবকাঠামো সুবিধার মধ্যেই দেশের আমদানি-রফতানির ক্রমাগত চাপ-চাহিদা সামাল দিতে গিয়েই চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দরের হিমশিম দশা।

তার উপর ভারতের ট্রানজিট পণ্যসামগ্রীর বাড়তি বোঝা বহন করতে গিয়ে চিড়েচ্যাপটা হবে বন্দর। বেসামাল আকার ধারণ করবে বন্দরের পরিবহণ কার্যক্রম। স্থবির শ্লথ হয়ে পড়বে বন্দরের অপারেশনাল কর্মকাণ্ডের স্বাভাবিক গতি। যার খেসারত দিতে হবে দেশের রুগ্ন, দুর্বল ও ভগ্ন হয়ে পড়া সামগ্রিক অর্থনীতিকে। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, আমদানি-রফতানিতে ব্যয় বৃদ্ধি, ব্যবসায় পরিচালনায় খরচ বেড়ে গিয়ে বাড়তি ব্যয়ের বোঝা টানতে হবে দেশ-জাতিকে। তার উপর ট্রানজিট-করিডোরের ফি-চার্জ-মাশুল ধার্য্য করা হয়েছে বলতে গেলে মুফ্ত কিংবা নামেমাত্র। তাও ডলারের বদলে টাকার অংকে। ডলারের অব্যাহত সঙ্কট ও টাকার মান অবচয়নের সুফল ভোগ করবে ভারত। অবশ্য বন্দর-শিপিং কর্তৃপক্ষ সূত্র জানায়, চূড়ান্ত অনুমোদনের পর এখন পর্যন্ত ভারতের কোন ট্রান্সশিপমেন্ট পণ্যবাহী জাহাজ আসেনি। এর আগে পরীক্ষামূলক (ট্রায়াল রানে) একাধিক জাহাজে আনীত ভারতের পণ্যসামগ্রী হ্যান্ডলিং ও আনা-নেয়া হয়।

বাংলাদেশ সরকারের ‘চিরদিন মনে রাখার মতো’ উজাড় করে দেয়া বন্ধুত্বের বিনিময়ে ভারত মেগা অর্জন হাতের মুঠোয় ভরে পেলো ট্রানজিট ও করিডোর। চট্টগ্রাম ও মোংলা সমুদ্রবন্দর দিয়ে ট্রানজিট সুবিধা পেয়ে খুশিতে ভাসছেন ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রী এস জয়শঙ্কর এবং দেশটির কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারের মন্ত্রী-নেতারা। বাংলাদেশ এই প্রথমবারের মতো ভারতীয়দের চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দর ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছে বলে জানান ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর। এর ফলে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের অর্থনীতি বদলে যাবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি। গত ৩০ জানুয়ারি ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব ম্যানেজমেন্ট মুম্বাই (আইআইএম) আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আরো বলেন, ‘বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের রেল ও বাস যোগাযোগ রয়েছে। বাংলাদেশের ইতিহাসে এই প্রথম দেশটির ভেতর দিয়ে ভারতীয়দের যাওয়া ও বাংলাদেশের বন্দর ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছে। এর একটি বড় প্রভাবপড়বে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে। কেননা এটা (বাংলাদেশের অনুমতি) না হলে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের মানুষকে শিলিগুড়ি দিয়ে এসে তারপর ভারতের পূর্বাঞ্চলের বন্দরগুলোতে যেতে হতো। তারা এখন চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দর ব্যবহার করতে পারবে’।

ভারতমুখী ট্রানজিট-করিডোর ব্যবস্থা প্রসঙ্গে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ প্রফেসর মু. সিকান্দার খান ইনকিলাবকে বলেন, দেশের শিল্প-বাণিজ্য-অর্থনীতির আয়তন ও পরিধি বিস্তৃত হচ্ছে। নিজেদের অর্থনৈতিক স্বার্থে আমদানি ও রফতানি পণ্যসামগ্রীর চাপ সামাল দিতে গিয়ে এমনিতেই চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দরের অনেক সময় হিমশিম অবস্থায় পড়তে হয়। অবকাঠামো সুবিধাও সীমিত। তাছাড়া বাংলাদেশের নরম মাটি ভূ-প্রকৃতিতে গড়া রাস্তাঘাট ভারী ট্রাকলরি চলাচলের অত্যধিক চাপ বহনে অক্ষম। বন্ধুত্ব হতে হবে পারস্পরিক চাওয়া-পাওয়া, দেয়া-নেয়ায় সমতার ভিত্তিতে। বন্ধুত্ব মানে মিলবো আর মিলাবো। কিন্তু আমি নিজে খেতে পারলে এরপর অবশিষ্ট কিছু থাকলে বন্ধুকে দেব। কিন্তু নিজে না খেয়ে বন্ধুকে দিতে পারি কীভাবে? প্রতিবেশী দুই দেশের চাওয়া-পাওয়ার হিসাব মিলাতে হবে।

‘চিকেন নেক’ খোলেনি ভারত : শুধুই ভারতমুখী একতরফা ট্রানজিট-করিডোরের কারণে বঞ্চনা-বৈষম্যের মধ্যে পড়ে গেছে বাংলাদেশ, নেপাল, ভুটান- এই তিন নিকট প্রতিবেশী দেশ। বাংলাদেশ আখাউড়া-আগরতলায় সংযোগ তথা করিডোর রুট সুবিধা দিয়েছে। কিন্তু বাংলাবান্ধা হয়ে ফুলবাড়ী-শিলিগুড়ি চারটি আন্তঃদেশীয় বাণিজ্যিক যোগাযোগের সেই ‘চিকেন নেক’ করিডোর আজও খোলেনি ভারত। এতে করে মাঝখানে ভারতের সীমানার মধ্যে থাকা স্বল্প দূরত্ব পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশ, নেপাল ও ভুটানের পারস্পরিক বাণিজ্য, পণ্যসামগ্রী আমদানি-রফতানিতে প্রত্যক্ষ, পরোক্ষ বাধা-বিপত্তি রয়েই গেছে। নেপাল, ভুটানের অনেক ধরনের ভোগ্যপণ্য প্রতিযোগিতামূলক কম দামে বাংলাদেশে আমদানি করা যাচ্ছে না। বাধ্য হয়ে ভারত থেকে আমদানি করতে হচ্ছে। বাণিজ্যিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে বঞ্চিত হচ্ছে তিনটি দেশÑ বাংলাদেশ, নেপাল ও ভুটান।

অথচ বাংলাবান্ধা থেকে ‘চিকেন নেক’ সেই ফুলবাড়ী-শিলিগুড়ি করিডোরের দূরত্ব মাত্র ২২ কিলোমিটার। প্রস্থ ২১ থেকে স্থানভেদে ৪০ কি.মি.। বাংলাদেশে উৎপাদিত উৎকৃষ্টমানের নিত্য ব্যবহার্য ও ভোগ্যপণ্য, শিল্প কাঁচামাল, শিল্পে উৎপাদিত পণ্যসামগ্রী, আইটি পণ্য, সেবাখাত, খাদ্যপণ্য ও প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্য, সৌখিন পণ্য, আসবাবপত্র, ইলেকট্রিক ও ইলেকট্রনিক্স পণ্য, ওষুধ ও পেটেন্ট, বস্ত্র-সম্ভার ইত্যাদি মিলিয়ে বাংলাদেশের শতাধিক ধরনের পণ্যের চাহিদা এবং বাজার সম্ভাবনাময় প্রতিবেশী অপর দুই দেশ নেপাল ও ভুটান। উত্তর-পূর্ব ভারতেও সেই বিপুল বাজার সম্ভাবনার পথ আটকে আছে ভারতের শুল্ক-অশুল্ক নানাবিধ বাধা-বিপত্তির কারণে।

অন্যদিকে ভারতের সাথে একমুখী ট্রানজিট-করিডোর ব্যবস্থায় রেলপথে সবচেয়ে বড় রুট এখন আখাউড়া-আগরতলা। সড়কপথ ছাড়াও সম্প্রতি আখাউড়া-আগরতলা নতুন রেলপথ চালু হয়েছে। সাড়ে ১৫ কিলোমিটার দূরত্বের নয়া রেলপথ বাংলাদেশকে আখাউড়া (ব্রাহ্মণবাড়িয়া) দিয়ে আগরতলা হয়ে ভারতের মূল ভূখণ্ডকে দেশটির উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সাথে সরাসরি সংযুক্ত করছে। এখানে সাড়ে ৬ কি.মি. অংশ বাংলাদেশ অংশে এবং ৫ কি.মি. ভারতে পড়েছে। দুই দেশের মধ্যে স্বল্প দূরত্বের ভৌগোলিক অবস্থানগত ‘চিকেন নেক’ রেলপথে সংযুক্তির জন্য উদারভাবে ছেড়ে দিয়েছে বাংলাদেশ। কার্যত সুবিধা হলো ভারতের। দীর্ঘ ঘুরপথে আগরতলা-কলকাতার দূরত্ব ১৬শ’ ৫০ কিলোমিটার। আখাউড়া-আগরতলা নয়া রেলপথে সেই দূরত্ব এখন মাত্র ৫৫০ কি.মি.। দূরত্ব কমলো ১১শ’ কি.মি.। সময় বাঁচবে ২৬ ঘণ্টা। চট্টগ্রাম ও মোংলা সমুদ্রবন্দর এবং ঢাকার কমলাপুর আইসিডি থেকে কন্টেইনারসহ ট্রানজিট পণ্য সরাসরি পরিবহন হবে। কলকাতা থেকে রাজধানী ঢাকা হয়ে সরাসরি আখাউড়া-আগরতলা রেলপথে ভারতীয়দের এখন সময় যাবে ৩৬ ঘণ্টার পরিবর্তে মাত্র ১০ ঘণ্টা।

https://dailyinqilab.com/national/article/636232